ইউক্রেন শীতের আগে বড় সাফল্য পেতে মরিয়া
দখলদার রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাফল্য পেতে হিমশিম খাওয়া ইউক্রেনীয় বাহিনীর পাল্টা আক্রমণে নতুন এক তাগাদা হাজির হচ্ছে। আর তা হলো গ্রীষ্মকাল দ্রুত ফুরিয়ে আসছে, বৃষ্টি ও তুষারপাতের দিন নিয়ে এগিয়ে আসছে শীতকাল।
হাড় কাঁপানো দুটি শীতকালজুড়ে ইউক্রেনীয় ও রুশ সেনারা লড়াই করেছেন। ফলে শীতকাল এলেও কেউ-ই নিজেদের অবস্থান ছাড়বে না। কিন্তু টানা বৃষ্টির ফলে সড়কে কাদা এবং বরফ শীতল আবহাওয়া কামানে গোলা ভরা থেকে শুরু করে ট্রিগার চাপা কঠিন করে তুলবে।
ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর জন্য একটি আশঙ্কা হলো, শেষ পর্যন্ত তাদের তীব্র আক্রমণে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা গুঁড়িয়ে গেলেও শীতে কাদা ও তুষারের মধ্য দিয়ে ভারী সরঞ্জাম নিয়ে এগিয়ে যাওয়া যাবে না।
বর্তমানে পদাতিক সেনারা অল্প দূরত্ব থেকে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। আকাশ নজরদারি ও হামলার মুখে তাদের গতিবিধি খুব সীমিত। কিয়েভের সেনারা শক্তিশালী প্রতিরক্ষা গড়ে তোলা রুশদের ওপর আক্রমণ করছে। তারা চাইছে প্রতিরক্ষা ভেদ করে ট্যাংক ও অপর সমরাস্ত্র নিয়ে এগোতে।
ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান মেজর জেনারেল কিরিলো বুদানভ বলেছেন, যেভাবেই হোক লড়াই অব্যাহত থাকবে। শীতে ভেজা ও কাদায় লড়াই করা কঠিন। কিন্তু সব রণক্ষেত্রে আক্রমণ অব্যাহত থাকবে।
যুক্তরাষ্ট্রের জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ মার্কিন সেনাবাহিনীর জেনারেল মার্ক মিলি চলতি বছরে ইউক্রেনের অগ্রগতি নিয়ে প্রত্যাশার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সতর্ক। গত সপ্তাহে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, প্রতিকূল আবহাওয়া শুরুর আগে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর সামনে লড়াই করার মতো ৩০ থেকে ৪৫ দিন সময় আছে।
অপর এক পশ্চিমা প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেছেন, অক্টোবরের শেষদিকে ইউক্রেনকে আক্রমণের বদলে পুনরুদ্ধার করা ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে কৌশল পাল্টাতে হবে। একই সঙ্গে শীতকালে রাশিয়ার ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা থেকে বেসামরিক অবকাঠামো সুরক্ষিত রাখতে সক্রিয় হতে হবে।
ইউক্রেনে আবহাওয়া এখনও শুষ্ক। ফলে কিয়েভের সেনারা এগিয়ে যেতে মরিয়া আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। গত মাসে তারা জাপোরিজ্জিয়া অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ রবোটাইন গ্রাম পুনরুদ্ধার করেছে। এরপর গ্রামটির আশপাশে তাদের আক্রমণ জোরদার করে রাশিয়ার প্রথম প্রতিরক্ষা ভেদ করার দাবি করেছে। টানা কয়েক মাস দিনে কয়েক ইঞ্চি করে এগোতে থাকা সেনারা এখন বড় অগ্রগতির প্রত্যাশা করছে।
এমনকি ইউক্রেনীয় সেনারা যদি আজব সাগর পর্যন্ত পৌঁছাতে নাও পারে, বর্তমান রণক্ষেত্র তা থেকে ৫৫ মাইল দক্ষিণে, মাত্রা পাঁচ বা দশ মাইল এগিয়ে গেলে রাশিয়ার গুরুত্ব রসদ সরবরাহের রুট তাদের কামানের গোলার আওতায় আসতে পারে।
সম্প্রতি ইউক্রেনীয় সেনারা তাদের আক্রমণের ব্যাপ্তি আরও বাড়িয়েছে। রবোটাইন গ্রামের দক্ষিণ-পূর্বে দুটি গ্রামের মধ্যবর্তী ফসলের ক্ষেত দ্বারা সৃষ্ট ফাঁকা স্থানকে নিশানা করছে তারা। সামনের পথ এখনও বিপজ্জনক। রাশিয়ার যুদ্ধবিমান ও ড্রোন নিয়মিত বোমা ফেলছে এবং কামানের গোলাবর্ষণের জন্য তাদের অবস্থান শনাক্ত করছে। গাছের সারির আড়ালে এবং পরিখার আড়ালে অবস্থান নিচ্ছে রুশ সেনারা।
ইউক্রেনের আকাশ নজরদারি ইউনিটের এক ড্রোন অপারেটর সিভি (কল সাইন) বলেন, রুশরা কঠিন লড়াই করছে। প্রতিটি বাড়ি, প্রতিটি পরিখায় সর্বাত্মক লড়াই হচ্ছে। উভয় পক্ষে প্রচুর হতাহত হচ্ছে।
এই ড্রোন ইউনিট ইউক্রেনের একটি আক্রমণভাগের সেনাদের সঙ্গে কাজ করছে। তারা সামনে কী বিপদ আছে তা শনাক্ত করে। ড্রোন দিয়ে তারা রুশ সেনাদের গতিবিধিতে নজর রাখে।
ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক থিংক ট্যাংক আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের ব্র্যাডি আফ্রিক বলেছেন, ইউক্রেনীয় হামলায় যেকোনও ধরনের বিরতির ফলে দখলকৃত ভূখণ্ডে নিজেদের আরও শক্তিশালী করবে। যা ইউক্রেনের পুনরুদ্ধার অভিযানকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা গেছে, রাশিয়া ইতোমধ্যে আগের গড়ে তোলা প্রতিরক্ষা আরও শক্তিশালী করছে।
ন্যাটোর এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, লড়াই করা দরকার হলে তা করতে হবে। সামনে এগিয়ে যাওয়া যদি সুবিধা এনে দেয় তাহলে এগোতে হবে। উড়োজাহাজ থেকে অবতরণ করা সেনারা তুষারের মধ্য দিয়ে হাঁটতে পারবে। কিন্তু তাদের সঙ্গে সামরিক সরঞ্জাম নিতে হবে এবং শত্রুদের প্রতিরক্ষা ভেদ করতে হবে।
ইউক্রেনীয় সেনাদের আশঙ্কা, রাশিয়ার প্রতিরক্ষা রেখা ভেদ করার পর যদি আবহাওয়া পরিস্থিতির কারণে এর প্রশস্ত বাড়াতে ব্যর্থ হতে হয়, তাই তারা বোমা ছড়িয়ে থাকা মাঠ কাদা বা তুষারক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার আগেই এগিয়ে যেতে চাইছে।
ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর ড্রোন ইউনিটের অপর এক সদস্য ওলেক্সান্ডার সলোঙ্কো বলেন, বৃষ্টিতে কাজ করা কঠিন হবে। কাদা আমাদের গতিবিধি সীমিত করে দেবে। এমনিতেই রসদের রুট কমে গেছে, তখন আরও কমে যাবে। সাঁজোয়া যান ব্যবহারের সুযোগ সংকীর্ণ হয়ে যাবে।
সবচেয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতি আসবে নভেম্বর ও ডিসেম্বরের শুরুতে। এই পরিস্থিতিকে রুশরা রাসপুতিস্তা নামে অভিহিত করে। এই সময় সড়কগুলো অদৃশ্য হয়ে যাবে। এরপর কাদা শক্ত হতে শুরু করে এবং চলাচল সহজ হয়। বরফে আবৃত ভূমি ভারী অস্ত্রের জন্য সহায়ক হলেও তুষারের কারণে গতিবিধি ও শত্রুদের এড়িয়ে চলা কঠিন হবে। কারণ, সরঞ্জাম শনাক্ত করা সহজ।
বর্তমানে ইউক্রেনের পদাতিক বাহিনীর পথ খুঁজতে সহযোগিতা করছে ড্রোন। রাশিয়ার কামানের অবস্থান শনাক্ত করছে তারা। এর ফলে কিয়েভের অগ্রসর ভাগের সেনারা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারছে। ইউক্রেনীয়দের দেখাদেখি রাশিয়াও দ্রুত ড্রোন ব্যবহার করতে শুরু করেছে। তবে ভারী বৃষ্টি এবং শীতের তুষারপাতে ড্রোনের কার্যকারিতা এখনও প্রশ্নবিদ্ধ।
সলোঙ্কো বলেন, যখন আমরা ড্রোন পাঠাই তখন হলিউডের সিনেমার মতো উজ্জ্বল ছবি পাই না। হয়তো গুরুত্ব পাল্টাবে এবং কৌশলে পরিবর্তন আসছে। কিন্তু লড়াই অব্যাহত থাকবে। সর্বোপরি, আমরা ও দখলদার বাহিনী উভয়ের এমন পরিস্থিতিতে লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা রয়েছে।
সূত্র: ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল