গাজায় চলমান সংঘাতের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র দায়ী : হেজবুল্লাহ প্রধান
গাজায় চলমান সংঘাত ও বেসামরিক নাগরিক মারা যাওয়ার পেছনে যুক্তরাষ্ট্র দায়ী এবং গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা চলতে থাকলে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে মন্তব্য করেছেন লেবাননের শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী হেজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরাল্লাহ।
সাতই অক্টোবর হামাস ও ইসরায়েলি বাহিনীর সংঘাত শুরু হওয়ার পর এই প্রথমবার বক্তব্য রাখলেন তিনি। ধারনা করা হচ্ছিল এই বক্তব্যে হেজবুল্লাহর পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে ইঙ্গিত দিবেন তিনি। তবে হেজবুল্লাহ ইসরায়েলি বাহিনীর সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়াবে কিনা, সে বিষয়ে পরিষ্কার করে কিছু জানাননি তিনি।
হাসান নাসরাল্লাহ তার বক্তব্য শুরু করেন ইসরায়েলি বাহিনীর সাথে যুদ্ধে ‘শহীদ’ হওয়া হেজবুল্লাহ সদস্য ও ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে।
সাতই অক্টোবর ইসরায়েলের ভেতরে হামাস যোদ্ধাদের হামলারও প্রশংসা করেন তিনি। তিনি অভিযোগ তোলেন গাজায় চলমান সংঘাতের দায় পুরোপুরি যুক্তরাষ্ট্রের এবং ইসরায়েল এখানে নির্বাহী মাত্র।
হেজবুল্লাহ প্রধান কোথা থেকে এই বক্তব্য দিয়েছেন তা জানা যায়নি। তবে লেবাননের রাজধানী বেইরুত সহ আরো কিছু শহরে তার বক্তব্যের সরাসরি সম্প্রচার দেখার জন্য রাস্তায় জড়ো হয় হাজার হাজার মানুষ।
হাসান নাসরাল্লাহ সম্পর্কে যা জানা যায়
১৯৯২ সাল থেকে হেজবুল্লাহর শীর্ষ নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা হাসান নাসরুল্লাহ হেজবোল্লাহকে সশস্ত্র বাহিনী হিসেবে উন্নত করার পাশাপাশি এই গোষ্ঠীটিকে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে পরিণত করতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
ইরানের শীর্ষ নেতা আয়াতোল্লাহ আলি খামেনির সাথে হাসান নাসরাল্লাহর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ইরানের সাবেক শীর্ষ নেতা আয়াতোল্লাহ রুহুল্লা খোমেনি ১৯৮১ সালে নিজের ব্যক্তিগত প্রতিনিধি হিসেবে হাসান নাসরাল্লাহকে লেবাননে নিয়োগ দিয়েছিলেন।
ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার আশঙ্কায় বহু বছর তিনি জনসম্মুখে আসেননি। তবে হেজবুল্লাহ সদস্য আর লেবাননের মানুষের উদ্দেশ্যে তিনি নিয়মিত ভাষণ দিয়ে থাকেন, যা টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়।
এবারের ভাষণের পাঁচদিন আগে থেকে লেবাননের বিভিন্ন জায়গায় এর সময়সূচী ঘোষণা করে তারা।
অক্টোবর মাসে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার তীব্রতা বাড়ার পর থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর ওপর হেজবুল্লাহর আক্রমণের মাত্রাও বেড়েছে। কিন্তু এতদিন পর্যন্ত তাদের সংঘাত লেবানন-ইসরায়েল সীমান্তেই সীমাবদ্ধ ছিল। আর দুই পক্ষই বড় ধরনের সংঘাতে জড়িয়ে পড়া থেকে নিজেদের বিরত রেখেছে।
কিন্তু হেজবুল্লাহ প্রধানের আগ্রাসী বক্তব্যের পর এই পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে বলে ধারনা করছেন বিশ্লেষকরা।
হেজবুল্লাহ লেবাননের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল এবং সেখানকার সবচেয়ে বড় সশস্ত্র বাহিনীও তাদেরই। এর অর্থ তাদের সিদ্ধান্তের ওপর তাদের শত্রু ও মিত্র দুই পক্ষেরই পরবর্তী পদক্ষেপ অনেকাংশে নির্ভর করে।
হামাসের মত হেজবুল্লাহকেও যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রের মত পশ্চিমা পক্ষগুলো সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে।
হেজবুল্লাহর উদ্দেশ্য কী?
হেজবুল্লাহর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ইসরায়েলকে ধ্বংস করা। তাদের সমৃদ্ধ অস্ত্রভাণ্ডারে নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে সক্ষম এমন মিসাইল রয়েছে যা ইসরায়েলের সীমানার ভেতরে বহুদূর পর্যন্ত আঘাত করতে পারে।
হেজবুল্লাহর সেনাবাহিনীতে প্রায় লক্ষাধিক প্রশিক্ষিত, অভিজ্ঞ ও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত যোদ্ধা রয়েছে।
ইসরায়েলের সাথে ২০০৬ সালে কয়েক মাস ব্যাপী যুদ্ধে জড়িয়েছিল হেজবুল্লাহ। আবারো সেই ধরনের সংঘাতে জড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় লেবাননের অনেকে মানুষই এখন আতঙ্কিত। হেজবুল্লাহ সমর্থকরা ছাড়া লেবাননের সাধারণ মানুষের সমর্থনও নেই যুদ্ধের পক্ষে।
এই মুহুর্তে বড় ধরনের যুদ্ধে জড়ানো লেবাননের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে। বেশ কয়েক বছর ধরেই দেশটি অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে। তার উপর দীর্ঘসময় ধরে রাজনৈতিক অচলাবস্থার কারণে সুষ্ঠু ও কার্যকর সরকারও নেই দেশটিতে।
ইসরায়েলের প্রধামন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন যে যদি হেজবুল্লাহ ইসরায়েলের ওপর হামলা চালায় তাহলে তার প্রতিক্রিয়ার মাত্রা হবে ‘অচিন্ত্যনীয়।’ যুক্তরাষ্ট্রও হেজবুল্লাহর ওপর পুরোদমে হামলা করা থেকে বিরত থাকতে ইসরায়েলকে উপদেশ দিয়েছে বলে খবরে উঠে এসেছে। ঐ অঞ্চলে যেন সংঘাত ছড়িয়ে না পড়ে তা নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব ভূমধ্যসাগরে দুটি রণতরী পাঠিয়েছে।
আবার অনেক বিশ্লেষক মনে করেন হামাসের আহ্বানে সাড়া দিয়ে হিজবুল্লাহ ইসরায়েলি বাহিনীর ওপর আক্রমণের তীব্রতা বাড়ালেও তা ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখবে।
সংঘাত যেন ছড়িয়ে না পড়ে তা নিশ্চিত করতে বাইডেন প্রশাসন সরাসরি ও পরোক্ষভাবে ইরানকেও সতর্ক করে আসছে। ঐ অঞ্চলের কথিত ‘এক্সিস অব রেসিস্ট্যান্স’ বা ‘প্রতিরোধ বলয়’ সবসময়ই সমর্থন করে আসছে ইরান।
এই কথিত প্রতিরোধ বলয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিজবুল্লাহ। তারা ছাড়াও ইরাকের কয়েকটি সশস্ত্র গোষ্ঠী, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ, ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা ও হামাসও এই রেসিস্ট্যান্সের অংশ।
এই জোটের ওপর তেহরানে সরাসরি কতটা ভূমিকা রয়েছে তা নিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও ইরানের সমর্থন ছাড়া এই জোট বড় ধরনের সংঘাতে জড়াবে না বলে ধারনা করে থাকেন বিশ্লেষকরা।