কলকাতার বিধান সরণীর বিরাট চার তলা বাড়ির মেয়ে। বাবার বড় বাজারে দুটি ব্যবসা চলছে। একটিতে সেলাই মেশিন তৈরি হয়। আরেকটিতে যাবতীয় দর্জি কাজের জিনিস পাওয়া যায়। ব্যবসার বাড়িটিও চার তলা বিশাল।
পাত্রী সবিতা দেখতে খুবই সুন্দরী। তেইশ বছর বয়সে বিয়ে হল। পাত্র দেবী প্রসাদ কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে বি. কম. পাস। কলেজ স্ট্রীটে প্রাইভেট ফার্মে জব করে। হাওড়ার সালকিয়াতে বউকে নিয়ে ভাড়া থাকে। হুগলীর চৈতন্যবাটী গ্রামে প্রচুর জমি, সম্পত্তি আছে। সেখানেই তার পরিবারের সদস্যরা থাকে।
বিয়ের এক বছর পর সবিতা ও দেবী প্রসাদের এক কন্যা জন্ম নিল। এর যখন তিন বছর বয়স হল তখন তাদের আরেক পুত্র সন্তান জন্ম নিল। ছেলের পাঁচ মাস বয়সে অন্নপ্রাশন করার জন্য তারা মেয়ে ও ছেলেকে নিয়ে গ্রামে গেল। সেই যে গেল আর মা, মেয়ে ও ছেলে শহরে এল না। বাবা সালকিয়াতে একাই থাকে। কলেজ স্ট্রীটে চাকরী করে। প্রতি শনিবার রাতে গ্রামে যায় এবং রবিবার বিকেলে আবার শহরে চলে আসে। ওখানে যখন ছেলের তিন বছর বয়স হল তখন আরেক মেয়ের জন্ম হল।
এদিকে গ্রাম থেকে তখন এক ভাই এসে দাদার কাছে রইল। সে হাওড়ার এক কলেজে বি. এস. সি. পড়ল। এ আসার পাঁচ বছর পর আরেক ভাই এল। সে বেলুর রামকৃষ্ণ মিশনে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা করতে লাগল। আগের ভাই পাস করে টিউশনি পড়ায় ও সরকারী চাকরীর পরীক্ষা দেয়। বহু বছর পর সে রেলে চাকরী পেল। এর কয়েক বছর পর অন্য ভাই পাস করে কয়েকমাস টিউশনি পড়ায়। তারপর সরকারী চাকরী পেয়ে বোম্বে চলে গেল। দাদা দুভাইকে নিজের খরচায় পড়ালেখা শেখাল। রোজ সকালে ও রাতে নিজের খরচায়, আপন হাতে রেঁধে খাইয়ে রেখেছিল।
দাদা তার ত্রিশ বছর বয়সে বিয়ে দিল। সে বিয়ে করে বউকে নিয়ে সালকিয়াতে থাকল। দাদাকে বলেছিল যে আলাদা ঘর খুঁজে দিতে যেখানে ওরা দুজন থাকবে। দাদা ভাইকে সালকিয়াতেই নিজের বাসা থেকে খানিক দূরে ঘর জোগাড় করে দিল। সেখানে দাদার কিন্তু ঠাঁই হল না। দাদা একাই থাকে।
এরপর আরেক ভাই যখন একত্রিশ বছরের হল তখন দাদা তারও বিয়ে দিল। সে বউকে নিয়ে বোম্বেতে থাকে।
এদিকে ওরা তিন জন গ্রামের স্কুলে পড়ে। খুব ভালো রেজাল্ট করে সবাই টেন পাস ও টুয়েলভ পাস করল। বড় মেয়েকে এনে বাবা কলকাতার কলেজে বি. এস. সি. পড়াল। সে গার্লস হোস্টেলে থাকে। পাস করার পর তাকে বিয়ে দিয়ে দিল। জামাই হুগলীরই – তাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরের এক গ্রামের ত্রিশ বছরের এক ছেলে। কিন্তু দিল্লীতে সরকারী জব করে। তাই মেয়ে ও জামাই দিল্লীতে থাকে।
ছেলে আশিস নন্দী গ্রাম থেকে রোজ সাইকেলে ও ট্রেনে করে যাওয়া এবং আসা করে হুগলীর উত্তরপাড়া কলেজ থেকে ফার্ষ্ট ক্লাস পেয়ে পাস করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. কম. পড়ল। একই সঙ্গে আই. সি. ডব্লিউ. এ. পড়ল। এম. কম. পাস করল। আই. সি. ডব্লিউ. এ. পড়া চলল।
ছোট মেয়ে শেওড়াফুলিতে থেকে শ্রীরামপুর কলেজ থেকে বি. এস. সি. পাস করল। এরপর কলকাতার রেলে চাকরী করা এক পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হয়ে সে কলকাতার বাসিন্দা হল।
হঠাৎ করে আশিসের সাইনাস হল। কলকাতার এক নার্সিং হোমে অপারেশন হল। তার এক বছর পর তার নার্ভের রোগ হল। পড়া ছেড়ে দিল। প্রচুর দাওয়াই খায় রোজ। ওর যখন ত্রিশ বছর হল তখন নিজের শোবার ঘরে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ল। সেদিন ছিল থার্ড জুন, ২০০১, রবিবার। বাবা তাই সালকিয়া থেকে চৈতন্যবাটী এসে আছে। রোজ আশিস বিকেলে ঘুম থেকে উঠে এসে মায়ের কাছে বিকেলে দুধ খায়। সেদিন আসছে না দেখে মস ছেলের ঘরে গিয়ে দেখল যে দরজায় খিল দেওয়া। ডাকল। ধাক্কা দিল। সারা শব্দ নেই। বাবাকে ডাকল। সেও এসে ডাকাডাকি, ধাক্কাধাক্কি করল। তারপর দরজা ভাঙল। মা ও বাবা দেখল যে ওদের ছয় ফিট লম্বা, ফর্সা, সুন্দর ছেলের মুখ থেকে জিভটা বেরিয়ে এসেছে। ও করি থেকে ঝুলছে। পুরোনো আমলের করি, বর্গার বাড়ি। বাড়ির ভিটাতেই তিনশ বছর ধরে পঞ্চ বাস্তু দেব ও দেবীর নিত্য পূজো হয়। সেই ভিটাতেই এই আত্মহত্যা।
মা পাথরের মূর্তি। বাবা দড়ি কেটে নামাল। মা তার মাথাটা কোলে নিয়ে তাল পাতার পাখায় করে নিজের হাতে হাওয়া করতে লাগল। মৃত ছেলের যেন গরম না করে, তাই। কলকাতার মেয়ে যে হাত পাখা কখনোই বাপের বাড়িতে দেখেই নি সে-ই যখন গ্রামের মা হয়েছে, তখন বিদ্যুৎ না পৌঁছনো বাড়িতে হাত পাখার হাওয়ায় সন্তানদের রাতে গরম থেকে আরাম দিয়ে ঘুমোতে দিয়েছে। নিজে না ঘুমিয়ে রাত কাটাত। সকাল থেকে শাশুড়ির, শ্বশুর, তিন ননদের (যতদিন না ওদের বিয়ে হয়েছে) সব কাজ করে দুপুরে ঘুমোত। আবার ঘুম থেকে উঠে সংসারের কাজ। এখনও তাই সেই একই অভ্যাসে মা পুত্রকে পাখার বাতাস করে চলেছে।
এরপর বাবা নিজের কাঁধে করে ছেলেকে শ্মশানে নিয়ে গেল। আপন হাতে শৈশবে যে বাবা পুত্রকে কোলে বসিয়ে কচি মুখে সন্দেশ খাইয়েছে আজ সেই পিতাই নিজের হাতে যুবক পুত্রের মুখে আগুন দিল। দেহ জ্বলে শেষ হল। বৃদ্ধ বাবা শূণ্য বুকে, খালি ঘরে ফিরে এল। বাড়িতে মা রইল। বাবা এক সপ্তাহ পর আবার কলকাতার অফিসে কাজ করতে লাগল আগের মতোই। থাকল সালকিয়ায়। মা চৈতন্যবাটীতে একাই থাকে। পঞ্চ বাস্তু দেব ও দেবীর সেবা করে ঠিক আগেরই মত। বাবা শনিবার রাতে আসে আর রবিবার বিকেলে চলে যায়।
আশিসের মৃত্যুর সাত বছর পর দেবী প্রসাদের ক্যান্সার হল। শ্রীরামপুরের নার্সিং হোমে মারা গেল। বিধবা সবিতা একাই গ্রামে আছে। বড় মেয়ে বলল তার দিল্লীতে থাকতে। ছোট মেয়ে বলল তার কলকাতায় থাকতে। সে কোথাওই থাকল না। নিজের ছেলের নিত্য ব্যবহৃত হাওয়াই চটিতে রোজ সকালে ও সন্ধ্যায় গঙ্গা জল দিয়ে পূজো করে। তাকে রোজ চার বেলা যেমন বেঁচে থাকতে দিত সেরকমই কাঁসারের থালায় সাজিয়ে খেতে দেয়। তা কিছু পরে নিয়ে গিয়ে পুকুরের জলে ঢেলে দেয়। এভাবে চলতে থাকে। আশিসের মৃত্যুর দশ বছর পর সবিতার ক্যান্সার হল। সেও ঐ শ্রীরামপুরের নার্সিং হোমে মারা গেল।
আশিসের গ্রাজুয়েশন করার সময় যে টাকা স্কলারশীপ পেয়েছিল (বি. কম. পাস করে) সেই টাকা ও নিজের ব্যবসা করার টাকা সব সে আত্মহত্যা করার আগে মায়ের নামেই নোমিনি করে গিয়েছিল। দেবী প্রসাদ আবার আশিসের, সবিতার ও নিজের নামেও অনেক টাকা ব্যাংকে রেখে গিয়েছিল। সবার সব টাকা দুজনে – বড় ও ছোট মেয়ে পেল। আর সব জমি ও সম্পত্তি দু কাকা নিল।
আজও যদি পারো ভারতের, পশ্চিম বঙ্গের, হুগলীর, চৈতন্যবাটী গ্রামের নন্দী বাড়িতে গিয়ে ওদের আত্মার উদ্দেশ্যে কয়েক ফোঁটা চোখের জল ফেলো! আমি আশিসের বড় দিদি অঞ্জলি। আর আশিসের ছোট বোন মনীষা। আমরা বেঁচে অপেক্ষা করছি কবে যে তাদের কাছে স্বর্গে পৌঁছব………