ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ: মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বাড়ছে
মধ্যপ্রাচ্যে একটি বড় ধরনের আঞ্চলিক সংঘাতের ঝুঁকি বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। চলমান গাজা যুদ্ধে ক্রমবর্ধমান ফিলিস্তিনি হতাহতের সংখ্যা ইতোমধ্যে অঞ্চলটিতে ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ সিরিয়াতে সোমবার (২৫ ডিসেম্বর) ইসরায়েলের একটি হামলায় ইরানের একজন শীর্ষ জেনারেল নিহতের ঘটনা এ আশঙ্কাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বুধবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য হিল এ খবর জানিয়েছে।
সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের বাইরের একটি এলাকায় সোমবার ইসরায়েলি বিমান হামলায় ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি)-এর শীর্ষ কমান্ডার সরদার সায়েদ রাজি মৌসাভি নিহত হন। সিরিয়া ও ইরানের সামরিক জোট সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
ইসরায়েলের হাতে ইরানি সেনা কর্মকর্তা নিহত হওয়ার এ ঘটনাকে বিশাল ক্ষতি হিসেবে চিহ্নিত করেছে ইরান। এর প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকারও করেছে দেশটি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আব্দুল্লাহিয়ান, ‘একটি কঠিন ক্ষণগণনার জন্য অপেক্ষা করছে তেল আবিব।’
ইসরায়েল এমন সময় এই হামলা করলো যখন অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হাতে বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের ক্রমবর্ধমান মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। আর এমন পরিস্থিতিতে যেকোনও সম্ভাব্য কারণে এ যুদ্ধ বৃহত্তর আঞ্চলিক সংঘাতে রূপ নেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই এটি যাতে ইসরায়েল ও সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের বাইরে ছড়িয়ে না পড়ে তা নিশ্চিত করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, দামেস্কে ইসরায়েলের সোমবারের ওই হামলা মার্কিন এ প্রচেষ্টায় গুড়েবালি দিয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের আঞ্চলিক সংঘাত প্রতিরোধের চেষ্টা করতে গিয়ে এই সংঘাতের গভীর খাদে খোদ যুক্তরাষ্ট্রই আটকে যাচ্ছে। ইরাক ও সিরিয়ায় ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর নিরলস আক্রমণের শিকার হচ্ছে ওয়াশিংটন। মিলিশিয়ারা গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভয়ংকর হামলাটি চালিয়েছে বড়দিনে। ওই দিনের ড্রোন হামলায় এক মার্কিন সেনাসহ আরও দুইজন আহত হন। আহত ওই সেনার অবস্থা গুরুতর ছিল।
‘মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত কমার কোনও লক্ষণ নেই’
তবে মধ্যপ্রাচ্যে শিগগিরই হুটহাট বৃহত্তর কোনও যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে বলে মনে করছেন না বিশ্লেষকরা। তবে নববর্ষ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই অঞ্চলে এসব সংঘাত কমে যাবে এমন কোনও লক্ষণ নেই—এসব হামলার ঘটনা অন্তত এটিই নিশ্চিত করছে।
স্টিমসন সেন্টারের এক বিশিষ্ট গবেষক এবং থিংক ট্যাংকের প্রকাশিত মিডল ইস্ট ভয়েসেস ব্লগের সম্পাদক বারবারা স্লাভিন বলেন, ‘সবাই দাবা খেলছে। এখানে বিভিন্ন ধরনের পক্ষ আছে।’
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের শঙ্কা?
শিগগিরই যেকোনও সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের এ সংঘাতের হিসাব-নিকাশে নাটকীয় কোনও পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছেন না স্লাভিন। তিনি বলেন, ‘এই যুদ্ধে ইসরায়েল, গাজা এবং পশ্চিম তীরেই প্রকৃত হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। আর অন্যান্য হামলাগুলো প্রতীকী, যদিও সেগুলো ভয়ংকর। বর্তমানে চলমান সংঘাতের কিছু অংশের চেয়েও অনেক বেশি প্রতীকী সেগুলো। এটি সর্বদাই পরিবর্তনশীল, সর্বদাই এটি বাড়তে পারে। তবে এই বিকাশ একটি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ডেকে আনবে বলে আমার মনে হচ্ছে না।
হামাসকে ইরানের অর্থায়ন
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট বলেছেন, ৭ অক্টোবরে হামাসের ওই হামলার পর তার বাহিনী একটি ‘বহুমুখী’ যুদ্ধ করছে। ওই হামলায় দক্ষিণ ইসরায়েলে এক হাজার ২০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল। ইসরায়েলের দাবি, গাজায় নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে লিপ্ত সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসকে ইরান অর্থায়ন করছে।
মঙ্গলবার গ্যালান্ট বলেছিলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে কাজ করে এমন যে কেউই লক্ষ্যবস্তু, কেউই আক্রমণের বাইরে নয়।’ মৌসাভি ইরানের কুদস ফোর্সের নিহত প্রধান জেনারেল কাসেম সোলাইমানির ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ২০২০ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় নিহত হয়েছিলেন তিনি। প্রায় চার বছর আগে সোলাইমানির মৃত্যুর মতো চলতি সপ্তাহে মৌসাভি হত্যার ঘটনাতেও ইরান এবং তার মিত্রদের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে।
প্রতিশোধ নেবে ইরান?
ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের খবর অনুসারে, মৌসাভির মৃত্যু নিয়ে সোমবার দেশটির প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি বলেছেন, তেহরান অবশ্যই এই হামলার প্রতিশোধ নেবে।
রাইসির দাবি, ‘তার শাহাদাত এই অঞ্চলে দখলদার ইহুদিবাদী শাসকদের হতাশা ও দুর্বলতার আরেকটি লক্ষণ।’
রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম আরও জানিয়েছে, মৌসাভির ওপর ইসরায়েলি হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে হিজবুল্লাহও। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, ইরান যদি ইসরায়েলি হামলার জবাব দেয় তবে হিজবুল্লাহ এবং অন্যান্য প্রক্সি গ্রুপের সঙ্গে সংঘাতে জড়াবে ইসরায়েল।
কুইন্সি ইনস্টিটিউট ফর রেসপন্সিবল স্টেটক্রাফ্টের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট ত্রিতা পার্সি বলেছেন, সম্ভবত ইরানকে একটি বার্তা পাঠানোর জন্য এই হামলা পরিচালনা করেছে ইসরায়েল: প্রক্সি গ্রুপগুলোর সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে ইরানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা লক্ষ্যবস্তু হতে পারে এবং হবে।
তবে পার্সির মূল্যায়ন বলছে, ইসরায়েলকে সরাসরি বা বর্ধিত আক্রমণের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানাবে না ইরান। এর সপক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, ‘তারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দীর্ঘ অথচ ধীর কৌশল নিয়েছে।’
তিনি আরও বলেছিলেন, ‘ইরান মূলত হুথি, হিজবুল্লাহ এবং অন্যদের আরও সক্ষম করে তুলছে। আমরা সম্ভবত ইরানের হামলা করার পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্রে আরও হামলার ঘটনা দেখতে যাচ্ছি।’
প্রক্সি গ্রুপগুলোর সক্ষমতা বাড়াচ্ছে ইরান!
বছরের পর বছর ধরে ছায়াযুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে ইসরায়েল ও ইরান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত এক দশকে বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ ইরানি কর্মকর্তাকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। তবে ইসরায়েল বা ইসরায়েলি অবস্থানে খুব কমই সরাসরি হামলার নির্দেশ দিয়েছে তেহরান। সাধারণত প্রক্সি গ্রুপগুলোর মাধ্যমেই প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে থাকে দেশটি।
বর্তমানে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক উত্তেজনা বিরাজ করছে। ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ১৭ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত মার্কিন সেনাদের ওপর প্রায় ১০০টি হামলা করেছে ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলো।
এখন পর্যন্ত ইরাক ও সিরিয়ায় যত হামলা হয়েছে তাতে মার্কিন সেনারা বড়জোড় সামান্য আহত হয়েছে। তবে বড়দিনে ওই হামলায় এক মার্কিন সেনা গুরুতর আহত হয়েছিলেন। ওই দিন উত্তর ইরাকের একটি বিমান ঘাঁটিতে একটি বিস্ফোরক ড্রোন দিয়ে আঘাত করেছিল মিলিশিয়ারা। এই হামলার জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা হামলায় এক জঙ্গি নিহত এবং আরও ১৮ জন আহত হয়।
যুক্তরাষ্ট্র চায় না উত্তেজনা বাড়ুক
বড়দিনের ওই ঘটনাগুলো মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে কিনা জানতে চাইলে মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিনের সোমবারের একটি বিবৃতির কথা উল্লেখ করেছে পেন্টাগন। ওই বিবৃতিতে অস্টিন বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র চায় না উত্তেজনা বাড়ুক। তবে ‘আমাদের জনগণ এবং স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় আরও ব্যবস্থা নিতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ও পুরোপুরি প্রস্তুত।’
ইরান-সমর্থিত ইয়েমেনের বিদ্রোহী গোষ্ঠী হুথিরা লোহিত সাগরে জাহাজ ও বাণিজ্য নৌবহরের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলত বাণিজ্যিক নৌবহরগুলোকে হয়রানি করেছে তারা। তবে কয়েক সপ্তাহ আগে, একটি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে একটি জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত এবং গত মাসে আরেকটি জাহাজ জব্দ করেছিল। হুথিদের ঠেকাতে গত সপ্তাহে একটি মেরিটাইম টাস্ক ফোর্স গঠন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে গোষ্ঠীটি লোহিত সাগরে আক্রমণের গতি বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক উত্তেজনা কমানোর উপায়
বিশ্লেষকরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে উত্তেজনা কমানোর একমাত্র উপায় হলো: গাজা যুদ্ধ যদি বিরতিতে পৌঁছায় বা যদি তা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। গাজা যুদ্ধে ক্রমবর্ধমান উচ্চ মৃত্যুর সংখ্যা পুরো বিশ্বে; বিশেষ করে আরব দেশ, ইরান এবং ইরানের মিত্রদের মধ্যে ক্ষোভ জন্ম দিয়েছে। হামাসের স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মতে, চলমান এ যুদ্ধে এ পর্যন্ত প্রায় ২১ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।
গাজায় ইসরায়েলের হামলার গতির তীব্রতা কমিয়ে আনার জন্য ইসরায়েলকে চাপ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন এ কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চলতি মাসের শুরুতে কিছুটা সফলতার মুখ দেখেছিল। সঠিক সময় এলেই হামলার তীব্রতা কমানো হবে—তখন এমন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ইসরায়েলি কর্মকর্তারা।
তবে সেই সঠিক সময় কবে আসবে তা স্পষ্ট নয়।
‘এই দেশ ছাড়া আমাদের আর কোনও দেশ নেই’
চলতি সপ্তাহে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছিলেন, দক্ষিণ গাজায় লড়াই চলছে। সেখানে প্রায় ২০ লাখ ফিলিস্তিনি বেসামরিক বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
এ সময় তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, ইসরায়েলি সেনাদের এ যুদ্ধ ‘শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যেতে হবে।’ পার্লামেন্টের প্রতিনিধি পরিষদ নেসেটে নেতানিয়াহু বলেছিলেন, ‘আমরা থামছি না এবং বিজয়ী না হওয়া পর্যন্ত আমরা থামবোও না। কারণ, এই দেশ ছাড়া আমাদের আর কোনও দেশ নেই এবং আমাদের আর কোনও উপায়ও নেই।
কুইন্সি ইনস্টিটিউটের পার্সি বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে ‘প্রতিদিন আমরা সর্বাত্মক যুদ্ধের কাছাকাছি চলে যাচ্ছি।’ যার মানে, গাজায় ইসরায়েলি আক্রমণের গতি ধীর না করা পর্যন্ত সম্ভবত এটি আরও ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠবে।
তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা অত্যন্ত বিপজ্জনক ও ক্রমবর্ধমান একটি চক্রের মধ্যে রয়েছি। আঞ্চলিক যুদ্ধ থামানোর এবং প্রতিরোধ করার সবচেয়ে সুস্পষ্ট ও সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো এমন একটি পদক্ষেপ নেওয়া—যেটি থেকে ইসরায়েলি প্রশাসন প্রায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে—আর তা হলো গাজায় যুদ্ধবিরতি।’