যেসব ইহুদিদের অবস্থান ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিপক্ষে ও ফিলিস্তিনের পক্ষে

সাময়িকী ডেস্ক
সাময়িকী ডেস্ক
8 মিনিটে পড়ুন

যেসব ইহুদিদের অবস্থান ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিপক্ষে ও ফিলিস্তিনের পক্ষে

ইহুদিদের জন্য নিজস্ব আলাদা ভূখণ্ডের ধারণা থেকে জন্ম হয়েছিল ইসরায়েল রাষ্ট্রের।

ইহুদিদের অস্তিত্ব আর অধিকারের প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলের জন্ম হলেও এমন অনেক ইহুদি আছেন যারা ইসরায়েল রাষ্ট্রের সমর্থন করেন না।

আর এর পেছনে রয়েছে বেশ কিছু কারণ।

জায়নবাদ বনাম জায়নবাদ বিরোধিতা

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে ইহুদি বিরোধিতা প্রতিরোধ করা এবং ‘ফিলিস্তিন‘ ভূখণ্ডে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শুরু হয়েছিল এক ইহুদিবাদ আন্দোলনের যেটা জায়োনিসম বা জায়নবাদ হিসেবে পরিচিত।

- বিজ্ঞাপন -

যদিও ইহুদিবাদ আর জায়নবাদ বিষয়টি এক নয়। হিব্রু বাইবেলে “জিওন” শব্দটি দিয়ে জেরুজালেমকে বোঝানো হয়। আর জায়নবাদ মূলত ইসরায়েল রাষ্ট্রের পক্ষে অবস্থান নির্দেশ করে। বর্তমানে ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের সুরক্ষা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে যারা বিশ্বাসী তাদেরকে জায়োনিস্ট বলা হয়। অন্য ধর্মের কেউ এই ধারণায় বিশ্বাস করলে সেও জায়োনিস্ট।

অপরদিকে ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্বের বিরোধিতা যারা করেন তাদেরকে অ্যান্টি-জায়োনিস্ট বলা হয়। তারা ইসরায়লি দখলদারির বিরোধিতা করেন এবং দেশটির সরকারের নীতির সমালোচনা করেন। অ্যান্টি জায়োনিস্টদের অনেক সময় ইহুদি-বিরোধী হিসেবেও দেখা হয়, বিশেষত ইসরায়েল জাতীয়তাবাদ ও রাষ্ট্রের সমর্থনে যারা থাকেন তারা অনেক সময় সেভাবে দেখাতে চান।

যদিও ইহুদি-বিদ্বেষ বা ইহুদি-বিরোধী ঘৃণা ছড়ানোর বিষয়টি অ্যান্টি-সেমিটিসম হিসেবে পরিচিত। অ্যান্টি-সেমিটিসম সরাসরি ইহুদি-বিদ্বেষ আর অ্যাটি-জায়োনিসম হচ্ছে ইসরায়েল-রাষ্ট্রের বিরোধিতা। ইহুদি বিদ্বেষের প্রেক্ষাপটেই জায়নবাদ আন্দোলন শুরু হয়েছিল।

অনেকে মনে করেন ইসরায়েলের সরকার তাদের সমালোচনাকারীদের ইহুদি-বিদ্বেষী বা অ্যান্টি-সেমিটিক হিসেবে দেখাতে চান। যদিও রাষ্ট্রের ধারণার বিরোধিতা আর ইহুদি ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ এক বিষয় না। জায়নবাদ বা ইহুদি রাষ্ট্রের ধারণায় বিশ্বাসী এমন ইহুদিও আছে যারা সরকারের দখলদারির নীতি সমর্থন করে না।

যেসব ইহুদিদের অবস্থান ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিপক্ষে ও ফিলিস্তিনের পক্ষে
এমন অনেক ইহুদি আছেন যাদের অবস্থান ইহুদি রাষ্ট্রের বিপক্ষে

কেন বহু ইহুদি ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিপক্ষে?

ইহুদিদের মধ্যেই ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেন তেমন চিন্তাধারার অনেকে আছেন। এর মাঝে যেমন বামপন্থীরা রয়েছেন তেমন আছেন কট্টর ইহুদি মতাদর্শে বিশ্বাসীরাও।

- বিজ্ঞাপন -

যেমন ইসরায়েল-গাজার সাম্প্রতিক যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ১৮ই অক্টোবর আমেরিকার ক্যাপিটল হিলে ফিলিস্তিনিদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে শত শত ইহুদি বিক্ষোভ করেন। সেখানে কিছু মানুষ ফিলিস্তিনের পতাকা উড়িয়ে ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে এমন অভিযোগও তোলে। সেখান থেকে আমেরিকার পুলিশ সেদিন কমপক্ষে ৩০০ জনকে আটকও করে।

এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল মূলত ‘জিউইশ ভয়েজ ফর পিস’ বা ‘শান্তির জন্য ইহুদি কণ্ঠ’ নামের একটি জায়নবাদ-বিরোধী সংগঠন।

জায়নবাদ যেভাবে ফিলিস্তিনের মানুষের ক্ষতির কারণ হয়েছে সেটার বিপক্ষে অবস্থান তাদের। সংগঠনটির ওয়েবসাইটে তারা উল্লেখ করে যে জায়নবাদ আসলে ইহুদিদের মাঝেও বিদ্বেষ ও বৈষম্য সৃষ্টি করে।

- বিজ্ঞাপন -
যেসব ইহুদিদের অবস্থান ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিপক্ষে ও ফিলিস্তিনের পক্ষে
ফিলিস্তিনে যুদ্ধবিরতির আহবান জানিয়ে ১৮ই অক্টোবর আমেরিকার ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল বিল্ডিং-এ অবস্থান নিয়েছিল একদল ইহুদি

যারা জায়নবাদ বিরোধী তাদের মূল বক্তব্য হিংসা-বিদ্বেষ বা হানাহানির বিপক্ষে। ইসরায়েল সরকারের ফিলিস্তিনি ভূমি দখলকেও ভালো চোখে দেখে না তারা।

তারা মনে করে জায়নবাদের ধারণা এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করে যাতে মনে হয় যারা ইসরায়েলের সমালোচনা করে তারা ইহুদি ধর্মের প্রতি অনুগত না বা তারা ইহুদি-বিরোধী। যদিও ইহুদিদের মধ্যে ইসরায়েল রাষ্ট্রের পক্ষের দিকটাই বেশি।

বামপন্থী ছাড়াও অনেক অতি কট্টরপন্থী ইহুদিরাও ইসরায়েল রাষ্ট্রের ধারণার সাথে একমত নন। বিশেষত হারেদি গোষ্ঠীরা এর মধ্যে পড়ে যারা কঠোরভাবে ইহুদি ধর্মের রীতিনীতি পালন করেন।

কট্টর ইহুদিদের মধ্যে কিছু অংশ আধুনিক সমাজব্যবস্থা অনেকটা গ্রহণ করলেও অতি-কট্টর বা আলট্রা-অর্থোডক্স ইহুদিরা পুরোপুরি আদি-ধর্মের অনুসারী।

তেমন অতি-কট্টর এবং জায়নবাদ-বিরোধী একটি সংগঠন ‘নেতুরেই কার্টা’। ১৯৩৮ সালে গঠন হওয়া এই সংগঠনটি আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি বিস্তৃত হলেও ইসরায়েল, যুক্তরাজ্য ও জার্মানিতেও তারা সক্রিয়।

তাদের ফেসবুক পাতায় গেলেও দেখা যায় প্রতিনিয়তই তারা ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এবং ফিলিস্তিনিদের পক্ষে রাস্তায় প্রতিবাদে নামছেন। তাদের হাতে থাকে ফিলিস্তিনের পতাকা, আর ইসরায়েলি পতাকার ছবিতে লাল দাগ দিয়ে কেটে দেয়া থাকে।

যেসব ইহুদিদের অবস্থান ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিপক্ষে ও ফিলিস্তিনের পক্ষে
ইসরায়েল-বিরোধী কট্টর ইহুদিদের সংগঠন নেতুরেই কার্টা ক্রমাগত প্রতিবাদ করছেন ফিলিস্তিনের পক্ষে। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহ্যাটনে ৯ই নভেম্বরের ছবি

১০ই নভেম্বরে নিউইয়র্ক থেকে পোস্ট করা একটি ভিডিওতে তাদের একজন র‍্যাবাইকে (ধর্মযাজক) ভাষণ দিতে দেখা যায়। ইসরোয়েল ডোভিড ওয়াইস নামে সেই র‍্যাবাই বর্ণনা করেন ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইহুদি ও মুসলিমরা শান্তিপূর্ণভাবেই বাস করতো যেটায় ব্যাঘাত ঘটিয়েছে জায়নবাদ।

জায়নবাদীরা রাজনৈতিক স্বার্থে ইহুদিদের ধর্মের অপব্যবহার ঘটাচ্ছে এবং ঘৃণা ছড়াচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

তাঁর সাথে কথাও হয় বিবিসির এবং ইহুদি ধর্ম জুডাইসমের বেশ কিছু বিষয় ব্যাখ্যা করেন তিনি।

“আমাদের দুই হাজার বছর আগে নির্বাসিত করা হয়েছিল ও রাজা সলোমনের ভবিষ্যতবাণীর মধ্য দিয়ে আমাদের সৃষ্টিকর্তা পরিষ্কারভাবে নির্দেশ দিয়েছেন যে ইহুদি রাজ্য বা সার্বভৌমত্ব পুন:প্রতিষ্ঠা আমাদের জন্য নিষিদ্ধ। সেই পবিত্র ভূমিতে (জেরুসালেম) গণহারে ফিরতে আমাদের নিষেধ করা হয়েছে এবং আমরা যেই দেশেই বাস করি সেখানকার অনুগত নাগরিক হয়ে থাকতে হবে,” বলছিলেন তিনি।

যেসব ইহুদিদের অবস্থান ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিপক্ষে ও ফিলিস্তিনের পক্ষে
র‍্যাবাই ইসরোয়েল ডোভিড ওয়াইস বিবিসিকে ব্যাখ্যা করেন তাঁদের বিশ্বাস সম্পর্কে

র‍্যাবাই ওয়াইস তাদের ধর্মগ্রন্থ ‘তোরাহ’র (যেটাকে মুসলমানরা তাওরাত নামে চেনে) উল্লেখ করে বলেন সেই নির্বাসন থেকে ইহুদিদের ফেরত যেতে নিষেধ করা হয়েছে। ইহুদিদের নিজস্ব রাষ্ট্র এবং রাজত্ব আসবে তাদের ‘মেসিয়াহ’র আগমনের সাথে যিনি তাদের ভূমিকে শৃঙ্খলমুক্ত করবেন এবং ঈশ্বরই তাদের আবাস প্রতিষ্ঠা করবেন।

মেসিয়াহ বলতে কেমব্রিজ ডিকশনারি অনুযায়ী ইহুদিদের জন্য রাজা বোঝানো হয় যাকে সৃষ্টিকর্তা পাঠাবেন। আবার খ্রিস্টানদের জন্য মেসিয়াহ হচ্ছে যীশুখ্রিস্ট যিনি মুসলমানদের কাছে নবী ঈসা (আ) নামে পরিচিত।

জায়নবাদ-বিরোধী কট্টর ইহুদিদের যুক্তি হল যে ‘মেসিয়াহ’র আগমনের আগেই নিজেরা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার কিছু নেই।

ইহুদি ধর্ম কখনো অন্যের ক্ষতি বা রক্তপাতের সমর্থন করে না এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কথা বারবার উঠে আসে র‍্যাবাই ওয়ায়েসের কথায়। মাত্র দেড়শো বছর আগে আসা জায়নবাদ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে – সেটি একটি রাজনৈতিক অবস্থান, যেটা ধর্ম নয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।

যেসব ইহুদিদের অবস্থান ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিপক্ষে ও ফিলিস্তিনের পক্ষে
লন্ডনে হারেদি ইহুদিদের সংগঠন নেতুরেই কার্টার সদস্যদের প্রতিবাদ। ১৪ই অক্টোবর ২০২৩

অবশ্য এমন মতাদর্শ বেশিরভাগ ইহুদিরাই ভালো নজরে দেখেন না। এমনকি ইহুদিরা যে জায়নবাদ-বিরোধী হতে পারে এমন চিন্তাও অনেকে করতে পারেন না।

যেমন স্কটল্যান্ডের ইহুদি কমিউনিটির একজন রিপ্রেজেন্টেটিভ ও গারনেট হিল সিনাগগের চেয়ার সুজান সেইগেল বিবিসিকে বলেন তিনি তেমন জায়নবাদ-বিরোধী ইহুদি দেখেননি এবং ইহুদিরা সাধারণত প্রায় সবাই ইসরায়েলের পক্ষেই বিশ্বাসী।

তবে মিঃ ওয়াইস মনে করেন সংশোধিত বা পরিবর্তিত জুডাইসম এবং এর সাথে বর্তমান ইহুদি রাষ্ট্রের ধারণা অতি ধার্মিক ইহুদিরা সমর্থন করতে পারেন না।

এমন কট্টর ইহুদিরা অবশ্য মূলধারার থেকে আলাদাই থাকেন এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধর্ম পালনের দিকেই মনোযোগ দেন। ইসরায়েলে এমন কমিউনিটি যারা আছেন যারা ইসরায়েলের পুরো সমাজব্যবস্থা থেকেও কিছুটা বিচ্ছিন্ন। তাদের নিজস্ব ধর্মভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা অনুসরণ করে এবং আধুনিক জীবন আচার পরিহার করে থাকে।

যেসব ইহুদিদের অবস্থান ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিপক্ষে ও ফিলিস্তিনের পক্ষে
৬ই নভেম্বর কানাডার টরনটোতে র‍্যালির ছবি পোস্ট করে নেতুরেই কার্টা

যেমন র‍্যাবাই ওয়াইস বলছিলেন বর্তমানে ইহুদি ধর্মকে যেভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে সেটা তারা মানতে পারেন না। বর্তমানে ইহুদিদের পোশাকআশাক বা শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মের ছাপ নেই এবং তাদের হিব্রু ভাষাও আধুনিকে রূপান্তর করা হয়েছে বলেন তিনি।

ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করে তিনি উল্লেখ করেন ইসরায়েলের যে ১৪০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে সেটাও আগ্রাসনেরই ফল এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার একমাত্র উপায় আগ্রাসন বন্ধ করা।

তাদের অবস্থানকে সাধারণত অন্যান্যরা ইহুদি-বিদ্বেষ (অ্যান্টি-সেমিটিক) হিসেবে উল্লেখ করেন।

এর বিপরীতে মিঃ ওয়াইস মনে করেন জায়নবাদ (রাষ্ট্রের আন্দোলন) ও জুডাইসম (ইহুদি ধর্ম) পরস্পরবিরোধী এবং “জায়নবাদই আসলে ইহুদি-বিদ্বেষ।”

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!