বালুরঘাট হাসপাতাল। গ্রীষ্মকাল। দুপুর দুটো। গরম হাওয়া বইছিল। মাথার ওপর সূর্য। কড়া রোদে বাইরে থাকা মুশকিল। হাসপাতালে আসা সবাই হাসপাতাল চত্বরে একটি বড় নিমগাছের ছায়াতে আশ্রয় নিয়েছিল। আমিও হাসপাতালের সীমানার ভেতর সেই নিমগাছটির ছায়াতে রয়েছি। আরও ঘন্টা তিনেক আমাকে এখানে থাকতে হবে। তবে হ্যাঁ, আমার নিকট আত্মীয় বা পরিচিত কেউ কিন্তু অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভরতি নেই। আমার বাড়ি–বদলপুর। বালুরঘাট থেকে বদলপুরের দূরত্ব প্রায় পঁয়ষট্টি কিলোমিটার। আমার নাম– শ্রীমতি। শ্রীমতি সরদার।
হাসপাতালে নতুন শিশুর জন্ম হয়, নতুন মানুষ ভূমিষ্ঠ হয়। হাসপাতালে অসুস্থ লোকেরা সুস্থ হয়ে হাসি মুখে বাড়ি ফেরে। হাসপাতাল পূণ্যস্থান। তবু অনেকেই হাসপাতালের নাম শুনলে ভয় পায়, হাসপাতালে যেতে অনীহা প্রকাশ করে, যতটা সম্ভব হাসপাতাল থেকে দূরে থাকতে চায়। আমার কিন্তু হাসপাতাল সম্পর্কে কোনও বিরূপ মনোভাব নেই, কোনওরূপ খারাপ মন্তব্য নেই।
বদলপুরে আমাদের বাড়ির কিছুটা দূরে একটা বড় পুকুর আছে। পুকুরপাড়ে রয়েছে একটি বড় বটগাছ। অনেকটা দূরে আছে তালগাছের শাড়ি। পুকুরের ওপর পাড় দিয়ে চলে গেছে কাঁচা রাস্তা। মাঝে-মধ্যে আমার মনে হচ্ছে, আমি যদি এখন বদলপুরে আমার বাড়িতে থাকতাম, তাহলে গ্রীষ্মকালের এই দুপুরবেলা বাড়ি থেকে বের হয়ে একাকী পুকুরপাড়ে গিয়ে বসতাম। পুকুরের ধারে বসে আমি দেখতাম, বটগাছ থেকে একটি লাল-বট-ফল ‘টুক’ শব্দ করে পুকুরের জলে পড়ত আর সঙ্গে সঙ্গে একঝাঁক মাছ সেই লাল-বট-ফলটিকে মুখে নেওয়ার জন্য জলে ভেসে উঠত, ঠিক যেমন একটি ফুটবলকে দখলে নেওয়ার জন্য বাইশ জন ফুটবল খেলোয়াড় তীব্রভাবে লড়াই করে। আমি দেখতে পেতাম, ভীষণ রোদে কাঁচা রাস্তা দিয়ে যেতে-যেতে ক্লান্ত, পিপাসার্ত পথিক পুকুরের জল পান করে শরীরকে ঠান্ডা করত, সতেজ করত। আমি বুঝতাম, ‘জল-ই জীবন’। আমি শুনতে পেতাম, চাতক পাখির কাতর ডাক, ‘জল দাও, জল দাও’। দূরের সারিবদ্ধ তালগাছগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। দেখতাম, দূরের তালগাছগুলো ‘এক পায়ে দাঁড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে’। কাঁচা রাস্তা দিয়ে দইওয়ালা ‘দই চাই, দই চাই’ বলে জোরে হাঁক দিয়ে যেত। আমার মনে পড়ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ডাকঘর নাটকের অমল ও দইওয়ালার কথা। ডাঙা থেকে নেমে এসে কিছু পাতিহাঁস পুকুরটির জলে ডুব দিয়ে গুগলি খেত। আমি উপলব্ধি করতাম, জ্ঞান সমুদ্রে ডুব দিয়েই জ্ঞান সঞ্চয় করতে হয়, জ্ঞান অর্জন করতে হয়।
মাঝে-মাঝে আমার মনটা বিষন্ন লাগছে এই জন্য, গ্রীষ্মকালের যে-দুপুরবেলায় আমার পুকুর পাড়ে বসে থাকার কথা, সেই সময়ে আমি বালুরঘাট হাসপাতালের নিমগাছ তলায় রয়েছি। আমার মনটা ভারাক্রান্ত লাগছে এই কারণে, আমার যে-সময়ে ‘তাল গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে’ দেখার কথা, সেই সময়ে আমি বদলপুর থেকে পঁয়ষট্টি কিলোমিটার দূরে বালুরঘাটে আছি। কখনও কখনও আমার মনটা উদাস লাগছে এই ভেবে যে, গ্রীষ্মের যে-দুপুরবেলায় আমার কাঁচা মাটির রাস্তা দিয়ে দইওয়ালার ‘দই চাই, দই চাই’ ডাক শোনার কথা, গ্রীষ্মের সেই দুপুরবেলায় আমি বালুরঘাট হাসপাতালে অপেক্ষা করছি।
দুই
আমি যেখানে রয়েছি, তার থেকে অল্প কিছুটা দূরে ধীরে-ধীরে ‘স্বর্গের রথ’ এসে দাঁড়াল। আমার পাশে স্বর্গের রথ দেখে চমকে গেলাম আমি। আসলে
এর আগে আমি কখনও স্বর্গের রথ দেখিনি। স্বর্গের রথ দেখতে কেমন,কীরূপ তার আকার-আকৃতি, লম্বা কত, চওড়া কত, উচ্চতা কত, রথের রং কেমন—এসব কিছু অজানা ছিল আমার কাছে। কী দিয়ে তৈরি, ক’টা চাকা আমি তা জানতাম না। আমার পাশেই স্বর্গের রথ দাঁড়িয়ে থাকায় আমি স্বর্গের রথকে ভালোভাবে দেখার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলাম না, স্বর্গের রথকে দু’চোখ ভরে দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। আমি স্বর্গের রথের একদম কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে স্বর্গের রথকে দেখতে লাগলাম। নিজের চোখে স্বর্গের রথ দেখার সৌভাগ্যে আমার মনের ভেতর আনন্দ খেলতে লাগল।
আমি বালুরঘাটে আসার সময় আমার সঙ্গে ছিল আমার বয়স্ক, অসুস্থ বাবা, আমার মামাতো দাদা খোকনদা, তিনজন প্রতিবেশী উপেন কাকা, যোগেশ কাকা ও কোয়েল বৌদি। খোকনদা অনেকটা দূরে এক জায়গায় একা বসে মনোযোগ সহকারে হাসপাতালকে দেখছিল। কোয়েল বৌদি আমার বাবাকে ভালোভাবে হাত দিয়ে ধরে আমার পাশে চুপচাপ বসেছিল। যোগেশ কাকা উপেন কাকার থেকে বয়সে বড়। উপেন কাকা এবং যোগেশ কাকা দু’জনে আমার থেকে কিছুটা দূরে ফাঁকা জায়গায় ঘাসের ওপর বসেছিল।
আমি শুনতে পেলাম, যোগেশ কাকা উপেন কাকাকে বলল, “বুঝলি উপেন, পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে কোটি কোটি বছর আগে। পৃথিবী আরও কোটি কোটি বছর ধরে চলতে থাকবে। কোটি কোটি বছরের মধ্যে একটি মানুষের প্রাপ্য মাত্র পঁয়ষট্টি বছর। কারণ বর্তমানে মানুষের গড় আয়ু পঁয়ষট্টি বছর। কোটি কোটি বছরের মধ্যে মাত্র পঁয়ষট্টি বছর খুবই নগণ্য সময়, খুবই সামান্য সময়। এত অল্প সময়ের মধ্যে একটি মানুষের পৃথিবীর বুকে নিজের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করাটা ভীষন কঠিন।” উপেন কাকা বলল,” যোগেশদা, তুমি ঠিকই বলেছ। মানুষ জীব শ্রেষ্ঠ। অথচ জীব-শ্রেষ্ঠ মানুষের জন্য পৃথিবীতে খুবই কম সময় ধার্য করা আছে। এটা বেমানান। এটা অন্যায়।” যোগেশ কাকা বলল, “মানুষের গড় আয়ু পঁয়ষট্টি বছর হলেও মানুষের কাজ করার সময় মাত্র কুড়ি বছর। শরীর সুস্থ রাখতে একটি মানুষের এক দিনে অর্থাৎ চব্বিশ ঘণ্টায় আট ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। সেই হিসেবে একটি মানুষ পঁয়ষট্টি বছর বাঁচলে মানুষটি প্রায় বাইশ বছর ঘুমিয়ে কাটায়। পঁয়ষট্টি বছর থেকে বাইশ বছর বাদ দিলে বাকি থাকে তেতাল্লিশ বছর। তেতাল্লিশ বছরের মধ্যে মানুষের শিশুকাল ও কৈশোরকাল থাকে সতেরো বছর। এই সময়ে মানুষ নাবালক থাকে। তাহলে তেতাল্লিশ বছর থেকে সতেরো বছর বাদ দিলে অবশিষ্ট থাকে ছাব্বিশ বছর। পাঁচ বছর বৃদ্ধকাল। ছাব্বিশ থেকে পাঁচ বাদ দিলে বাকি থাকে একুশ বছর। এই একুশ বছর হলো একটি মানুষের কাজ করার জন্য ধার্যকৃত সময়। একুশ বছরের মধ্যে একটি মানুষকে যা কাজ করার তা করতে হয়। মানুষের হাতে খুবই অল্প সময়।”
উপেন কাকা বলল, “মানুষ প্রকৃতির কাছে বড্ড অসহায়। প্রকৃতি মানুষকে যা দেয়, তা আবার কেড়ে নেয়। প্রকৃতি মানুষকে প্রাণ দেয় আবার সেই প্রাণ কেড়ে নেয়।” উপেন কাকা আবার বলল, “পৃথিবী নিজ অক্ষের ওপর ঘোরে। পৃথিবী আবার সূর্যের চারদিকেও ঘোরে। পৃথিবীর সাথে-সাথে আমরাও ঘুরি। পৃথিবী মানুষকে ঘোরাতে-ঘোরাতে বড় করে তোলে, আবার ঘোরাতে-ঘোরাতেই মানুষকে মেরে ফেলে।”
যোগেশ কাকা বলল, “আমার তো মনে হয়, প্রকৃতির একটা নির্দিষ্ট নিয়ম হলে খুব ভালো হতো। কমপক্ষে একটা নির্দিষ্ট বছর অবধি প্রতিটি মানুষ সুস্থ স্বাভাবিকভাবে বাঁচবে, তারপর তার ভালো কাজের নিরিখে তার পরবর্তী বাঁচার বয়স নির্ধারিত হবে। সেটা না করে দিন নেই, ক্ষণ নেই, যে কোনও সময়ে, যে কোনও বয়সে প্রকৃতি মানুষকে মেরে ফেলে।”
উপেন কাকা বলল,” মানুষের গড় আয়ু পঁয়ষট্টি ধরলে মানুষের আয়ুষ্কাল মাত্র পঁয়ষট্টি বছর। কিন্তু মানুষের আয়ুষ্কাল এত কম হওয়া একদমই সঠিক নয়। যেহেতু মানুষ জীবদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, তাই মানুষের বেশি দিন বাঁচার অধিকার আছে। মানুষের সেই অধিকার পাওয়া উচিত।”
উপেন কাকা বলল, “ক্রিকেট খেলায় যেমন প্রতিটি বলে ব্যাটসম্যানের মৃত্যু লেখা থাকে, তেমনই প্রতিটি সেকেন্ডে মানুষের মৃত্যু লেখা থাকে। ক্রিকেট খেলায় ব্যাটসম্যান একবার ‘আউট’ হয়ে গেলে সেই ম্যাচে ব্যাটসম্যানের আর দ্বিতীয় বার খেলার সুযোগ থাকে না, পৃথিবীতে একবার কেউ মারা গেলে দ্বিতীয় বার সেই মানুষের আর জন্মগ্রহণ করার সুযোগ থাকে না। অবশ্য কিছু জাতিস্মরদের ঘটনা ব্যতিক্রমী ঘটনা।
যোগেশ কাকা বলল, “ফুটবল খেলায় একবার ‘গোল’ হলে সেই ‘গোল’ শোধ করার সুযোগ থাকে। মানুষের জীবন ফুটবল খেলার মতো হওয়া উচিত। মৃত্যু হলেও আবার একই রূপের জন্ম হওয়ার সুযোগ পাওয়া উচিত।”
আমি উপেন কাকা এবং যোগেশ কাকার সব কথাই শুনতে পেলাম। আমি দু’কাকার উদ্দেশ্যে বললাম, “কাকা, কারও ইচ্ছে না থাকলেও স্রষ্টা তাকে ওপরে তুলে নেয়। আবার কেউ নিজের মৃত্যু চাইলেও, সরকারের কাছে মৃত্যুর জন্য আবেদন করলেও স্রষ্টা তাকে মৃত্যু দেয় না। স্রষ্টা ভীষন স্বেচ্ছাচারী।
তিন
আমি ‘খনগান’ শুনে বাড়ি ফিরছিলাম। খনগান হলো দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার ঐতিহ্যবাহী লোকগান। এই লোকগান গোলাকার জায়গায় পরিবেশন করা হয়। বাদ্যকাররা গোল জায়গার একদম মাঝখানে বসে বাদ্যযন্ত্র বাজায়। তারপর দু’হাত বৃত্তাকার জায়গা ফাঁকা রাখা হয়। এরপর দর্শকরা বৃত্তাকারে বসে। বাদ্যকারদের পরে দু’হাত ফাঁকা বৃত্তাকার জায়গা হলো মঞ্চ। এই বৃত্তাকার মঞ্চে খনগান পরিবেশন করা হয়। ‘খন’ কথার অর্থ ক্ষণ, মুহূর্ত বা তাৎক্ষণিক। বর্তমান সময়ের কোনও ঘটনাকে কেন্দ্র করে খনগান করা হয়। আমার বাড়ি থেকে পাঁচ-সাত কিলোমিটার দূরে জোড়দিঘি নামে এক জায়গায় খনগানের আসর বসেছিল। আমি ‘খনগান’ ভালোবাসতাম। আমি হেঁটে-হেঁটে পাকা রাস্তার একধার ধরে বাড়ি ফিরছিলাম। আমি সুন্দর লাল রঙের একটি শাড়ি পরেছিলাম। নখে লাগিয়ে ছিলাম নেল-পালিশ, চোখে দিয়েছিলাম কাজল। শ্যাম্পু করা চুলে ক্লিপ দিয়ে সুন্দর করে সেঁজেছিলাম আমি। আমার বয়স চল্লিশ বছর। আমি ধীর পায়ে রাস্তা হাঁটছিলাম আর গুনগুন করে খনগান গাইছিলাম—‘বাড়ি ঘরের কামলা স্বামী / গেল্লেন কুনঠিনা, / ভাদরের বেলা আদরে আদরে / স্বামী জাছেরে চলিয়া / বাড়ি ঘরে মন নাই তোমার / হবেন কি দেউলিয়া।’
সামনে দিয়ে একটি বাইক আসছিল। বাইক চালাচ্ছিল এক যুবক ছেলে। ছেলেটি তার বা’দিক ধরে আসছিল। একটি মাঝ বয়সী লোক সাইকেল চালিয়ে তার বা’ দিক ধরে এগিয়ে আসছিল। সাইকেলের কাছাকাছি এসে যুবকটি সাইকেল চালককে সতর্ক করতে বাইকের হর্ণ দিয়েছিল। হর্ণ শোনার সঙ্গে-সঙ্গে সাইকেল চালক লোকটির সাইকেলের হ্যান্ডেল বাইকটির দিকে বেঁকে যায়। বাইকটি সাইকেলে গিয়ে ধাক্কা মারে। সাইকেল চালক সাইকেল নিয়ে রাস্তার একপাশে পড়ে গিয়েছিল। বাইক চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আমাকে এসে বাইকটি লাগিয়ে দিয়েছিল।
আমি আমার পেছন দিকে পড়ে গিয়েছিলাম। রাস্তার ধারে কয়েকটি ইট পড়ে ছিল। আমার পিঠটা ইটগুলোর ওপরে পড়েছিল। ইটগুলোর আঘাতে আমার দম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। রাস্তার ধারে মূমুর্ষূ অবস্থায় পড়ে ছিলাম আমি। খবর পেয়ে খোকনদা, উপেন কাকা, যোগেশ কাকা, কোয়েল বৌদি ছুটে এসেছিল। প্রথমে তারা আমাকে রসিদপুর প্রাথমিক স্বাস্থ কেন্দ্রে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে ভর্তি না নেওয়ায় আমার বাবাকে সাথে নিয়ে খোকনদা, কোয়েল বৌদি, উপেন কাকা ও যোগেশ কাকা আমাকে ট্যাক্সি করে বালুরঘাট সদর হাসপাতালে নিয়ে চলছিল। হাসপাতালে পৌঁছানোর ঠিক আগে রাস্তার মধ্যে মারা গিয়েছিলাম আমি। হাসপাতালে নিয়ে গেলে হাসপাতাল আমাকে মৃত বলে ঘোষণা করেছিল। হাসপাতাল থেকে জানানো হয়েছিল, আমার দেহের পোস্ট-মর্টেম হবে। পোস্টমর্টেম ছাড়া আমার মৃতদেহকে দেওয়া সম্ভব নয়। পোস্টমর্টেম করতে বিকেল পাঁচটা বাজবে। এটা দুপুর একটার ঘটনা। তখন থেকে আমরা হাসপাতালে রয়েছি।
আমার দেহের পোস্টমর্টেম হোক, আমার শরীরের কাটাছেঁড়া হোক, এটা আমি চাইছিলাম না। আমি আমার দেহকে খুব ভালোবাসি। কতটুকু ভালোবাসি, সেটা ভাষায় প্রকাশ করা মুশকিল। আমি আমার দেহকে খুবই যত্ন করতাম। ত্বককে সতেজ এবং উজ্জ্বল রাখতে নিয়মিত পাতিলেবুর রস খেতাম। শরীরের বলিরেখা দূর করার জন্য দেহে আমন্ড তেল ব্যবহার করতাম। দেহে রক্ত সরবরাহ ঠিকমতো রাখার জন্য এবং ত্বকের পুষ্টির জন্য আমি নিয়মিত বেদানা খেতাম। ত্বককে মসৃন ও টানটান রাখতে প্রতিদিন দই খেতাম। দেহে যাতে প্রোটিনের ঘাটতি না পড়ে, সেজন্য এবং ত্বক, চুল ও নখকে ময়শ্চারাইজ রাখতে আমি প্রতিদিন একটা করে ডিম খেতাম। নিজেকে ফ্রেস রাখতে প্রচুর শাকসবজি ও পর্যাপ্ত পরিমাণে জল খেতাম। শরীরকে সবল রাখতে আমি ব্যায়াম করতাম ও প্রতিদিন সকালে আমি প্রাতঃভ্রমণ করতাম। আমার দেহে সামান্য আঘাত লাগলে,কেটে ছড়ে গেলে আমি ভীষণ অস্থির হয়ে উঠতাম। ডাক্তার না দেখালে স্থির থাকতে পারতাম না। আমার দেহের খুব সামান্য রক্তপাত ঘটলে,মনে খুব কষ্ট পেতাম, ভীষণ যন্ত্রণা পেতাম। আমি খুবই মনোযোগ সহকারে আমার শরীরকে সাঁজাতাম। প্রতিদিন আমার দু’চোখে সুন্দর করে কাজল পড়তাম। মুখশ্রীকে আরও সুন্দর করার জন্য, ফর্সা হওয়ার ক্রিম রাখতাম। মাঝে- মাঝে গালে পাউডার লাগিয়ে নিজেকে সুন্দর করে সাঁজাতাম। দেহকে সুস্থ রাখতে সঠিক সময়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। বাড়িতে সুগার মেসিন, রক্তচাপ বসানোর মেসিন কিনেছিলাম। নিয়মিত সুগার ও রক্তচাপ মাপতাম। শীত-গ্রীষ্ম প্রতিদিন স্নান করে দেহকে সতেজ, তরতাজা রাখতাম। রঙিন নাইটি পরতাম, গাঢ় রঙের চুড়িদার পরতাম, গাঢ় রঙের শাড়ি পরতাম। চুলে নিয়মিত শ্যাম্পু দিতাম। আমার বয়স বাড়লেও মনের বয়সকে বাড়তে দিতাম না। প্রতিদিন ঠোঁটে মানানসই লিপস্টিক পরতাম, নখে নেলপালিশ, নাকে নত, কানে দুল পরে সকাল-সন্ধে আমি আয়নার সামনের দাঁড়িয়ে আমার নিজের রূপকে দেখতাম, নিজের সৌন্দর্যকে দেখতাম। অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “শ্রীমতি, তুই নিজের দেহের এত যত্ন করিস কেন, এত পরিচর্যা করিস কেন?” আমি বলেছিলাম, “আমি আমার শরীরকে, আমার দেহকে খুবই ভালোবাসি, তাই।” তাই আমি চাই না আমার দেহের পোস্টমর্টেম হোক, আমার দেহের কাটাছেঁড়া হোক।
আমি জানি,সব জায়গায় সন্তানদের ক্ষেত্রে অন্যদের থেকে বাবা-মায়ের কথার গুরুত্ব অনেক বেশি। বাবা-মায়েরা যে-কথা বলে, সেই কথা লোকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে। তাই আমি প্রথমে
আমি বাবাকে গিয়ে বললাম,”বাবা, ডাক্তারবাবুর কাছে তোমার কথার গুরুত্ব অনেক বেশি। বাবা, তুমি যদি একবার ডাক্তারবাবুকে অনুরোধ করো, আমার পোস্টমর্টেম না করানোর জন্য,তাহলে হয়তো ডাক্তারবাবু তোমার কথার বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আমাকে পোস্টমর্টেম নাও করতে পারে।” বাবা আমার কথার কোনও গুরুত্ব দিল না। তার জায়গা থেকে উঠল না। কোনওরূপ নড়াচড়া করল না। যে-জায়গায় বাবা চুপচাপ, মনমরা হয়ে বসেছিল, সেই জায়গায় বাবা একইরকম নিশ্চুপ, মনমরা হয়ে বসে রইল। আমি ভীষণ হতাশ হয়ে পড়লাম। আমি নিরাশ হয়ে গাছের নিচে আবার আগের জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। দেহের পোস্টমর্টেমের জন্য আমার বুকের মধ্যে খুব ব্যথা হচ্ছিল, কষ্ট হচ্ছিল। যন্ত্রণা অনুভব করছিলাম আমি।
চার
যে-নিম গাছের তলায় আমি আছি,সেই নিমগাছটি থেকে কিছু শুকনো পাতা মাটিতে ঝরে পড়ল। গাছ থেকে গাছের পাতা-ঝরা দেখে আমার মনে পড়ল কবির কবিতার লাইন– ‘খসে খসে পড়ে পাতা/মনে পড়ে কত কথা’। আমার মনে পড়ল পুরনো দিনের কথা। আজ থেকে সতেরো বছর আগের কথা। তখন আমার বয়স ছিল তেইশ বছর। অবিবাহিত ছিলাম। আমি একজন জীবন্ত-স্ট্যাচু ছিলাম। টাকার বিনিময়ে প্যান্ডেলে-প্যান্ডেলে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে জীবন্ত-স্ট্যাচু সাঁজতাম। এটা করেই খুবই কষ্টে আমাদের সংসার চলত। বাড়িতে আমি এবং আমার অসুস্থ বাবা। আমার মা ছিল না। মারা গিয়েছিলেন। আমার বাড়ি ছিল দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বংশীহারী ব্লকের বদলপুর গ্রামে। সেবার জলপাইগুড়ি জেলার ধূপগুড়ি শহরের ‘অগ্রগতি সংঘ’-এ দুর্গাপুজোয় গিয়েছিলাম জীবন্ত-স্ট্যাচু হিসেবে। ভীষণ ভালো ছিল আলোকসজ্জা। খুবই সুন্দর ছিল আয়োজন। নানা রঙের আলোর সংমিশ্রণে রাতের বেলা প্যান্ডেলের ভেতরে ও বাইরে মায়াময় পরিবেশ তৈরি হয়ে ছিল। রাত তখন দশটা। আমি প্যান্ডেলের সামনে আপাদমস্তক সাদা রঙের একটি জীবন্ত নারী-স্ট্যাচু সেঁজে নৃত্যের ভঙ্গিমায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। আবির ও তার বন্ধু তুহিন বাইক নিয়ে অগ্রগতি সংঘের দুর্গাপুজো দেখতে এসেছিল। বাইক কিছুটা দূরে রেখে আবির ও তুহিন হেঁটে-হেঁটে প্যান্ডেলের সামনে এসেছিল। সেই মুহূর্তে প্যান্ডেলে তেমন লোকজন ছিল না। আমার নারী-স্ট্যাচুটিকে দেখে চমকে উঠেছিল আবির। আবিরের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল, “বাহ, খুবই সুন্দর তো শ্বেতপাথরের স্ট্যাচুটি! “আমার স্ট্যাচুটির রূপে, আমার স্ট্যাচুটির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল আবির। আবির বলে উঠেছিল, “সাবাশ শিল্পী! সাবাস ভাস্কর!” আমার সামনে দাঁড়িয়ে আবির তুহিনকে বলেছিল, “জানিস তুহিন, তানজানিয়া নামে একটি দেশে নেট্রন-হ্রদ নামে একটি হ্রদ আছে। নেট্রন-হ্রদ একটি লবণাক্ত জলের হ্রদ। নেট্রন-হ্রদের জলে কোনওভাবে পাখি-পশু-মানুষ পড়লে সঙ্গে-সঙ্গে সেখানেই জীবন্ত অবস্থায় স্ট্যাচু হয়ে যায়। লাভা মিশ্রিত ঘন হ্রদের জলে সূর্যের রশ্মি পড়ে সেই রশ্মি প্রতিফলিত হয়ে আকাশের দিকে ফিরে যায়। আকাশ পথে পাখিরা যাওয়ার সময় পাখিদের চোখে সেই রশ্মি পড়লে পাখিদের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। পাখিরা দিকভ্রান্ত হয়ে হ্রদের জলে পড়লে হ্রদের জলে থাকা লবণ ও সোডার প্রভাবে সাথে-সাথে পাখিগুলো জীবন্ত অবস্থায় স্ট্যাচু হয়ে যায়। যদি কিছু পাখি হ্রদের ধারে কোনওরকমে ওঠে, তাদের গায়ে লেগে থাকা লবণ-সোডার প্রভাবে তারাও স্ট্যাচু হয়ে যায়। ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার নিক ব্রান্ড দক্ষিণ আফ্রিকার তানজানিয়ায় গিয়েছিল ‘ওল ডইনই লেঙ্গাই’ পাহাড়ের ছবি তুলতে। পাহাড়ের ওপরে উঠে সে লক্ষ করেছিল, নিচের দিকে একটি হ্রদ রয়েছে। সে ক্যামেরা নিয়ে হ্রদের কাছে এসেছিল। দেখেছিল,হ্রদের জল লাল। হ্রদের পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল অনেক পাখির-স্ট্যাচু। একটি পাখির-স্ট্যাচু হাতে নিয়ে সে চমকে গিয়েছিল। সে দেখেছিল, পাখিগুলো পাথরের তৈরি স্ট্যাচু নয়। জীবন্ত অবস্থায় পাখিগুলো পাথরের স্ট্যাচু হয়ে গিয়েছিল। নিক ব্রান্ড পাখির স্ট্যাচুগুলোকে ক্ষণিকের জন্য, অল্প সময়ের জন্য প্রাণ দিতে চেয়েছিল। নিক ব্রান্ড পাখির স্ট্যাচুগুলোকে একটি একটি করে গাছের ডালে বসিয়েছিল। গাছের ডালে বসে থাকা পাখিগুলোকে জীবন্ত-পাখি মনে হচ্ছিল, জীবিত-পাখি মনে হচ্ছিল। ফটোগ্রাফার নিক ব্রান্ড সামান্য সময়ের জন্য পাখির স্ট্যাচুগুলোকে বাঁচিয়ে তুলেছিল। নিক ব্রান্ড তার ক্যামেরা দিয়ে পাখিগুলোর ছবি তুলেছিল। গাছের ডালে-বসা-পাখির স্ট্যাচুগুলোকে ক্যামেরার ছবিতেও জীবন্ত-পাখি মনে হচ্ছিল। নিক ব্রান্ড ছবিগুলোর নাম দিয়েছিল–‘অ্যালাইভ ইন ডেথ’। সারা বিশ্বে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল ছবিগুলো।”
আবির বন্ধুকে বলেছিল, “তুহিন, আমি এই শ্বেতপাথরের নারী-স্ট্যাচুটিকে প্রাণ-দান করতে চাই, জীবন-দান করতে চাই।” আবির কিছু সময়ের জন্য বাইরে চলে গিয়েছিল। আবির ফিরে আসলে তুহিন জিজ্ঞেস করেছিল, “কোথায় গিয়েছিলি?” আবির উত্তর দিয়েছিল, “পাশে এক স্টেশনারি দোকানে।” এরপর আবির দ্রুত আমার কাছে এসে মুহূর্তের মধ্যে তার জামার পকেট থেকে একটি লাল-টিপের পাতা বের করে আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার নারী-স্ট্যাচুর কপালের মাঝখানে পরিয়ে দিয়েছিল একটি লাল-টিপ। এরপর তুহিনের কাছে এসে বলেছিল, “তুহিন দেখ, কপালের মাঝখানে লাল-টিপে শ্বেত-পাথরের নারী-স্ট্যাচুটিকে জীবন্ত মনে হচ্ছে।”
তুহিন বলেছিল, “আবির, তুই ঠিক বলেছিস। স্ট্যাচুটিকে জীবিত মনে হচ্ছে। একদম জীবিত।”
পাঁচ
বিকেল চারটে বাজল। খোকনদা এসে বাবা ও কোয়েল বৌদিকে জানাল, “সময় হয়ে গেছে। এখন শ্রীমতিকে মর্গের ভেতর নিয়ে যাওয়া হবে।” আমার দেহ হাসপাতালের মধ্যে গাছের ছায়াতে স্ট্রেচারের ওপর। আকাশের দিকে মুখ করে শুয়ে আছি। আমার পা থেকে মাথা অবধি সমস্ত শরীর সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা। আমার দেহকে মর্গের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য হাসপাতালের এক লোক এসে আমার স্ট্রেচারে হাত লাগাল। লোকটি আমার স্ট্রেচার স্পর্শ করতেই আমার ভেতরটা ঠুকরে কেঁদে উঠল। আমি তীব্র বাধা দিয়ে বলে উঠলাম,” না। না। আমি মর্গে যাব না। আমি পোস্টমর্টেম করাব না।”
আমার কথায় কেউ কর্ণপাত করল না। আমাকে মর্গের দিকে নিয়ে যেতে লাগল। আমার বাবা চুপচাপ। মুখে কোনও কথা নেই। শুধু ফ্যালফ্যাল চোখে আমার দেহের দিকে তাকিয়ে রইল। আমার মন চাইছিল না,আমার দেহে ছুরি চলুক। আমার হৃদয় চাইছিল না, আমার শরীরের কাটাছেঁড়া চলুক। যে-শরীরকে প্রতিদিন দু’বেলা আদর-যত্ন করেছে, যে-দেহকে প্রতিদিন সুন্দর করে সাঁজিয়েছে, সেই যত্নের দেহের ওপর ছুরি চলুক, এটা বেশির ভাগ মানুষই চায় না। যদি মৃতদেহের আপত্তি জানানোর কোনও ব্যবস্থা থাকত, যদি মৃতদের সম্মতির দরকার হতো,তাহলে আমি নিশ্চিত, স্বেচ্ছায় দেহদানকারী বাদে সব মৃতদেহই তার দেহ পোস্টমর্টেম করাতে ‘না’ করে দিত। খোকনদা সকলকে বলল, “এখন শ্রীমতির শরীরকে মর্গের ভেতর নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যদি কারও একবার দেখার ইচ্ছে হয়, তাহলে দেখে নিতে পার।” আমার বাবা কোনও রকম কথা বলল না। নিরব। নিশ্চুপ। শুধু ফ্যালফ্যাল চোখে আমার দেহের দিকে তাকাতে লাগল আর ফ্যালফ্যাল চোখে সকলকে দেখতে লাগল। কোয়েল বৌদি আমাকে খুব ভালোবাসত। কোয়েল বৌদির মুখেও কোনও কথা নেই। শুধু আমার অসুস্থ বাবাকে দু’হাত দিয়ে ভালো করে ধরে রইল। খোকনদা সকলের উদ্দেশ্যে বলল, “সকলকে একদিন চলে যেতেই হবে। কেউ আগে, কেউ পরে। মৃত্যুর হাত থেকে কারও নিস্তার নেই,কারও ছাড় নেই। জন্ম থাকলে মৃত্যু হবেই। মানুষের দেহ থাকলে সর্দি-কাশি হবেই আর মানুষের কপাল থাকলে দুঃখ-কষ্ট হবেই। এটা সকলকে মানতেই হবে।”
স্ট্রেচার চলতে লাগল। খোকনদা আমার স্ট্রেচারের সাথে সাথে ধীরে-ধীরে এগোতে লাগল। আমি দেখলাম, খোকনদার চোখে জল। অশ্রুতে ভিজে গেছে খোকনদার দু’চোখ। আমার দেহ মর্গের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। এ দৃশ্য আমি আর দেখতে পারলাম না। আমি দু’হাত দিয়ে আমার দু’চোখ ঢেকে নিলাম।
ছয়
অগ্রগতি সংঘে নবমীর পরের দিন রাতের বেলা আমি স্বপ্নে আবির ও তার বন্ধু তুহিনকে দেখেছিলাম। তারা দু’জন রাস্তা দিয়ে হেঁটে কোথাও যাচ্ছিল। আমি সেই রাস্তা দিয়ে হেঁটে-হেঁটে আসছিলাম। আমার চুল সাদা, হাত-পা সাদা, আমার সমস্ত শরীর সাদা। আমার কাছাকাছি আসতেই ওরা দু’জন আমাকে দেখে চমকে উঠেছিল। আবির তুহিনকে বলেছিল, “তুহিন, দেখ, এটা তো সেই অগ্রগতি সংঘের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শ্বেতপাথরের স্ট্যাচু। সেই মুখ, সেই চোখ, সেই চুল, সেই নাক, সেই শরীর। কিন্তু স্ট্যাচুটি চলাফেরা করছে কীভাবে? হাঁটা-চলা করছে কীভাবে?” তুহিন বলেছিল,” ঠিক তো। এটা তো অগ্রগতি সংঘের দুর্গাপুজোর শ্বেতপাথরের স্ট্যাচু। স্ট্যাচু তো জড় বস্তু। স্ট্যাচু তো নড়াচড়া করতে পারে না। তাহলে স্ট্যাচুটি হেঁটে-হেঁটে আসছে কীভাবে! এটা তো অসম্ভব!” আমি স্বপ্নের ভেতর লোকের সাথে কথা বলছিলাম, হাসছিলাম। আমার কথা বলা দেখে, আমার হাসি দেখে ওরা দু’জন ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিল। আমি আড়চোখে খেয়াল করেছিলাম, আবির ও তুহিন একটা গাছের পেছনে লুকিয়ে গিয়েছিল এবং গাছের আড়াল থেকে তারা দু’জন আশ্চর্য চোখে লুকিয়ে-লুকিয়ে আমাকে দেখছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, ওরা দু’জন চুপিসারে আমার পিছু নিয়েছিল। আমি স্বপ্নের ভেতর দোলনায় বসে দোল খাচ্ছিলাম, আমি ঝরনার জলে গা ভিজিয়ে স্নান করছিলাম। ওরা অবাক চোখে আমাকে দেখছিল। আমি শুনতে পেয়েছিয়াম, আবির তুহিনকে বলেছিল, “তুহিন, তবে যাই বলিস,আমাদের দেখা শ্বেতপাথরের স্ট্যাচুটিকে হাসতে দেখে, খেলতে দেখে, হাঁটাচলা করতে দেখে, কথা বলতে দেখে, ঝরনার জলে স্নান করতে করতে দেখে আমার কিন্তু খুবই ভালো লাগছে, আমার ভেতরে ভীষন আনন্দ হচ্ছে, খুবই খুশি লাগছে। আমি স্বপ্নের মধ্যে শুনতে পেয়েছিয়াম, ঝরনার জলে আমার স্নান করা দেখে আবির বলে উঠেছিল, “অপুর্ব! খুবই সুন্দর! অসাধারণ!”
আবির কোথায় থাকে, কী তার পরিচয়, তার বাবা–মায়ের নাম কী কিছুই আমি জানি না। শুধু তারা দু’বন্ধু মিলে যখন আমার নারী-স্ট্যাচুর সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল,তখন তাদের নামগুলো শুনেছিলাম। আমি যখন বেঁচে ছিলাম,তখন আমি আবিরকে অনেক খুঁজেছি, অনেক সন্ধান করেছি কিন্তু তার খোঁজ আমি পাইনি। আমার মনে হয়,আবির ও তুহিন ধুপগুড়ির বাইরে কোনও জায়গা থেকে বাইক নিয়ে প্রতিমা দেখতে এসেছিল। অনেক বন্ধুরা কিন্তু এমন বাইক নিয়ে দূর দূরান্তে প্রতিমা দেখতে যায়।
আমি বিয়ে করিনি। মা-হারা আমাকে আমার বিয়ের কথা বাবা আমাকে অনেকবার বলেছিল। বাবা বলত,” শ্রীমতি, বিয়ে কর। আমি আর কতদিন বাঁচব? আমার ভরসায় আর ক’দিন থাকবি? সারাজীবনটা তুই একা-একা কীভাবে কাটাবি?” বাবার কথাতে বিয়েতে আমি সম্মত হইনি।
অগ্রগতি সংঘে সেদিন আমি এত সুন্দর ভাবে সেঁজেছিলাম, এত নিখুঁত রূপে নিজেকে রূপ-দান করেছিলাম যে, যে-কেউ আমাকে দেখলে প্রথমে আমাকে স্ট্যাচু মনে করবে। সেদিন আমি এত দক্ষতার সঙ্গে, এত পরিপক্কতার সাথে দাঁড়িয়ে ছিলাম যে, যে-কেউ আমাকে হঠাৎ করে দেখলে আমাকে শ্বেতপাথরের স্ট্যাচু-ই ভাববে। উপরন্তু, সেদিন প্যান্ডেলের ভেতরে ও বাইরে আলোকসজ্জা এমন মায়াময় ছিল যে, সেই আলোকসজ্জায় আমাকে পাথরের স্ট্যাচু ভাবাটা স্বাভাবিক ছিল।
আমি আমার দুটো হাত দিয়ে বেশ ভালো ভাবে আমার মুখ-চোখ ঢেকে রেখেছিলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ এভাবে থাকতে পারলাম না। আমি ধীরে-ধীরে দুটো আঙুল ফাঁক করলাম। দুটো আঙুলের ফাঁক দিয়ে আমি দেখলাম, আমার দেহ মর্গের কাছাকাছি পৌঁছল।
সাত
আমি আঙুলের ফুটো দিয়ে দেখতে পেলাম, আমার দেহকে মর্গের মধ্যে ঢোকাতে লাগল। আমি আর ঠিক থাকতে পারলাম না। আমি চোখ থেকে আমার হাত দুটো সরিয়ে নিলাম। আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম, “ডাক্তারবাবু, আমার শরীরকে কাটাছেঁড়া করবেন না,আমার দেহকে ব্যবচ্ছেদ করবেন না,আমার শরীরকে দ্বি-খন্ডিত করবেন না। আমার দেহের মধ্যে আবিরের দেওয়া প্রাণ আছে,আমার শরীরের ভেতর আবিরের দেওয়া জীবন রয়েছে।”
কেউ আমার কথা মানল না, কেউ আমার কথাকে পাত্তা দিল না। আমার কথার কোনওরূপ গুরুত্ব না দিয়ে আমার দেহকে মর্গের ভেতর প্রবেশ করাল। আমার চোখের সামনে মর্গের দরজা বন্ধ করে দিল। আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম, “ডাক্তারবাবু,আবির আমার দেহে প্রাণ-দান করেছিল, আবির আমার শরীরে জীবন-দান করেছিল।”
আট
পোস্টমর্টেম শেষ। পোস্টমর্টেম চলাকালীন আমি আমার দু’হাত দিয়ে চোখ দু’টি ঢেকে মর্গ থেকে অল্প দূরে এক জায়গায় বসেছিলাম। দরজা খোলার শব্দে আমি চোখ দুটো খুললাম। আমি হাত সরিয়ে দেখি, ডাক্তারবাবু মর্গের দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। আমি উঠে দাঁড়ালাম। আমার দেহকে কাটাছেঁড়া অবস্থায়,দ্বি-খন্ডিত অবস্থায়, চেরা অবস্থায় দেখতে পারব না বলে আমি আমার দেহের কাছে যেতে পারলাম না। অনেকটা দূরে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলাম। দূর থেকে আমি দেখলাম, মর্গের ভেতর থেকে আমার দেহকে বাইরে বের করা হলো। তারপর আমার দেহকে ধীরে-ধীরে ‘স্বর্গের রথ’ লেখা শববাহী গাড়ির দিকে নিয়ে চলল। আস্তে-আস্তে ‘স্বর্গের রথ’ নামক শববাহী গাড়িতে আমার দেহকে তুলে দিল।
আমার চোখের পাতা স্থির পাতা হয়ে গেল। হাত-পা নিশ্চল হয়ে গেল। যে-জায়গায় আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম,সেই জায়গায় আমার শরীর আটকে গেল। আমার মুখের কথা হারিয়ে গেল। স্থির চোখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দূর থেকে আমার মৃতদেহকে দেখতে লাগলাম।
মানুষের মন তিন প্রকার–চেতন মন, অচেতন মন ও অবচেতন মন। জাগ্রত অবস্থায় মানুষের যে–মন থাকে, তাকে বলা হয় চেতন মন। যে-মনে কোনও ঘটনা পৌঁছলে, সেই ঘটনা আর মানুষ স্মরণ করতে পারে না বা ভুলে যায়, সেই ধরনের মনকে বলে অচেতন মন। মানুষ ঘুমিয়ে পড়লে যে-মন কাজ করে, যে-মনে মানুষ স্বপ্ন দেখে, সেটা হলো অবচেতন মন। আমার দেহের ভেতর এখন কোন প্রকার মন আছে, আমার শরীরের মধ্যে এই মুহূর্তে কোন ধরনের মন অবস্থান করছে তা আমি তা জানি না। তবে আমার শরীরের ভেতরে প্রবল ধারায় অতিবৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। মেঘ-ভাঙা বৃষ্টি। এক মিনিটের কম সময়ের মধ্যে শিলা ও বজ্রপাত সহকারে আমার দেহের মধ্যে ভীষণ ভাবে মেঘ-ভাঙা বৃষ্টি আরম্ভ হয়ে গেল। ‘হিমালয়ান সুনামী’ নামক মেঘ-ভাঙা বৃষ্টির মতো আমার দেহের মধ্যে ব্যাপক হারে অনবরত মেঘ-ভাঙা বৃষ্টি ঝরে পড়তে লাগল।
আমার দেহের বাইরে অনাবৃষ্টি। ভীষণ অনাবৃষ্টি। এক ফোঁটা জলের চিহ্ন নেই। গ্রীষ্মকালের ভয়ানক খরার মতো তীব্র খরা দেহের বাইরে। দেহের বাইরের দিকটা শুষ্ক। খুবই শুকনো। দেহের বাইরে জলাভাব। আমার শরীরের বাইরে জলের আকাল।
নয়
স্বর্গের রথে চালকের আসনে চালক বসল। চালক রথে স্টার্ট দিল। স্বর্গের রথ চালু হলো। আমার রুক্ষ, শুষ্ক দু’চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল ঝরতে লাগল। অঝোর ধারায় জল ঝরতে লাগল। আমার শরীরের বাইরে গাল, গলা ও বুক বেয়ে অজস্র ধারায় জল ঝরতে লাগল। স্বর্গের রথ চলতে শুরু করল। আমি আর নিশ্চুপ থাকতে পারলাম না, চুপচাপ থাকতে পারলাম না। আমি খুব জোরে কেঁদে উঠলাম। আমি বলে উঠলাম, “আবির, আর কিছু সময় পরে আমার শরীরের দাহ হবে, আমার দেহ পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। আর অল্প সময় পর আমার দেহ চিরদিনের জন্য এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে। পৃথিবী থেকে চিরতরে মুছে যাব আমি, চিরকালের জন্য হারিয়ে যাব আমি। আবির, তুমি একবার এসে আমাকে দেখে যাও। আবির, তুমি একটিবার আমাকে দেখে যাও।”
সমাপ্ত
✍️এই নিবন্ধটি সাময়িকীর সুন্দর এবং সহজ জমা ফর্ম ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। আপনার লেখা জমাদিন!