মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময়সীমার শেষে কোন দলের কতজন প্রার্থী রইলেন?
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবারের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের জন্য ২৬৩টি আসন রেখে বাকি আসনগুলো থেকে দলীয় প্রার্থী প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
বাকি সাইত্রিশটি আসনের মধ্যে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র জাতীয় পার্টিকে ২৬টি এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন চৌদ্দ দলীয় জোট ভুক্ত ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও জেপিকে মোট ছয়টি আসন ছেড়ে দিয়েছে দলটি।
আর বাকি পাঁচটি আসনে দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন বাতিল হয়েছে ঋণখেলাপি ও দ্বৈত নাগরিকত্ব সহ নানা অভিযোগে। তবে নির্বাচন কমিশনের ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এসব প্রার্থীরা আদালতে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন।
রোববার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে নির্বাচন কমিশনের কাছে চিঠি পাঠিয়ে নিজেদের দলীয় সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়া দলের চিঠি কমিশনে পৌঁছে দেন।
তবে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন তাদের মোট ২৮৩টি আসনে দলীয় প্রার্থীরা লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন।
“আমরা জোরদার ভাবেই নির্বাচন করবো। ২৮৩ আসনে জাতীয় পার্টি প্রার্থী দিয়েছে এবং কিছু কিছু আসনে সিনিয়র নেতা যারা নির্বাচন করছেন তাদের বিষয়ে হয়তো অন্য যারা নির্বাচন করছেন তাদের সাথে সমঝোতা হয়েছে বা হবে,” এক সংবাদ সম্মেলনে বলছিলেন তিনি।
ওদিকে নির্বাচনকে সামনে রেখে গঠিত হয়ে আলোচনায় আসা তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি) ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে (বিএনএম) কোনও আসনে ছাড় দেয়নি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এসব দল নিজেদের মতো করে নির্বাচন করছে।
আর ১৪দলীয় জোটের দল তরিকত ফেডারেশনকে আওয়ামী লীগ কোনও আসন না দেয়ায় তারা নিজ দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার কথা জানিয়েছে।
রবিবার রাতের দিকে নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানানো হয়েছে, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের পর সারা দেশের ৩০০ আসনে মোট ১৮৯৬জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিঁকে রইলেন।
জিএম কাদের ও তার স্ত্রী দু’টি আসনে
গত কয়েক দিন ধরে দফায় দফায় গোপন বৈঠক করে শেষ পর্যন্ত ২৬টি আসনের বিষয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতায় পৌঁছাতে পেরেছে সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জাতীয় পার্টির একাংশ এবং বিক্ষোভ হয়েছে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনেও।
মুজিবুল হক চুন্নু সিনিয়র নেতাদের বিষয়ে সমঝোতার কথা বললেও জাতীয় পার্টির অন্যতম সিনিয়র নেতা ও ঢাকা-৬ আসনের বর্তমান এমপি কাজী ফিরোজ রশীদের আসন থেকে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী সাঈদ খোকনকে প্রত্যাহারে রাজী হয়নি। ফলে মি. রশীদ নিজেই মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
ওদিকে জাতীয় পার্টি নিজেই রংপুর-৩ আসন থেকে প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের ছেলে ও দলের বর্তমান এমপি সাদ এরশাদের পরিবর্তে জিএম কাদেরকে সেখানে দলীয় প্রার্থী করেছে আর মি. কাদেরের স্ত্রী শেরিফা কাদের ঢাকা-১৮ আসন থেকে দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবেন।
আওয়ামী লীগ উভয় আসন থেকেই দলীয় প্রার্থী প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা-১৮ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন বর্তমান সংসদের সদস্য মোহাম্মদ হাবিব হাসান।
জিএম কাদের এবং তার দলেরই অন্যতম কো-চেয়ারম্যান সালমা ইসলাম দুজনেই ঢাকা-১৭ আসনে মনোনয়নপত্র দাখিল করে রেখেছিলেন। রোববার শেষ দিনে তারা ওই আসন থেকে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
এই আসনের বর্তমান এমপি মোহাম্মদ এ আরাফাত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্যও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে প্রার্থী হয়েছিলেন।
জাতীয় পার্টিকে যে সব আসন ছাড়লো আ.লীগ
তবে সালমা ইসলাম ঢাকা-১ আসন থেকে জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবেন বলে তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা জানিয়েছেন। তিনি ওই আসনের সাবেক এমপি।
ওই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান এমপি তথা প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান।
এছাড়া জাতীয় পার্টির বর্তমান সংসদের এমপি লিয়াকত আলী খোকা, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ এবং নাসরিন জাহান রত্না দলের মনোনয়ন পেলেও এসব আসন নিয়ে সমঝোতা না হওয়ায় তাদের নিজ নিজ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের মোকাবেলা করতে হবে।
এর বাইরে বিরোধী দলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ দলের মনোনয়ন নেননি এবং নির্বাচন কমিশনেও মনোনয়নপত্র দাখিল করেননি। এছাড়া রংপুর-১ আসনের বর্তমান এমপি মসিউর রহমান রাঙ্গা দলের মনোনয়ন পাননি।
এখন যেসব আসন জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দিয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছে সেগুলো হলো: ঠাকুরগাঁও-৩, নীলফামারী ৩ ও ৪, রংপুর ১ ও ৩, কুড়িগ্রাম ১ ও ২, গাইবান্ধা ১ ও ২, বগুড়া ২ ও ৩, সাতক্ষীরা-২, পটুয়াখালী-১, বরিশাল-৩, পিরোজপুর-৩, ময়মনসিংহ ৫ ও ৮, কিশোরগঞ্জ-৩, মানিকগঞ্জ-১, ঢাকা-১৮, হবিগঞ্জ-১, ব্রাহ্মণবাড়িয়া- ২, ফেনী-৩ এবং চট্টগ্রাম ৫ ও ৮।
আওয়ামী লীগের আরও ৬ এমপি বাদ
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগ জাসদের হাসানুল হক ইনুর কুষ্টিয়া-২ ও জাতীয় পার্টির সেলিম ওসমানের নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন শূন্য রেখে বাকি ২৯৮ টি আসনের জন্য শুরুতে দলীয় প্রার্থীদের নামের যে তালিকা ঘোষণা করেছিলো তাতে বর্তমান একাদশ সংসদের ৭১ জনের নাম ছিলো না।
কিন্তু সেই প্রার্থী তালিকার পাঁচজনের মনোনয়নপত্র ঋণখেলাপি ও দ্বৈত নাগরিকত্বের কারণে বাতিল হয়ে যায় নির্বাচন কমিশনের যাচাই বাছাইয়ের সময়।
তারা হলেন বরিশাল-৪ আসনের শাম্মী আহমেদ, ফরিদপুর -৩ আসনের শামীম হক, যশোর-৪ আসনের এনামুল হক বাবুল, কক্সবাজার -১ আসনের সালাউদ্দিন আহমেদ এবং ময়মনসিংহ-৯ আসনের মেজর জেনারেল (অব:) আব্দুস সালাম।
বাকি ২৯৩টি আসনের মধ্যে জাতীয় পার্টিকে নতুন করে ২৫টি ছাড়াও চৌদ্দ দলীয় জোটের শরিকদের জন্য পাঁচটি আসন ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ, যারা নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবেন।
এরা হলেন ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন (বরিশাল -২) এবং ফজলে হোসেন বাদশা (রাজশাহী-২) এবং জাসদের একেএম রেজাউল করিম তানসেন (বগুড়া-৪) ও মোশাররফ হোসেন (লক্ষ্মীপুর-৪)। এছাড়া জেপির আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে পিরোজপুর-২ আসন ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
ফলে সব মিলিয়ে এখন তিনশ আসনের মধ্যে জাতীয় পার্টিকে মোট ২৬টিতে, ওয়ার্কার্স পার্টিকে দুটিতে, জাসদ-কে তিনটিতে এবং জেপির আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে একটি ছেড়ে দিয়ে সেগুলোতে দলীয় প্রার্থী প্রত্যাহার করে নিয়েছে আওয়ামী লীগ।
আর পাঁচটি আসনে মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়া প্রার্থীরা আদালতের মাধ্যমে ফিরে আসতে না পারলে সেখানে স্বতন্ত্র বা অন্যদের সমর্থন দেয়া হতে পারে।
সেক্ষেত্রে কক্সবাজার-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত সালাউদ্দিন আহমেদের মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ায় কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহম্মদ ইব্রাহীম ক্ষমতাসীন দলের পরোক্ষ সমর্থন পেতে পারেন বলে আলোচনা আছে। অবশ্য ওই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন আওয়ামী লীগেরই বর্তমান সংসদের এমপি জাফর আলম।
ওদিকে নতুন করে জাতীয় পার্টির সাথে সমঝোতা হওয়ার কারণে বিদায়ী সংসদের আওয়ামী লীগ এমপি মোহাম্মদ হাবিব হাসান ছাড়াও গাইবান্ধার মাহবুব আরা গিনি, কুড়িগ্রামের আছলাম হোসেন সওদাগর এবং সম্প্রতি চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও পটুয়াখালীর উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়ে এমপি হওয়া নোমান আল মাহমুদ, শাজাহান আলম সাজু এবং আফজাল হোসেন শেষ পর্যন্ত বাদ পড়লেন।
তারা সবাই দলের প্রথম তালিকায় এবারো প্রার্থিতার জন্য মনোনয়ন পেয়েছিলেন।
ওদিকে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি এবং বর্তমানে ঢাকা-৮ আসনের এমপি রাশেদ খান মেনন বরিশাল-২ আসনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিশ্চিত হওয়ার পর বরিশাল-৩ আসন থেকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
ওই আসনটির বর্তমান এমপি জাতীয় পার্টির প্রার্থী গোলাম কিবরিয়া টিপুকেই ছেড়ে দিয়ে দলীয় প্রার্থী প্রত্যাহার করে নিয়েছে আওয়ামী লীগ।
অন্যদিকে বরিশাল-২ আসনে একাদশ সংসদে সদস্য ছিলেন আওয়ামী লীগের শাহে আলম। তবে তার বদলে এবার অন্য একজনকে মনোনয়ন দিয়েছিলো আওয়ামী লীগ।
আর ঢাকা-৮ আসনে এবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম।
ওদিকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে রাজধানী ঢাকার পনেরটি আসন থেকে সাতাশ জন প্রার্থী তাদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।