বিদ্রোহ দমনে ক্ষুধামৃত্যু ও গ্রেপ্তারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে মিয়ানমার জান্তা
মিয়ানমারের বাংলাদেশসংলগ্ন রাজ্য রাখাইনে স্থানীয়দের ভয় দেখাতে ক্ষুধামৃত্যু ও গ্রেপ্তারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে জান্তাবাহিনী। রাখাইনের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে চলমান লড়াইয়ের মধ্যেই জান্তাবাহিনী গত মাসে ১৭০ জন বেসামরিক নাগরিককে গ্রেপ্তার করেছে উপযুক্ত কোনো কারণ ছাড়াই। এমনকি স্থানীয়দের খাবার থেকে বঞ্চিত করার মতো কৌশলেরও আশ্রয় নিয়েছে তারা।
স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বরাত দিয়ে মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম ইরাবতীর এক বিশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। মিয়ানমারের পার্লামেন্টের সাবেক আইনপ্রণেতা উ অং থং শোয়ে বলেন, মূলত ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করতেই এমন গ্রেপ্তার, ধরপাকড়ের আশ্রয় নিচ্ছে জান্তাবাহিনী।
রাখাইনের বুথিডং থেকে নির্বাচিত এই আইনপ্রণেতা বলেন, ‘শাসকগোষ্ঠী আরাকান আর্মিকে হারাতে পারছে না, তাই তারা সাধারণ নাগরিকদের গ্রেপ্তার ও হত্যা করার কৌশল নিয়েছে স্রেফ মানুষের মনে ভয় ধরানোর উদ্দেশ্যে।’ এ সময় তিনি আরও অভিযোগ করেন, কেবল গ্রেপ্তার বা হত্যাই নয়, রাখাইন রাজ্যের বাসিন্দাদের ক্ষুধায় মেরে ফেলার কৌশলও নিয়েছে জান্তাবাহিনী।
উ অং থং শোয়ে বলেন, ‘জান্তা সরকার রাখাইনে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং এই অঞ্চলে খাবারের সরবরাহ ব্যবস্থা বন্ধ করে দিয়েছে। উদ্দেশ্য একটাই, যাতে সাধারণ জনগণকে ভুখা রাখা যায়। তারা (জান্তাবাহিনী) ক্ষমতা দীর্ঘায়ত করতে এমন কোনো যুদ্ধাপরাধ নেই যা করছে না।’
রাখাইনের সিতওয়ের একটি মানবাধিকার সংস্থার সদস্য নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা গ্রেপ্তারের যে তথ্য বা চিত্র দেখতে পাচ্ছি, বাস্তবিক অর্থে গ্রেপ্তারের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।’ তাঁর মতে, গত অক্টোবরের শেষ দিকে আরাকান আর্মি ও জান্তাবাহিনীর মধ্যে শুরু হওয়া লড়াইয়ের পর থেকে দুই শতাধিক বেসামরিক নাগরিককে গ্রেপ্তার করেছে জান্তা সরকার।
ওই মানবাধিকারকর্মী বলেন, ‘গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই বড় ব্যবসায়ের মালিক এবং বেশ সম্পদশালী ব্যক্তিত্ব। তাদের পরিবার জানেই না কেন এবং কখন তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এমনও ঘটনা ঘটেছে, গ্রেপ্তার হওয়ার পর সেই বিষয়টি গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করতেও ভয় পেয়েছে। এমনকি এই এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগও নেই।’
আবার যুদ্ধের কারণে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত লোকদেরও ব্যাপকভাবে গ্রেপ্তার করছে জান্তাবাহিনী। গত ১৭ ডিসেম্বর খাবার শেষ হয়ে যাওয়ায় কায়াকতালুনের একটি শরণার্থীশিবির ত্যাগ করায় ১৩ রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করে জান্তাবাহিনী। তাদের অপরাধ, তারা শিবির ছেড়ে কায়াকতালুন শহরে প্রবেশ করেছিল খাবারের সন্ধানে।
নাম প্রকাশ করার শর্তে ওই শরণার্থীশিবিরের এক বাসিন্দা ইরাবতীকে বলেন, ‘আমাদের খাবার ফুরিয়ে গেছে, তার পরও জান্তাবাহিনী আমাদের শহরে ঢুকতে দিচ্ছে না।’ ২০১২ সালে রাখাইনে ব্যাপক সহিংসতা শুরু হলে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুতদের জন্য এই শরণার্থীশিবির খোলা হয়েছিল। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের কোথায় রাখা হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো তথ্যই নেই শিবিরের বাসিন্দাদের কাছে।
একটি সূত্র জানিয়েছে, রাখাইনে যেসব ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের মুক্তির জন্য ৩ কোটি কিয়াত বা ১৪ হাজার ডলার দাবি করেছে জান্তাবাহিনী। পাশাপাশি গ্রেপ্তারকৃত অন্যান্য বন্দীর ওপর আরাকান আর্মির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা অলীক অভিযোগ এনে মামলাও দায়ের করেছে।
গত ১৪ ডিসেম্বর জান্তাবাহিনীর সদস্যরা সিতওয়ে বন্দরের ৫৪ মাঝিকে গ্রেপ্তার করে কোনো কারণ ছাড়াই। তাঁদের মধ্যে পরে চারজনকে ছেড়ে দেওয়া হয় অর্থের বিনিময়ে। এমন আরও একাধিক গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেছে রাখাইনজুড়ে। স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ১৩ নভেম্বর থেকে শুরু করে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাখাইনের ১৭টি শহর থেকে অন্তত ১৭৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর আগেও শতাধিক লোককে গ্রেপ্তার করেছে জান্তাবাহিনী, যা গণনায় আসেনি।
এদিকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর নির্বিচার হামলা এবং জাতিগত সংখ্যালঘু বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিষিদ্ধ ক্লাস্টার অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ এনেছে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। সংস্থাটি আজ বৃহস্পতিবার মিয়ানমার জান্তার বিরুদ্ধে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে।
২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর এবারই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে মিয়ানমার জান্তা। চীন সীমান্তবর্তী শান রাজ্য এবং পশ্চিম রাখাইন রাজ্যে সামরিক ঘাঁটিতে জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সমন্বয়ে গঠিত স্থানীয় প্রতিরোধ জোটের ক্রমাগত আক্রমণের মুখে পড়ছে সামরিক বাহিনী। ভারত সীমান্তের কাছে মিয়ানমারের শহর খামপাতের দখল হারিয়েছে জান্তা।
এবার শান রাজ্যে চলতি মাসের শুরুতে বিমান হামলায় জান্তার বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ ক্লাস্টার বোমা ব্যবহারের অভিযোগ এনেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। সংস্থাটি এক বিবৃতিতে বলেছে, অ্যামনেস্টির অস্ত্র তদন্তকারীরা প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণ করে ক্লাস্টার বোমার সন্দেহের সপক্ষে প্রমাণ হাজির করেছে।