গাজা সংকটে বিশ্ব বিভক্ত
দুই মাস পেরিয়ে গাজার যুদ্ধ গড়িয়েছে তৃতীয় মাসে। এ যুদ্ধ জর্ডান নদী ও ভূমধ্যসাগরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে নিয়ে এসেছে শুধু মৃত্যু আর ধ্বংসযজ্ঞ। ইসরায়েলি হামলায় ইতিমধ্যে ১৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যার মধ্যে অন্তত ৭ হাজার শিশু। হাসপাতাল, স্কুল ও আশ্রয়শিবিরগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করেও হামলা হচ্ছে। গাজায় যুদ্ধকে কেন্দ্র করে গভীর হয়েছে কূটনৈতিক বিরোধ। গত দুই মাসে জাতিসংঘে ভোটাভুটি, জনসাধারণের মন্তব্য এবং বড় কূটনৈতিক পদক্ষেপ স্পষ্ট করেছে, এ যুদ্ধ নিয়ে বিশ্ব কতটা বিভাজিত।
যুদ্ধবিরতি, দখলদার ও অবরোধ
যুদ্ধ নিয়ে কথা হলে ভাষা বা শব্দের ব্যবহার বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিবাদের বিষয় হয়ে ওঠে। সহিংসতা ও শত্রুতার সমাপ্তি বর্ণনা করতে ‘যুদ্ধবিরতি’ (সিসফায়ার) বা ‘মানবিক কারণে যুদ্ধবিরতি’ (হিউম্যানিটারিয়ান পজ) শব্দগুলো ব্যবহার নিয়েও গোটা বিশ্ব এক নয়। বিভিন্ন দেশ যখন যুদ্ধবিরতি বলে, তখন ইসরায়েলের মিত্ররা গাজায় বিরতির (পজ) আহ্বান জানায়।
জাতিসংঘের মত হলো, যুদ্ধবিরতি (সিসফায়ার) হচ্ছে ‘বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে সব ধরনের সহিংসতা বন্ধ করা।’ অন্যদিক মানবিক কারণে বিরতি হলো ‘মানবিক উদ্দেশে শত্রুতা সাময়িক বন্ধ করা।’ এ ছাড়া ‘বিরতি’ (পজ) বা যুদ্ধবিরতি (ট্রুস) হলো একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার জন্য লড়াই অস্থায়ীভাবে স্থগিত রাখা।
আল জাজিরা জাতিসংঘে বিশ্ব নেতাদের বক্তৃতা বিশ্লেষণ করে দেখেছে, ৫৫ শতাংশ দেশ গাজায় ‘যুদ্ধবিরতির’ (সিসফায়ার) আহ্বান জানিয়েছে। এর মধ্যে আর্জেন্টিনা, বেলজিয়াম, চীন, গায়ানা, তুরস্ক ও ভেনেজুয়েলা রয়েছে। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ ২৩ শতাংশ দেশ ‘মানবিক কারণে যুদ্ধবিরতির’ আহ্বান জানিয়েছে। কিছু দেশ বিরতির (পজ) বিকল্প শব্দগুলো ব্যবহার করেছে—যেমন ‘সমাপ্তি’ (সিসেশান), ‘স্থগিত’ (হল্ট) বা ‘বিরাম’ (রেসপাইট)। ২২ দেশ এ বিষয়ে জাতিসংঘে কিছুই বলেনি।
ইসরায়েলকে দখলদার বলা হবে কি না, গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের অবরোধ এবং পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে বসতি স্থাপনের বিষয়ে কথা বলবেন কি না তা নিয়েও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে বিভিন্ন দেশ।
দেশগুলোর মধ্যে ৪৬ শতাংশ ইসরায়েলকে ‘দখলদার’ অথবা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডকে ‘অধিকৃত’ বলছে। যেখানে ৫৪ শতাংশ এ শব্দগুলো ব্যবহার করছে না। ইসরায়েলের গাজায় অবরোধের কথা বলেছে শুধু ২৩ শতাংশ দেশ। দেশগুলো ‘অবরোধ’ বা ‘উন্মুক্ত কারাগার’ শব্দের প্রয়োগ করেছে এবং ৩০ শতাংশ দেশ ইসরায়েলি বসতি সম্পর্কে কথা বলেছে।
দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান
এই অঞ্চলে শান্তি অর্জনের উপায় হিসেবে দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের বিষয়ে এতটা বিভক্ত নয় দেশগুলো। ৯৫ শতাংশ দেশই দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান বা ইসরায়েলের মতো স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের আহ্বান জানিয়েছে। মাত্র ছয়টি দেশ এ বিষয়ে আহ্বান জানায়নি।
ইসরায়েলের পক্ষে-বিপক্ষে
যুদ্ধের সময় বেশ কয়েকটি দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক সম্পূর্ণ ছিন্ন করেছে। বেলিজ, বলিভিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থগিত করেছে। এদিকে বাহরাইন, চাদ, চিলি, কলম্বিয়া, হন্ডুরাস, জর্ডান ও তুরস্ক তাদের রাষ্ট্রদূত ইসরায়েল থেকে প্রত্যাহার করেছে। স্পেনের বার্সেলোনার মতো কিছু শহরও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থগিত করেছে। তবে ইসরায়েলকে জোরালো সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
জাতিসংঘের প্রস্তাবে ভোট
গাজায় যুদ্ধ চলাকালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাঁচটি প্রস্তাব নিয়ে ভোটাভুটি হয়েছে। দেশগুলোর সিদ্ধান্তহীনতা ও মতবিরোধের কারণে চারটিই পাস করতে ব্যর্থ হয়েছে। গত ১৬ অক্টোবর রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন খসড়ার বিরুদ্ধে ফ্রান্স, জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র ভোট দেয়। এই খসড়ায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির (সিসফায়ার) আহ্বান জানানো হয়। দেশগুলোর সমালোচনা ছিল খসড়াটিতে হামাসের নাম বা নিন্দা করা হয়নি।
১৮ অক্টোবর ব্রাজিলের নেতৃত্বাধীন খসড়ায় হামাসের নিন্দা করা হয় এবং মানবিক কারণে যুদ্ধবিরতির কথা বলা হয়। তবে যুক্তরাষ্ট্র এতে ভেটো দেয়। দেশটি কারণ দেখায়, প্রস্তাবে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের কথা বলা হয়নি।
রাশিয়া ২৫ অক্টোবর আরেকটি খসড়া প্রস্তাব করে, যেখানে মানবিক কারণে যুদ্ধবিরতি এবং হামাসের হাতে বন্দীদের মুক্তির আহ্বান জানানো হয়। তবে প্রস্তাবে হামাসের নিন্দা করা হয়নি। পক্ষে ভোট দেয় মাত্র চার সদস্য।
যুক্তরাষ্ট্রও ২৫ অক্টোবর একটি খসড়া প্রস্তাবে নেতৃত্ব দেয়, সেখানে যুদ্ধবিরতির পরিবর্তে মানবিক কারণে বিরতির আহ্বান জানানো হয়। ১০ সদস্য এটির পক্ষে ভোট দিলেও স্থায়ী সদস্য রাশিয়া ও চীন এই প্রস্তাবে ভেটো দেয়। ১৫ নভেম্বর গাজায় মানবিক কারণে যুদ্ধবিরতি এবং ত্রাণ বিতরণের আহ্বান জানিয়ে মাল্টার নেতৃত্বাধীন একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও রাশিয়া ভোটদানে বিরত থাকে। ১২টি দেশ পক্ষে ভোট দেয়।