আল-আকসায় হামলার পর ইসরায়েলে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত হয়
ইসরায়েলে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ হামলার সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং এই হামলা পরিচালনাসহ প্রায় সবকিছুর মূলে রয়েছেন হামাসের কাসেম ব্রিগেডের কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফ। তাকে এই দুর্ধর্ষ অভিযানের ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে।
গত শনিবার (৭ অক্টোবর) মোহাম্মদ দেইফ এক অডিও বার্তায় ঘোষণা দেন ইসরায়েলে ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’ শুরু হয়েছে। ইসরায়েলের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায় থাকা দেইফের এ ঘোষণার পরপর ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে একসঙ্গে ৫ হাজার রকেট ছোড়া হয়। এর কিছুক্ষণ পর গাজার সীমান্ত প্রাচীর ভেঙে ইসরায়েলে ঢুকে পড়েন হামাসের ১ হাজার যোদ্ধা।
গাজায় হামাসের একটি সূত্র জানিয়েছে ২০২১ সালে মুসলিম বিশ্বের তৃতীয় পবিত্র স্থান আল-আকসা মসজিদে ইসরায়েলি বাহিনীর ব্যাপক হামলার পর ইসরায়েলে শক্তিশালী সামরিক অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেন মোহাম্মদ দেইফ।
সূত্রটি বলেছে, ‘এই হামলার সিদ্ধান্ত নেওয়া পবিত্র রমজান মাসে আল-আকসা মসজিদে ইসরায়েল হামলা চালানোর পর, মুসল্লিদের পেটানোর পর, মসজিদ থেকে বৃদ্ধ ও তরুণদের টেনে-হিঁচড়ে বের করে দেওয়ার দৃশ্যগুলো সামন আসার পর।’ এ সব কিছু সবার মনে ক্রোধ সৃষ্টি করে বলে যোগ করেছে সূত্রটি।
ওই সিদ্ধান্তের প্রায় ২ বছর পর ইসরায়েলের ভেতর ঢুকে হামাস ইতিহাসে সবচেয়ে বড় হামলা চালিয়েছে। যে হামলায় নিহত হয়েছে ১ হাজার ২০০ জনেরও বেশি ইসরায়েলি। অপরদিকে ইসরায়েলের প্রতিশোধমূলক হামলায় গাজায় প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৯০০ মানুষ।
মোহাম্মদ দেইফকে হত্যা করতে সাতবার চেষ্টা চালিয়েছে ইসরায়েল। কিন্তু প্রতিবারই তারা ব্যর্থ হয়েছে। যার সর্বশেষটি ছিল ২০২১ সালে। দেইফ খুব বেশি কথা বলেন না বা জনসম্মুখে আসেন না। যখন গত শনিবার হামাস টিভি চ্যানেলের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, মোহাম্মদ দেইফ কথা বলবেন— তখনই ফিলিস্তিনিরা বুঝে যান বিশেষ কিছু একটা হতে যাচ্ছে।
অবশ্য ওইদিন দেইফ কথা বললেও সরাসরি তিনি টিভি পর্দায় উপস্থিত হননি। এরবদলে তার ছায়া দেখানো হয়। সবমিলিয়ে দেইফের মাত্র তিনটি ছবিই রয়েছে।
দুটি ব্রেন, একজন মাস্টারমাইন্ড
হামাসের ওই সূত্রটি জানিয়েছে, ইসরায়েলে হামলার সিদ্ধান্ত যৌথভাবে নেন হামাসের আল-কাসেম ব্রিগেডের কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফ ও হামাস গাজা শাখার অপর নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার। তবে এটি পরিষ্কার এই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী কে ছিল।
সূত্রটি বলেছে, ‘সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ছিল দুটি ব্রেন, কিন্তু সেখানে ছিল একজন মাস্টারমাইন্ড।’ ইসরায়েলে হামলা চালানোর ব্যাপারে মাত্র কয়েকজন কমান্ডার জানতেন।
এই সূত্রটি আরও জানিয়েছে, হামলার ক্ষেত্রে খুবই গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়েছিল। ইরান জানত যে হামাস এ ধরনের একটি অভিযানের পরিকল্পনা করছে। কিন্তু এই অভিযান কখন শুরু করা হবে সেটি জানত না তারা।
মোহাম্মদ দেইফের পরিচয়
মোহাম্মদ দেইফের জন্ম হয় ১৯৬৫ সালে খান ইউনিসের একটি শরণার্থী ক্যাম্পে। তার বাবা-মা তার নাম রাখেন মোহাম্মদ মাসরি। কিন্তু ১৯৮৭ সালে যখন ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে প্রথম ইন্তিফাদা শুরু হয় এবং এতে তিনি যোগ দেন তখন তার নাম পরিবর্তিত হয়ে যায় মোহাম্মদ দেইফ।
তিনি ১৯৮৯ সালে একবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এবং ১৬ মাস কারাবরণ করেছিলেন।
মোহাম্মদ দেইফ গাজার ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানের উপর ডিগ্রি অর্জন করেন। যেখানে তিনি পদার্থ, রসায়ন এবং জীববিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন।
তরুণ বয়সী মোহাম্মদ দেইফ। এরপর আর তার কোনো ছবি পাওয়া যায় না।
মোহাম্মদ দেইফ হামাসের নেতৃত্বের পর্যায়ে আসার পর গাজায় বিভিন্ন সুড়ঙ্গ তৈরি করেন এবং হামাসের বোমা তৈরির সক্ষমতা বৃদ্ধি করেন।
একটি সূত্র জানিয়েছে, গত কয়েক দশকে যত ইসরায়েলি আত্মঘাতী বোমা হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন তার সবগুলোর পেছনে ছিলেন দেইফ। আর এ কারণে তিনি ইসরায়েলের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় রয়েছেন।
হামাসের অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, ইসরায়েলের একটি হত্যাচেষ্টায় মোহাম্মদ দেইফ একটি চোখ ও পা হারান। ২০১৪ সালে ইসরায়েলের বিমান হামলায় তার স্ত্রী, সাত মাস বয়সী ছেলে ও ৩ বছর বয়সী মেয়ে নিহত হন।
ইসরায়েলের এজেন্টদের কাছ থেকে দূরে থাকার জন্য মোহাম্মদ দেইফ স্মার্টফোনসহ কোনো ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করেন না।
সূত্র: রয়টার্স