গাজায় মারাত্মক খাদ্য সংকটে ৬ লাখ মানুষ: জাতিসংঘ
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় প্রায় ৬ লাখ মানুষ বিপর্যয়কর ক্ষুধার সম্মুখীন হয়েছেন এবং আগামী ৬ মাসের মধ্যে সেখানে দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি রয়েছে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ। বৃহস্পতিবার (২১ ডিসেম্বর) ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি) রিপোর্টে এই তথ্য ওঠে এসেছে। তুরস্কের সংবাদমাধ্যম আনাদোলু এজেন্সি এই খবর জানিয়েছে।
আইপিসি’র ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজায় ৫ লাখ ৭৬ হাজার ৬০০ জনেরও বেশি মানুষ ‘বিপর্যয়কর ক্ষুধার’ সম্মুখীন হয়েছেন। আর তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সংকটে রয়েছেন গাজার অঞ্চলের সবাই।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি-সহ জাতিসংঘের অন্যান্য সংস্থা ও বেসরকারি সংস্থার (এনজিও)-এর তথ্যের ভিত্তিতে এই রিপোর্ট তৈরী করেছে আইপিসি।
আইপিসি একটি বহু-অংশীদার ভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বৈজ্ঞানিক মান অনুযায়ী ক্ষুধা সংকটের তীব্রতা এবং মাত্রা নির্ধারণ করতে তথ্য বিশ্লেষণ করে থাকে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘গাজার প্রায় ৫ লাখ ৭৬ হাজার ৬০০ মানষি যা মোট জনসংখ্যার ২৬ শতাংশ-তাদের খাদ্য সরবরাহ এবং সংকট মোকাবিলা করার সক্ষমতা শেষ হয়ে গেছে এবং তারা বিপর্যয়কর ক্ষুধা (আইপিসি ফেজ ৫) এবং অনাহারের সম্মুখীন হয়েছেন।’
ডব্লিউএফপির এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর সিন্ডি ম্যাককেইন বলেছেন, ‘কয়েক সপ্তাহ ধরেই আসন্ন এই বিপর্যয়ের বিষয়ে সতর্ক করে এসেছে ডব্লিউএফপি। দুঃখজনকভাবে নিরাপদ ও ধারাবাহিক সরবরাহের সুযোগ ছাড়াই আমরা সহায়তার বিষয়ে আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছি। সেখানকার পরিস্থিতি খুবই খারাপ, গাজার কেউই অনাহার থেকে নিরাপদ নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘তীব্র সংঘাত এবং সীমিত মানবিক সহায়তার প্রবেশাধিকার’ যদি বর্তমান পরিস্থিতির মতো চলতে থাকে, তবে আইপিসি ভবিষ্যদ্বাণী করছে, ‘আগামী ছয় মাসের মধ্যে সেখানে দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি রয়েছে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,ডব্লিউএফপি খাদ্য নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যেই জানিয়েছেন, সংঘাতের মধ্যে বেঁচে থাকতে গাজাবাসীরা ‘তাদের সকল সম্পদই ব্যবহার করেছে, সেখানে জীবিকা ধ্বংস হয়ে গেছে, বেকারিগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে, দোকানগুলোও খালি এবং মানুষ খাবার খুঁজে পাচ্ছে না।’
ডব্লিউএফপি কর্মীদের গাজার ফিলিস্তিনিরা জানিয়েছেন, তারা প্রায়ই পুরো দিন না খেয়ে থাকতে হয় তাদের। এমনকি অনেক প্রাপ্তবয়স্করা নিজে না খেয়ে থাকেন যাতে শিশুরা কিছু খেতে পায়।
ডব্লিউএফপির প্রধান অর্থনীতিবিদ আরিফ হোসেন বলেছেন, ‘এগুলো কেবল সংখ্যা নয়-এই উদ্বেগজনক পরিসংখ্যানগুলোর পেছনে আলাদাভাবে নারী, শিশু, এবং পুরুষরা রয়েছেন। এই সংকট নজিরবিহীন জটিলতা, মাত্রা এবং দুর্ভোগের সৃষ্টি করেছে।’
প্রতিবেদনটিতে জোর দিয়ে বলা হয়েছে, ব্যাপক মৃত্যু রোধে আরও জরুরি খাদ্য এবং বহু-খাতে সহায়তা সরবরাহ অপরিহার্য। ‘সম্প্রতি সাত দিনের যুদ্ধবিরতি দেখিয়ে দিয়েছে যে, সংঘাত বন্ধ থাকলে ডব্লিউএফপি এবং অংশীদাররা সহায়তা প্রদান করতে পারে এবং কেরেম শালোম সীমান্ত ক্রসিং পুনরায় খোলার ফলে গাজায় আরও খাদ্য ও অন্যান্য ত্রাণ সরবরাহের সুযোগ তৈরি হয়।’
এই পরিস্থিতিতে একটি মানবিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করে ম্যাককেইন বলেন, ‘আমরা শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মানুষকে অনাহারে ভুগতে দেখতে পারি না। গাজা উপত্যকায় এবং গাজার ভেতরে নিরাপদে সরবরাহ প্রবাহ পৌঁছাতে এবং বেসামরিক নাগরিকদের জীবন রক্ষাকারী সহায়তা দিতে এখনই মানবিক সহায়তার সরবরাহ করা প্রয়োজন।’
গত ১২ ডিসেম্বর ইসরায়েল গাজার ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের সরাসরি মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য গাজার একমাত্র বাণিজ্যিক ক্রসিং কেরাম শালোমে তার সীমান্ত ক্রসিং খোলার সিদ্ধান্ত নেয়। কেরাম শালোম ক্রসিংকে ফিলিস্তিনিরা কারম আবু সালেম বলে থাকেন। চলমান সংঘাত শুরু হওয়ার আগে গাজায় ৬০ শতাংশেরও বেশি সহায়তা এই টার্মিনালের মধ্য দিয়ে যেত।
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের দক্ষিণে হামাসের নজিরবিহীন হামলার পর থেকে গাজা উপত্যকায় অবিরাম বিমান ও স্থল হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস বুধবার জানিয়েছে, চলমান এ হামলায় নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা বেড়ে ২০ হাজার ছাড়িয়েছে। যাদের মধ্যে অন্তত ৮ হাজার শিশু এবং ৬ হাজার ২০০ নারী।
এছাড়া নিহতদের মধ্যে ৩১০ জন চিকিৎসক, ৩৫ জন বেসামরিক প্রতিরক্ষা কর্মী এবং ৯৭ জন সাংবাদিক রয়েছেন। ইসরায়েলি এই হামলায় হাসপাতাল, স্কুল, শরণার্থী শিবির, মসজিদ, গির্জাসহ হাজার হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে।