ইসরায়েলে বিমানবাহী রণতরী পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, হামাসের পাশে ইরান
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন ও ইহুদী রাষ্ট্র ইসরায়েল যখন অপ্রত্যাশিত এক লড়াইয়ে লিপ্ত, তখন দুই পক্ষই বাইরের সহায়তা পাচ্ছে।
গত শনিবার হামাসের ভয়াবহ হামলার পরপরই মিত্র দেশ ইসরায়েলের পাশে থাকার যে ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছিল, এরই মধ্যে তা দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে।
ইসরায়েলের সহায়তায় বিমানবাহী রণতরীসহ কয়েকটি যুদ্ধজাহাজ ও যুদ্ধবিমান পাঠাচ্ছে বাইডেন প্রশাসন।
হামাসের বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে ইসরায়েলকে বাড়তি যুদ্ধসরঞ্জাম ও গোলাবারুদ দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনের বরাত দিয়ে এই তথ্য জানিয়েছে সিএনএন।
ইতালির ভূমধ্যসাগর উপকূলে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক জ্বালানিসমৃদ্ধ বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড পূর্ব ভূমধ্যসাগরের দিকে রওনা হয়েছে। মার্কিন যুদ্ধজাহাজের এই বহরে ক্ষেপণাস্ত্রবাহী চারটি ডেস্ট্রয়ার ও একটি ক্রুজারও রয়েছে।
এছাড়া এফ-৩৫, এফ-১৫, এফ-১৬ এবং এ-১০ যুদ্ধবিমান পাঠিয়ে ওই অঞ্চলে অবস্থান শক্ত করতে যাচ্ছে বাইডেন প্রশাসন।
সামনের দিনগুলোতে ইসরায়েলকে আরও সামরিক সহায়তা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে হোয়াইট হাউস।
ইসরায়েলকে সহায়তায় যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের সমালোচনা করেছে হামাস। একে ‘ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে আগ্রাসন’ বলে উল্লখ করেছে সংগঠনটি।
শনিবার হামাসের ওই হামলার পর ইসরায়েলও সংগঠনটির শক্ত অবস্থান গাজাকে ‘মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে’ প্রবল বিমান হামলা চালাচ্ছে। হামাসের যোদ্ধাদের সঙ্গে স্থলেও কঠিন যুদ্ধে লিপ্ত ইসরায়েলি সেনারা।
সিএনএনের সবশেষ খবর অনুযায়ী, হামাসের সঙ্গে লড়াইয়ে ইসরায়েলে নিহতের সংখ্যা ৭০০ ছাড়িয়েছে।
অন্যদিকে ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ইসরাইয়েলের পাল্টা হামলায় গাজায় চারশর বেশি মানুষের মৃত্যুর খবর দিয়েছে।
জাতিসংঘের বরাতে বিবিসি জানিয়েছে, ইসরায়েলের ব্যাপক বিমান হামলায় এরই মধ্যে প্রায় ধ্বংস্তুপে পরিণত হয়েছে গাজা। সেখানকার ১ লাখ ২৩ হাজার বাসিন্দা গৃহহীন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ৭৪ হাজার মানুষ বিভিন্ন স্কুলে আশ্রয় নিয়েছে।
এদিকে গত শনিবার ইসরায়েলে চালানো হামাসের হামলার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে ইরান।
দেশটির প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ওয়ানা নিউজ এজেন্সিতে এক ভিডিও বার্তায় হামাসের এই হামলাকে ‘ফিলিস্তিনি যোদ্ধা এবং ফিলিস্তিনি গ্রুপগুলোর বিজয়’ বলে অভিহিত করেছেন।
রোববার এক্স হ্যান্ডেলে এক বার্তায় ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির-আবদুল্লাহিয়ান হামাসের হামলাকে ‘বছরের পর বছর ধরে চলা হত্যা ও অপরাধের বিরুদ্ধে বৈধ জবাব’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
হামাসের দাবি, ইরানের কাছ থেকে পাওয়া সহায়তায় নির্ভর করেই গত শনিবার গাজা স্ট্রিপ ঘিরে থাকা ইসরায়েলের সীমান্তের কঠোর নজরদারি ভেঙ্গে হাজারো রকেট, ড্রোন হামলার পাশাপাশি প্যারাগ্লাইডাররা ইসরায়েলের ভূমিতে নেমে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।
তবে এই হামলায় এখন পর্যন্ত ইরানের সরাসরি সংশ্লিষ্টতার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন।
তবে ফিলিস্তিনের এই সংশস্ত্র সংগঠনটিকে যে ইরান দীর্ঘদিন ধরে সহায়তা দিয়ে আসছে, তাও বলেছেন ব্লিনকেন।
যুক্তরাষ্ট্রের একটি টেলিভিশনকে তিনি বলেন, “বহু বছর ধরে ইরানের সহায়তা না পেলে হামাস কখনই হামাস হয়ে উঠত না। এই হামলার পেছনে ইরানের মদদ আছে, এমন কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণ আমরা পাইনি। কিন্তু অনেক বছর ধরে তারা যে সহায়তা দিচ্ছে, সেটি পরিষ্কার।”
“এই দৃশ্যে অবশ্যই ইরান আছে। তারা বছরের পর বছর হামাস ও হেজবুল্লাহকে সহায়তা দিয়ে আসছে”, সিএনএনকে এমনটাই বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা।
হামাসের এই হামলা এবং এর পরিকল্পনায় ইরানের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা আছে, এত দ্রুত সেই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো ঠিক হবে না বলে জানিয়েছেন মার্কিন এক শীর্ষ কর্মকর্তা।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক কর্মকর্তাই মনে করছেন, এই হামলায় প্রশিক্ষণ ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করতে পারে ইরান।
ডেমোক্র্যাট এক সেনেটরের ভাষ্য, “হামাসের সঙ্গে ইরানের ঘনিষ্ঠতা এবং আর্থিক ও অপারেশনাল সহায়তায় এটা মনে হতে পারে, এই ঘটনার পেছনে তাদের একটা ভূমিকা থাকলেও থাকতে পারে।”
কিন্তু ইরানের সরাসরি জড়িত থাকার বিষয়ে কোনো গোয়েন্দা তথ্যও এখন পাননি যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের একটি সূত্রের ধারণা, সুসজ্জিত হয়ে হামাসের এই হামলার ধরনে মনে হতে পারে ইরানের হয়ত সংশ্লিষ্টতা আছে। কারণ, এ ধরনের হামলার জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও সরঞ্জাম কেনার সামর্থ্য সংগঠনটির নেই।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে ইরানের ভূমিকা কতটুকু?
আরেকটি প্রশ্ন হল- এমন একটি গোছানো হামলা চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল, অস্ত্রশস্ত্র সমন্বয় কীভাবে করল হামাস, আর মধ্যপ্রাচ্য, পশ্চিমা এবং বিশেষ করে ইসরায়েলের অত্যন্ত চৌকস গোয়েন্দাদের ফাঁকিইবা দিল কীভাবে?
সিএনএনের ‘স্টেট অব দি ইউনিয়ন’ অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন বলেছেন, “নির্দিষ্ট এই বিষয়ে বলতে গেলে, এই হামলার সঙ্গে (ইরানের) সরাসরি সংশ্লিষ্টতা কিংবা পেছনে থাকার কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি।”
এছাড়া এনবিসির মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “বিষয়টি (ইরানের সংশ্লিষ্টতা) আমরা সতর্কতার সঙ্গে খতিয়ে দেখছি এবং দেখতে হবে ঘটনাপ্রবাহ আমাদের কোথায় নিয়ে যায়।”
সম্প্রতি একটি চুক্তির মাধ্যমে ইরানের কয়েক বিলিয়ন ডলারের তহবিল মুক্ত করে দেওয়ার পর সেই অর্থ এই হামলায় ব্যবহৃত হয়েছে, এমন সমালোচনা বাতিল করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন।
ওই চুক্তির মাধ্যমে ইরানের জন্য অন্য কোনো খাতে অর্থ ব্যয় করার সুযোগ তৈরি হয়েছে কিনা, সে বিষয়েও সতর্ক মন্তব্য করেন ব্লিনকেন।
এনবিসির মিট দ্য প্রেসে তিনি বলেন, “দুর্ভাগ্যজনকভাবে ইরান সবসময় সন্ত্রাসবাদ, হামাসের মত দলগুলোর সমর্থনে অর্থ ব্যয় করে, কিংবা সেদিকেই তাদের মনোযোগ থাকে। নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তারা এটি করেছে, না থাকলেও করেছে। এই কাজকেই তারা অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে সবসময়।”