চন্দ্রবিন্দু হল একটি জনপ্রিয় বাংলা ব্যান্ড, যা তার তীক্ষ্ণ বিদ্রুপাত্মক গানের জন্য পরিচিত। তাদের গানের লিরিক্সে সেম্প্রতিক ঘটনা, সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং সাংস্কৃতিক বিষয় নিয়ে নানা ধরনের মন্তব্য দেখা যায়। কলকাতা ভিত্তিক এই ব্যান্ডটি ভারতীয় শহর কলকাতার পাশাপাশি দিল্লি, মুম্বাই এবং বিশ্বের অন্যান্য শহরেও ব্যাপক জনপ্রিয়, যেখানে বড় সংখ্যক বাঙালি সম্প্রদায় বসবাস করে। ব্যান্ডটি তার হিউমার, বুদ্ধি এবং গভীর সাংস্কৃতিক রেফারেন্সের জন্য শ্রোতাদের হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করেছে। আসুন, চন্দ্রবিন্দুর ইতিহাস, নামের উৎপত্তি এবং যাত্রার বিস্তারিত জানি।
নামের উৎপত্তি: সাহিত্যিক ননসেন্সের প্রতি একটি শ্রদ্ধাঞ্জলি
‘চন্দ্রবিন্দু’ নামটি বাংলা বর্ণমালার একটি বিশেষ চিহ্ন, ◌̐, যা ‘চন্দ্রবিন্দু’ নামে পরিচিত। এটি বাংলা বর্ণমালার শেষ অক্ষর এবং একটি ডাইঅ্যাক্রিটিক চিহ্ন যা স্বরবর্ণের উচ্চারণ পরিবর্তন করতে ব্যবহৃত হয়। ব্যান্ডটির নাম এই চিহ্ন থেকেই নেওয়া হয়েছে। তবে, ব্যান্ডের নামটি আরও গভীরে গিয়ে বাংলা সাহিত্যকে সম্মান জানায়।
এটির উৎস শুুকুমার রায়ের বিখ্যাত ‘হযবরল’ নামক একটি ননসেন্স পুস্তক থেকে এসেছে। সেখানে একটি হাস্যকর সংলাপ রয়েছে, যেখানে একটি বিড়াল বলে:
“বেড়াল বলল, ‘বেড়ালও বলতে পার, রুমালও বলতে পার, চন্দ্রবিন্দুও বলতে পার।’ আমি বললাম, ‘চন্দ্রবিন্দু কেন?’”
বিড়ালটি বলে, “তুমি কি বুঝতে পার না? ‘চ’ মানে চন্দ্রবিন্দু, ‘শ’ মানে বিড়াল (birāl) এবং ‘মা’ মানে রুমাল (rumāl)—এভাবে আমরা চশমা (chashma) বানাতে পার।”
এই সাহিত্যিক ননসেন্সের মধ্যে সুকুমার রায়ের খেলা করা শব্দ ব্যবহারটি ব্যান্ডের মনোভাবের মতোই—বিদ্রুপাত্মক, হাস্যকর এবং চিন্তা-ভাবনাকে চ্যালেঞ্জ করে।
ব্যান্ডের গঠন এবং প্রাথমিক সংগ্রাম
১৯৮৯ সালে চন্দ্রবিন্দু প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তাদের শুরুটা ছিল বেশ কষ্টকর। তাদের প্রথম অ্যালবাম আর জানি না (১৯৯৭) একটি পুরনো সাউন্ড মিক্সারের সাহায্যে রেকর্ড করা হয়েছিল এবং এটি অনেকটা এক রকম ঠাণ্ডা প্রতিক্রিয়া পেয়েছিল। তবে, ব্যান্ডটি গৌতম চট্টোপাধ্যায় (মোহিনের ঘোড়াগুলি) এর কাছ থেকে মনোযোগ পায় এবং তিনি তাদের আশার অডিওর কাছে সুপারিশ করেন, যার পর তাদের দ্বিতীয় অ্যালবাম গাধা (১৯৯৮) প্রকাশিত হয়। এটি ছিল ব্যান্ডের জন্য একটি মাইলফলক এবং এই অ্যালবামটির মাধ্যমে তারা নিজেদের পরিচিতি অর্জন করে।
তাদের প্রথম জনসাধারণের লাইভ শো অনুষ্ঠিত হয় কলকাতার মঞ্চে, রবীন্দ্রসদন-এর কাছে, এবং এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত।
ব্যান্ড সদস্যরা
চন্দ্রবিন্দুর প্রধান সদস্যরা হলেন:
- উপল সেনগুপ্ত – প্রধান গায়ক এবং সঙ্গীত রচয়িতা
- অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় – প্রধান গায়ক এবং সঙ্গীত রচয়িতা
- চন্দ্রিল ভট্টাচার্য – গীতিকার, সঙ্গীত রচয়িতা, এবং কণ্ঠশিল্পী
- অরূপ পট্টনা – বেসিস্ট
- সুরজিত মুখোপাধ্যায় – গিটারিস্ট এবং অ্যারেঞ্জার
- রাজশেখর কুণ্ডু – ড্রামার
- সিব্রাত বিহারী বিশ্বাস (সিবু) – কিবোর্ডিস্ট
- সৌরভ – পারকিউশনিস্ট
- তির্থঙ্কর – সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার
চন্দ্রবিন্দু ব্যান্ডের অনেক সদস্য পরিবর্তন হয়েছে, তবে তাদের সঙ্গীতের মান এবং বিদ্রুপাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি কখনোই পরিবর্তিত হয়নি।
ডিসকোগ্রাফি: একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সঙ্গীত ভ্রমণ
চন্দ্রবিন্দুর দীর্ঘ এবং বৈচিত্র্যময় ডিসকোগ্রাফি রয়েছে। তাদের অ্যালবামগুলি ব্যান্ডের প্রাথমিক সংগ্রাম থেকে শুরু করে সাফল্যের শিখরে ওঠার যাত্রা প্রদর্শন করে। এখানে তাদের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্টুডিও এবং কম্পাইলেশন অ্যালবামের একটি তালিকা দেওয়া হল:
স্টুডিও অ্যালবাম:
- আর জানি না (১৯৯৭)
- গাধা (১৯৯৮)
- ত্বকের যত্ন নিন (১৯৯৯)
- চও (২০০১)
- ডাকনাম (২০০২)
- জুজু (২০০৩)
- হুলাবিলা (২০০৫)
- U/A (২০০৮)
- নয় (২০১২)
- টালোবাসা (২০২৪)
কম্পাইলেশন অ্যালবাম:
- চন্দ্রবিন্দাস (২০০৫)
- এভাবেও ফিরে আসা যায় (২০০৫)
- সেরা চন্দ্রবিন্দু (২০০৮)
চন্দ্রবিন্দু ব্যান্ড বাংলা চলচ্চিত্রেও তাদের সঙ্গীত প্রদান করেছে। তাদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ হল চলচ্চিত্র অন্তহীন (২০০৯) এর জন্য সেরা গীতিকার পুরস্কার লাভ, যেখানে তারা উভয়ে গীতিকার হিসেবে কাজ করেছিলেন এবং ২০১০ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
সঙ্গীতের বিবর্তন
চন্দ্রবিন্দুর সঙ্গীতের ধরন নানা রকম শৈলী মিশ্রিত—রক, পপ, ফোক এবং জ্যাজ—সবকিছুই বাংলা সঙ্গীতের ঐতিহ্যের সাথে মিশে গেছে। সময়ের সাথে তারা আরো জটিল সুরের এবং অধিক বৈচিত্র্যময় আয়োজনের দিকে এগিয়েছে। তারা মূলত জনসাধারণের মধ্যে সমাজ, রাজনীতি এবং সাংস্কৃতিক আলোচনার উত্থান ঘটাতে চাইতেন, যেটি তাদের সঙ্গীতের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
আন্তর্জাতিক সম্মান
২০১৫ সালের জুলাইয়ে, চন্দ্রবিন্দু তাদের প্রথম আন্তর্জাতিক সফরে লন্ডনে কনসার্ট দিয়েছিল, যা কলকাতা ভিত্তিক চাইল্ড ইন নিড ইনস্টিটিউট (CINI) এর সাহায্যে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই আন্তর্জাতিক সফরটি তাদের বিশ্বব্যাপী শ্রোতাদের কাছে পৌঁছাতে সহায়ক হয়েছিল, বিশেষ করে বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা বিদেশে বসবাস করেন।
চন্দ্রবিন্দুর সাংস্কৃতিক প্রভাব
চন্দ্রবিন্দু বাংলা সঙ্গীতের মধ্যে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছে। তাদের গানগুলি হাস্যরস এবং তীক্ষ্ণ সামাজিক মন্তব্যের মাধ্যমে শ্রোতাদের চিন্তা করতে বাধ্য করে। এভাবে, তাদের সঙ্গীত শুধু একটি সংগীতের আঙ্গিক নয়, বরং সমাজের দিকে নজর দেওয়া এবং এটি পুনর্গঠিত করার একটি মাধ্যম।
চূড়ান্ত ভাবনা: হাস্যরস এবং বুদ্ধিমত্তার একটি ঐতিহ্য
চন্দ্রবিন্দু আজও বাংলা সঙ্গীতের অন্যতম বিশিষ্ট ব্যান্ড হিসেবে পরিচিত। তাদের তীক্ষ্ণ এবং বিদ্রুপাত্মক গানের মাধ্যমে তারা বাংলা সঙ্গীতকে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে। আগামী অ্যালবাম টালোবাসা (২০২৪) নিয়ে ইতিমধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, এবং চন্দ্রবিন্দু তাদের সাংস্কৃতিক যাত্রা অব্যাহত রেখেছে।