ঢাকার গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার মামলায় বিশেষ আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত সাত জঙ্গির সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছে হাইকোর্ট।
বিষয়টি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ আমিন উদ্দিন।
তিনি বলেছেন, “নতুন রায়ে ‘আমুত্যু কারাদণ্ড’ বলতে বোঝানো হয়েছে যে, আসামিরা যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন তারা কারাভোগ করবে।”
আমৃত্যু কারাদণ্ড পাওয়া ব্যক্তিরা হচ্ছেন – জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজিব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদ ওরফে রাশ, সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজ, হাদিসুর রহমান সাগর, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, মামুনুর রশিদ রিপন এবং শরিফুল ইসলাম খালিদ।
দণ্ডপ্রাপ্ত আসমিদের সবাই এখন কারাগারে রয়েছে, বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল।
এর আগে, ২০১৯ সালের ২৭শে নভেম্বরে দেয়া হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলা মামলার রায়ে সাতজন জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলো ঢাকার সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল আদালত।
এরপর সাজাপ্রাপ্ত জঙ্গিদের ‘ডেথ রেফারেন্স’ এবং আসামিপক্ষের করা আপিলের ওপর শুনানি শেষে রায়ের জন্য ৩০শে অক্টোবর দিন ধার্য করেছিলো হাইকোর্ট।
সাত বছর আগে ২০১৬ সালের পহেলা জুলাই রাতে ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালায় জঙ্গিরা। ওই হামলাকে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জঙ্গি হামলার ঘটনা বিবেচনা করা হয়।
এতে ১৮ জন বিদেশি নাগরিক সহ ২২ জন নিহত হয়েছিলেন। নিহতদের মধ্যে নয় জন ইতালির, সাত জন জাপানের, একজন ভারতীয় এবং তিনজন বাংলাদেশি নাগরিক ছিলেন।
তিনজন বাংলাদেশির মধ্যে একজনের দ্বৈত নাগরিকত্ব ছিলো।
এছাড়া দুইজন পুলিশ কর্মকর্তাও সেদিন জঙ্গিদের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন।
ঘটনার পরদিন সকালে কমান্ডো বাহিনীর বিশেষ অভিযানে হামলাকারী পাঁচজন জঙ্গি নিহত হয়।
আদালত এর আগে বলেছে, হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার মূল পরিকল্পনা করেছে তামিম চৌধুরী, যিনি কয়েকবছর আগে নারায়নগঞ্জে এক অভিযানে নিহত হন।
মধ্যপ্রাচ্য-ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠির দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং জনমনে ভীতি তৈরি করার জন্য ওই হামলা চালানো হয়েছিল বলে জানানো হয়।
হোলি আর্টিজান হামলার চার্জশিট
হোলি আর্টিজান হামলার পর গুলশান থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করেছিল পুলিশ।
দুই বছর তদন্তের পর ২০১৮ সালে আটজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ।
মামলার তদন্তে ঘটনার সাথে মোট ২১ জনের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছিলো পুলিশ।
এর মধ্যে ঘটনার দিন ও পরে ১৩ জন বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয়েছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
হোলি আর্টিজানে চালানো কমান্ডো অভিযানে নিহত জঙ্গিরা হলো – রোহান ইমতিয়াজ, খায়রুল ইসলাম পায়েল, সামিউল মোবাশ্বির, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল এবং নিবরাস ইসলাম।
এছাড়া পরে জঙ্গিবিরোধী অন্য অভিযানগুলোতে নিহত হন তামিম চৌধুরী, মারজান, সারোয়ার জাহান মানিক, বাশারুজ্জামান, তানভীর কাদেরী, তারেক রায়হান এবং ছোটো রায়হান।
এছাড়া হামলার ঘটনার পর আটক হওয়া ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিমকে চার্জশিটে অব্যাহতি দেয়া হয়।
সেই রাতে হোলি আর্টিজানে যা ঘটেছিলো
দুই হাজার ষোলো সালের পহেলা জুলাই দিনটি ছিলো শুক্রবার। সেদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ করে খবর আসে গুলশানে ‘সন্ত্রাসীদের সঙ্গে’ পুলিশের গোলাগুলি হচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানা যায় যে, গুলশানের এক অভিজাত রেস্তোরাঁয় ঢুকে বেশ কয়েকজনকে জিম্মি করেছে সশস্ত্র হামলাকারী।
এক পর্যায়ে রাত ৮টা ৪৫ মিনিটে গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের হোলি আর্টিজান বেকারিতে অজ্ঞাত সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়েছে বলে জানা যায়।
গুলশানের একজন বাসিন্দা রাশিলা রহিম ওই রাতে টেলিফোনে বিবিসি বাংলাকে গোলাগুলির ঘটনার বর্ণনা দিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, “আমাকে আমার ড্রাইভার বললেন, আপা আপনি এখন বেরুবেন না, নীচে গোলাগুলি চলছে। তারপর দেখি আমার ড্রয়িং রুমের জানালার কাঁচ ফেটে গেল। তারপর থেকে অনবরত গুলির শব্দ শুনতে পাই। এরপর আমার মেয়ে কান্নাকাটি শুরু করে। আমরা সবাই কান্নাকাটি শুরু করি। কারণ খুবই আতঙ্কজনক একটা পরিস্থিতি।”
জিম্মি সংকটের ঘটনায় পহেলা জুলাই সন্ধ্যারাত থেকে দিবাগত সারারাত অর্থাৎ দোসরা জুলাই সারা বিশ্বের গণমাধ্যমের নজর ছিল ঢাকার অভিজাত গুলশান এলাকায় অবস্থিত হোলি আর্টিজান বেকারির দিকে।
শ্বাসরুদ্ধকর সেই রাতের ঘটনার একটি ধারাবাহিক বর্ণনা সেসময় বিবিসিতে প্রকাশিত হয়েছিল।
রাত নয়টা পাঁচ মিনিট: গুলশান ৭৯ নম্বর সড়কের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিদের হামলার খবর পায় পুলিশ। গুলশানের পুলিশের সহকারী কমিশনার আশরাফুল করিম জানান, খবর পাওয়ার সাথে সাথে গুলশান থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে ছুটে যায়।
রাত নয়টা কুড়ি মিনিটে ঘটনাস্থলে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান প্রত্যক্ষদর্শীরা। ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র আনিসুল হকের স্ত্রী রুবানা হক এ’সময় টুইট করেন “পুলিশ ইজ সারাউন্ডিং দ্য এরিয়া, গানফায়ার স্টিল অন”।
রাত সাড়ে নয়টার দিকে গোলাগুলিতে আহত হন বনানী থানার ওসি মোহাম্মদ সালাউদ্দীন। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে, পরে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
রাত ১০টার দিকে পুলিশ, র্যাব এবং আধা সামরিক বাহিনী বর্ডার গার্ডস বাংলাদেশের কয়েকশো সদস্য ঘটনাস্থলে গিয়ে অবস্থান নেয়।
গণমাধ্যম কর্মীরাও সেসময় ৭৯ নং রোডের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থান নেন।
রাত চারটা পর্যন্ত অস্ত্রধারীদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
আইএসের দায় স্বীকার
হামলার রাতেই ইসলামিক স্টেট জঙ্গি গোষ্ঠী তাদের বার্তা সংস্থা বলে পরিচিত ‘আমাক’এ গুলশান হামলার দায় স্বীকার করে ২০জন নিহত হবার কথা জানায়।
আইএসের পক্ষ থেকে হামলাকারীদের মধ্যে পাঁচজনকে তাদের ‘সৈনিক’ বলে দাবি করে হামলার দায়িত্ব স্বীকার করে জঙ্গি গোষ্ঠীটি।
কমান্ডো অভিযানের ঘটনাক্রম
রাতভর গুলশানের হোলি আর্টিজান রেস্টুরেন্ট সংলগ্ন এলাকা ঘিরে রাখার পর সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে সেনা, নৌ, পুলিশ, র্যাব এবং বিজিবির সমন্বয়ে যৌথ কমান্ডো দল গুলশানে অভিযানের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেয়।
সকাল সাতটা ৪৫ মিনিটে কমান্ডো বাহিনী অভিযান শুরু করে। অস্ত্র সজ্জিত দলের সদস্যরা রেস্টুরেন্টের ভেতরে প্রবেশ করে। এসময় গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়।
সকাল সোয়া আটটায় রেস্টুরেন্ট থেকে প্রথম দফায় নারী ও শিশুসহ ছয়জনকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়।
পাশের একটি ভবন থেকে একজন বিদেশী নাগরিক তাঁর মোবাইল ফোনে সেটি ধারণ করেন।
আটটা ৫৫ মিনিটে ভবনের নিয়ন্ত্রণ নেয় অভিযানকারীরা। গোয়েন্দা দল ভবনের ভেতর বিস্ফোরকের খোঁজে তল্লাশি শুরু করে।
এর কিছুক্ষণ পরই আলামত সংগ্রহের কাজ শুরু করে গোয়েন্দারা।
নয়টা ১৫ মিনিটে অভিযান শেষ হয়।
কমান্ডো অভিযানের মধ্য দিয়ে ঢাকার গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে প্রায় ১২ ঘণ্টার রক্তাক্ত জিম্মি সংকটের অবসান হয়।
সকাল ১০টায় চারজন বিদেশীসহ ১৩ জন জীবিত উদ্ধারের খবর জানানো হয়। রেস্টুরেন্টের ভেতরে অজ্ঞাত পাঁচজনের মৃতদেহ পাবার কথা পুলিশ জানায়।
সকাল ১১টা ৫০ মিনিটে অভিযানে জঙ্গিদের ছয় জন নিহত এবং একজন ধরা পড়েছে বলে নিশ্চিত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দুপুর একটা ৩০ মিনিটে আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর আইএসপিআর থেকে সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হয় রেস্টুরেন্ট থেকে ২০টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী খবরের শিরোনাম
হোলি আর্টজান হামলায় বাংলাদেশের মানুষ প্রথমবারের মত এ ধরনের নৃশংস হামলা দেখে, খবরের শিরোনাম হয় বিশ্বব্যাপী।
দেশি, বিদেশি সংবাদপত্র এবং ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে খবরের প্রধান শিরোনাম, আলোচনার বিষয় হয় গুলশান হামলার ঘটনা।
ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য টেলিগ্রাফের দোসরা জুলাই এর শিরোনাম ছিল- “20 hostages killed in ‘Isil’ attack on Dhaka restaurant popular with foreigners”।
দ্য ইকোনোমিক টাইমস দোসরা জুলাই ভোরের দিকে শিরোনাম করে- “ISIS gunmen take hostages at Dhaka eatery; 2 policemen killed”।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের শিরোনাম ছিল – “After Slaughter, Bangladesh Reels at Revelations About Attackers”।
এভাবে দেশ বিদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতে পরবর্তী কয়েক দিন খবর ছিল বাংলাদেশের গুলশানে ক্যাফেতে হামলার ঘটনা।
জঙ্গি নির্মূলে সরকারেরও ব্যাপক তৎপরতা
গুলশান হামলা বাংলাদেশের ইতিহাসে জঙ্গি হামলার ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ করে, যার সাথে সম্ভবত দেশের কেউ পরিচিত ছিলো না।
এরপর বাংলাদেশ সরকারও জঙ্গি নির্মূলে ব্যাপক তৎপরতা চালিয়েছে। পরের কয়েক বছরে জঙ্গি তৎপরতা ঠেকাতে বেশ কয়েকটি বড় অভিযান চালানো হয়।
পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালে হোলি আর্টিজান হামলার পরের তিন বছরে অব্যাহত জঙ্গি বিরোধী অভিযানে ৮০জন নিহত এবং তিনশোর বেশি গ্রেফতার হয়।
ভাড়াটিয়াদের সম্পর্কে পূর্নাঙ্গ তথ্য সংগ্রহ, নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকা করাসহ নজরদারির বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়।
হোলি আর্টিজানে হামলার ঘটনা পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটকে আগের চাইতে আরও শক্তিশালী করার পাশাপাশি নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকেও ঢেলে সাজানো হয় বলে দাবি করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।