পোল্যান্ড কেন ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ করা বন্ধ করলো?
মাত্র ছয় মাস আগে ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে ‘বিশ্বের একজন নায়ক’ হিসেবে স্বাগত জানিয়েছিল পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ। সাবেক কমিউনিস্ট শাসিত দেশ দুটি রাশিয়ার ছায়ায় ছিল দীর্ঘদিন। উভয় দেশ স্পষ্ট করেছিল ইউক্রেনে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবে। এই লড়াই বিশ্বের গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য লড়াই।
বিশ্বের প্রথম রাষ্ট্রনেতা হিসেবে কিয়েভে নিহত ইউক্রেনীয় সেনাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন পোলিশ প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেজ ডুডা। ওই সময় তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা মস্কোকে একটি স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছি। আমাদের বিভক্ত করা যাবে না।’
সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে যুদ্ধের সময় গড়ে ওঠা অংশীদারিত্বের চেয়ে হয়ত আরও শক্তিশালী স্থানীয় রাজনীতি। আগামী মাসে পার্লামেন্টারি নির্বাচনে পুনরায় জয়ী হতে ইউক্রেন-বান্ধব পোলিশ সরকার নিজের অবস্থান পাল্টাচ্ছে।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহের পশ্চিমাদের আগ্রহী করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা পোলিশ প্রধানমন্ত্রী ম্যাথিউজ মোরাউইকি বৃহস্পতিবার ঘোষণা দিয়েছেন, প্রতিবেশী দেশকে আর অস্ত্র সরবরাহ করবে না পোল্যান্ড।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, আমরা এখন আর ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ করছি না। কারণ এখন আমরা নিজেদের আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত করার চেষ্টা করছি। তিনি চান পোলিশ বাহিনী হোক ইউরোপের একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী।
তিনি আরও বলেছেন, কেউ যদি রক্ষণাত্মক অবস্থানে থাকতে না চায় তাহলে অবশ্যই নিজেকে রক্ষার জন্য কিছু করতে হবে। এটি হলো আমাদের নীতি। ফলে আমরা অস্ত্র ক্রয় বাড়িয়েছে।
পোল্যান্ডের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তে রাশিয়া ও ইউক্রেনের সেনাবাহিনী যদি লড়াই না করত তাহলে হয়ত এটিকে সাধারণ নির্বাচনি বাগাড়ম্বর হিসেবে ধরে নেওয়া হতো। কিন্তু মোরাউইকি ও ডুডা উভয়েই পোল্যান্ডের ক্ষমতাসীন ল অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির সদস্য। জনমত জরিপে দেখা গেছে, বিরোধীদের সঙ্গে ভোটের লড়াইয়ে অল্প ব্যবধানে তারা এগিয়ে।
রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের কট্টর সমর্থক ও সহযোগিতাকারী দেশ পোল্যান্ড। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ আক্রমণের পর হতে এখন পর্যন্ত ৪৩০ কোটি ডলার মূল্যের সামরিক সরঞ্জাম কিয়েভকে দিয়েছে ওয়ারশ। এছাড়া আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছে ১৩০ কোটি ডলারের। এতে করে ইউক্রেনকে সহযোগিতাকারী শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায় কানাডার পরেই পোল্যান্ডের অবস্থান। ইউক্রেনের দেড় কোটি শরণার্থীকেও স্বাগত জানিয়েছে দেশটি। এদের মধ্যে এখনও প্রায় দশ লাখ রয়ে গেছেন।
কিন্তু ইউক্রেনীয় শস্য আমদানি এবং ট্রানজিট ইস্যুতে দুই দেশের সম্পর্কে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। ইউক্রেনীয় অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি এই কৃষিপণ্য রুশ আক্রমণে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উর্বর কৃষিভূমি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে এবং জুলাই মাসে রাশিয়া কৃষ্ণসাগরীয় শস্যচুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করেছে। এই চুক্তির আওতায় কৃষ্ণ সাগর দিয়ে ইউক্রেনীয় শস্য পরিবহনের জন্য একটি নিরাপদ সামুদ্রিক করিডোর গড়ে তোলা হয়েছিল। কিন্তু এখন চুক্তি না থাকায় শস্য পরিবহনকারী জাহাজগুলো রুশ বোমাবর্ষণের শিকার হচ্ছে। রফতানি ব্যাহত হচ্ছে।
কৃষ্ণ সাগরীয় বন্দরগুলোতে রুশ অবরোধের কারণে পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া ও বুলগেরিয়ায় নতুন সুযোগ খুঁজছিল ইউক্রেন। তাত্ত্বিকভাবে এই দেশগুলো দিয়ে ইউরোপীয় কৃষি উৎপাদনে প্রভাব না ফেলে বিদেশে পাঠানো হবে ইউক্রেনীয় শস্য।
কিন্তু পোল্যান্ডের কৃষকদের অভিযোগ, ইউক্রেনীয় শস্য স্থানীয় বাজারে প্রবেশ করছে। এতে তাদের ফসলের দাম কমে যাচ্ছে। ইউক্রেনীয় পণ্যে শুল্ক আরোপ করতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রত্যাখ্যানের পর এপ্রিলে পদত্যাগ করেছেন পোল্যান্ডের কৃষিমন্ত্রী হেনরিক কোওয়ালকজিক। ইউরোপীয় কমিশন ইউক্রেনীয় শস্যের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচটি দেশকে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। এই তহবিলের সবচেয়ে বেশি অর্থ পেয়েছে পোল্যান্ড। একই সঙ্গে ইউক্রেনীয় শস্য আমদানিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল।
এই নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হয় ১৫ সেপ্টেম্বর। কিন্তু পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়া আলাদাভাবে ইউক্রেনীয় শস্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। মূলত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় কিয়েভের মামলা দায়েরের ঘটনায় এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
বৃহস্পতিবার স্লোভাকিয়া ঘোষণা দিয়েছে তারা ইউক্রেনের সঙ্গে শস্য নিয়ে একটি সমঝোতায় পৌঁছেছে। তারা বলেছে, চুক্তিটি যাচাই করা প্রয়োজন এবং এই বছরের শেষের দিকে কার্যকর হতে পারে। পোলিশ ও ইউক্রেনীয় কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, তারা আগামীতে এই বিষয়ে বৈঠক করবেন।
কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি শস্য আমদানি নিষিদ্ধ করার ইউরোপীয় দেশগুলোর সমালোচনা করেছেন। তিনি অভিযোগ করে বলেছেন, খাদ্যকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের রুশ সামরিক কৌশলকে সহযোগিতা করা হচ্ছে এই নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে।
এই সমালোচনার পর পোলিশ প্রেসিডেন্ট ডুডা নিউ ইয়র্কে জেলেনস্কির সঙ্গে পরিকল্পনায় থাকা বৈঠকে অংশগ্রহণ করেননি। ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্টের সমালোচনার নিন্দা করেছেন।
দুই দেশের প্রেসিডেন্টের মন্তব্যে উঠে এসেছে ঘনিষ্ঠ দুটি দেশ এখন কত দূরে অবস্থান করছে।
ফিনান্সিয়াল টাইমস-এর প্রতিবেদন অনুসারে ডুডা বলেছেন, ডুবতে থাকা মানুষ যেমন যেকোনও কিছু আকড়ে ধরতে চায়, ইউক্রেন তেমন আচরণ করছে। ডুবন্ত মানুষ খুব বিপজ্জনক, অন্যকেও গভীরে টেনে নিয়ে যেতে পারে।
সূত্র: টরোন্টো স্টার