হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ: দুই পক্ষের জন্যই বদলে দিয়েছে সব
হামাসের হামলার পর ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় শুরু হওয়া ইসরায়েলের পাল্টা হামলায় গত এক মাসে দুই পক্ষের জীবনই বিপর্যস্ত। ইসরায়েলের সীমান্তবর্তী জনপদে হামাসের ৭ অক্টোবরের অতর্কিত হামলায় এক হাজার ৪০০ ইসরায়েলি নিহত হয়। অন্যদিকে ইসরায়েলের প্রতিশোধমূলক হামলায় গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত সাড়ে ৯ হাজার ফিলিস্তিনির প্রাণ গেছে, যার প্রায় অর্ধেক শিশু। ইসরায়েল পানি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ায় অবরুদ্ধ গাজার পরিস্থিতি হয়ে পড়ে দুর্বিষহ।
বহুল পঠিত ফিলিস্তিনি দৈনিক আল কুদস লিখেছে, ‘গাজা হাজার হাজার নির্দোষ মানুষের কবরস্থানে পরিণত হয়েছে।’
অন্যদিকে বামপন্থী ইসরায়েলি দৈনিক হারেত্জ চলতি সপ্তাহে লিখেছে, ‘এটা যে সত্যিই নতুন বাস্তবতা তা চিমটি কেটে নিশ্চিত হতে হবে বলে মনে হচ্ছে। যুদ্ধের মাধ্যমে ঘটা এই পরিবর্তনটি সর্বাত্মক প্রাণহানি, ক্ষয়ক্ষতি, উদ্বেগ, দেশের আলোচ্যসূচি এবং পুরনো রাজনৈতিক নিয়মনীতি সম্ভাব্য সব দিক থেকেই পুরোপুরিই বদলে গেছে।’
বিস্ফোরক পরিস্থিতি
ইসরায়েল-গাজা সংঘাতের ফলে সম্ভাব্য আঞ্চলিক সংঘাতের শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
হামাস ও হিজবুল্লাহর মিত্র ইরান সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, এই অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে একটি বিস্ফোরক পরিস্থিতিতে রূপ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে।
মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে পেন্টাগনের একজন মুখপাত্রও অনুরূপ কথা বলেছেন। তাঁর মতে, ইরানের হুমকি কাঠামোর সব শক্তি এমনভাবে তাদের আক্রমণ বাড়িয়েছে, যা এই অঞ্চলকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেবে।
মার্কিন সামরিক উপদেষ্টারা এরই মধ্যে ইসরায়েলে গেছেন।
এ ছাড়া দুটি মার্কিন নৌবহরও পূর্ব ভূমধ্যসাগরে মোতায়েন করা হয়েছে। উত্তেজনা বাড়ায় লেবাননের সঙ্গে উত্তর সীমান্তেও সতর্কাবস্থায় রয়েছে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী।
প্রায় এক মাসের নীরবতা ভেঙে গত শুক্রবার হিজবুল্লাহপ্রধান হাসান নাসরাল্লাহ বলেছেন, লেবানন সীমান্তে ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাত বাড়ার জন্য ‘সব বিকল্প’ খোলা রয়েছে। এ সময় যুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দোষারোপ করেন তিনি।
তবে পেন্টাগনের মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল প্যাট্রিক রাইডার বলেন, হিজবুল্লাহ যুদ্ধের মাত্রা বাড়াবে বলে তার মনে হয়নি।
বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘একটি বৃহত্তর আঞ্চলিক সংঘাত থামিয়ে দেওয়া গেছে।’
তবে এর বিপরীত মত মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক ইসরায়েলি বিশেষজ্ঞ আভি মেলামান্দের। তাঁর ধারণা, হিজবুল্লাহ এ পর্যন্ত বড় কিছু না করলেও এখনো এই অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়িয়ে দিতে পারে। বার্তা সংস্থা এএফপিকে আভি মেলামান্দ বলেন, ‘তাদের সামরিক সক্ষমতা হামাসের চেয়ে দশ গুণ বেশি। এটি ইসরায়েল রাষ্ট্রের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে।’
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, তারা পশ্চিম তীর ও গাজায় যেকোনো তীব্র সংঘাতের পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। ইসরায়েল একসময় নিজেদের সামরিক ও গোয়েন্দা দক্ষতার জন্য প্রশংসা কুড়িয়েছিল। কিন্তু ৭ অক্টোবরের হামলার কারণে তাদের সেই গর্ব অনেকটাই খর্ব হয়ে গেছে।
হামাসের অনুকরণে হিজবুল্লাহও ইসরায়েলে অনুপ্রবেশ করে হত্যা, গণহত্যা চালাবে এই শঙ্কায় আছেন ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর রিজার্ভ লেফটেন্যান্ট কর্নেল সরিত জেহাভি। তিন সন্তানের মা জেহাভি বলেন, ‘আমি ঘুমাই না।’
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় গাজার বাসিন্দা ওমর আশুর বয়স ছিল আট বছর। জাতিসংঘের হিসাব মতে, ১৯৪৮ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় প্রায় সাত লাখ ৬০ হাজার ফিলিস্তিনি আরবকে জোর করে নিজেদের ভূখণ্ড থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। ওই ঘটনাকে ফিলিস্তিনিরা ‘নাকবা’ বা বিপর্যয় বলে থাকে। সেই বিষয়টি উল্লেখ করে ওমর আশু আশঙ্কা প্রকাশ করেন, এবারের সহিংসতা ‘দ্বিতীয় নাকবা’র দিকে নিয়ে যেতে পারে।
ইসরায়েল ও হামাস দুই পক্ষই যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছে। সর্বশেষ শনিবার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, ‘যুদ্ধবিরতির আহ্বান মানে ইসরায়েলকে হামাসের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বলা।’
অন্যদিকে হামাসের মুখপাত্র আবু ওবেদার অঙ্গীকার : ‘গাজা শত্রুদের কবরস্থান ও ভাগাড়ে পরিণত হবে।’
সূত্র : এএফপি