ফিলিস্তিনি বন্দীদের ওপর ইসরায়েলে নির্মম নির্যাতনের বর্ণনা দিলেন সদ্য মুক্তিপ্রাপ্তরা
ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায় জিম্মি ও বন্দী বিনিময় করছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস। সেই চুক্তির আওতায় জিম্মিদের মুক্তির বিপরীতে ইসরায়েলের বিভিন্ন কারাগারে বন্দী বেশ কয়েকজন ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। মুক্তি পাওয়া ফিলিস্তিনিদের বেশ কয়েকজন অভিযোগ করেছেন, মুক্তি দেওয়ার আগে তাদের কারাগারে পেটানো হয়েছে, নির্যাতন করা হয়েছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্দীরা অভিযোগ করেছেন, ইসরায়েলি কারারক্ষীরা তাঁদের পিটিয়েছে, কুকুর লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাঁদের কাপড়, খাবার এবং কম্বল ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। একজন নারী বন্দী অভিযোগ করেছেন, তাঁকে ধর্ষণ করার হুমকি দিয়েছিল ইসরায়েলি কারারক্ষীরা। এর বাইরেও সেলে বন্দী অবস্থায় ভেতরে টিয়ার শেল ছুড়ে মারা হয়েছে।
বিবিসি এমন অভিযোগের সত্যতা যাচাই করতে সদ্য মুক্তি পাওয়া অন্তত ছয়জন ফিলিস্তিনর সঙ্গে কথা বলেছে। কথা বলার পাশাপাশি ওই সব বন্দী বিবিসিকে তাঁদের গায়ে ইসরায়েলি বাহিনীর নির্যাতনের বিভিন্ন চিহ্নও দেখিয়েছেন। ওই ছয়জন জানিয়েছেন, কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়ার আগেও তাঁদের পেটানো হয়েছে। তবে ইসরায়েলি কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তাঁরা বন্দীদের সঙ্গে আইন অনুসারেই আচরণ করেছে।
ফিলিস্তিনি অধিকার গোষ্ঠী প্যালেস্টাইনিয়ান প্রিজনার্স সোসাইটি জানিয়েছে, মারধরের পাশাপাশি ইসরায়েলি কারারক্ষীরা ফিলিস্তিনি বন্দীদের হ্যান্ডকাফ পরিয়ে তাঁদের ওপর মূত্র বিসর্জন করেছে। সংগঠনটি দাবি করেছে, ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরুর পর ইসরায়েলি কারাগারে ইসরায়েলি নির্যাতনে অন্তত ছয় ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
নির্যাতিত বন্দীদের একজন হলেন ১৮ বছরের তরুণ মোহাম্মদ নাজ্জাল। তাঁকে গত সপ্তাহে মুক্তি দেওয়া হয়েছে ইসরায়েলি কারাগার নাফহা থেকে। তাঁকে কোনো ধরনের অভিযোগ ছাড়াই গত আগস্ট থেকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। ইসরায়েলি কারারক্ষীদের নির্যাতনে নাজ্জালের দুই হাতই ভেঙে গেছে। বিবিসি নাজ্জালের ভাঙা হাতের এক্স-রে রিপোর্ট যুক্তরাজ্যের চিকিৎসকদের দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে নিশ্চিত হয়েছে। জিম্মি ও বন্দিবিনিয়মের সঙ্গে যুক্ত আন্তর্জাতিক রেডক্রসও নাজ্জালের হাত ভাঙার বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করেছে।
নাজ্জাল বলেছেন, মুক্তির কয়েক দিন আগে ইসরায়েলি কারারক্ষীরা কারাগারে ফিলিস্তিনিদের নাম ধরে ধরে ডেকে তাদের নানাভাবে উসকে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কোনোভাবেই বন্দীদের কাছ থেকে সাড়া না পাওয়ায় কারারক্ষীরা বন্দীদের পেটানো শুরু করে কোনো কারণ ছাড়াই। সেই পিটুনিতেই নাজ্জালের দুই হাত ভেঙে যায়। নাজ্জাল কারাগারে আর তাঁর হাত ব্যবহার করতে পারেননি। তবে বাধ্য হয়েই শৌচকার্যের সময় বহু কষ্টে তিনি তাঁর হাত ব্যবহার করেছেন।
মোহাম্মদ নাজ্জাল আরও জানান, গত ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে হামলার পর থেকেই ইসরায়েলি কারারক্ষীদের আচরণ বদলে যায়। তাঁরা ক্রমেই সহিংস আচরণ করতে থাকে ফিলিস্তিনি বন্দীদের সঙ্গে। নাজ্জাল জানান, কোনো কারণ ছাড়াই কারারক্ষীরা ফিলিস্তিনি বন্দীদের কিল, ঘুষি ও লাথি মারত। এমনকি তাদের মুখেও লাথি মারত তারা।
ফিলিস্তিনি ওই তরুণ আরও জানান, কারারক্ষীরা মাঝেমধ্যেই কুকুর নিয়ে আসত এবং সেগুলো ফিলিস্তিনি বন্দীদের ওপর ছেড়ে দিত। অবশ্য কুকুরগুলোর মুখে মুখোশ পরানো থাকত। ফলে সেগুলো কামড়াতে না পারলেও তীব্র আক্রোশে বন্দীদের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত করত এবং একই সময়ে কারারক্ষীরা নির্বিচারে বেদম প্রহার করত বন্দীদের। ইসরায়েলিদের মারধরের চিহ্ন এখনো রয়ে গেছে নাজ্জালের শরীরে। বিবিসির প্রতিবেদক নিজ চোখে সেগুলো প্রত্যক্ষ করেছেন।
অন্য পাঁচ মুক্ত ফিলিস্তিনিও প্রায় একই রকমের নির্যাতনের কথা বলেছেন বিবিসিকে। তাঁদের অভিযোগ, হামাস ইসরায়েলে হামলা চালানোর প্রতিশোধ হিসেবে কারাবন্দী ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতন চালানো হতো।
প্যালেস্টাইনিয়ান প্রিজনার্স সোসাইটির প্রধান আবদুল্লাহ আল-জাগাহারি বলেন, অনেক ফিলিস্তিনি বন্দীই এমন নির্যাতন প্রত্যক্ষ করেছেন। তাঁদের কেউ কেউ নিজেই ইসরায়েলি কারারক্ষীদের নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন আবার কেউ কেউ দেখেছেন তাঁদের সহবন্দীকে কীভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে। আবদুল্লাহ আল-জাগাহারির বন্দীদের বরাত দিয়ে বলেন, হ্যান্ডকাফ পরানো অবস্থা ইসরায়েলি কারারক্ষীরা একাধিকবার একাধিক বন্দীর ওপর প্রস্রাব করে দিয়েছে।