দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পরে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় অংশীদার বাংলাদেশ: লাভরভ
বাংলাদেশে সফররত রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পরে রাশিয়ার দ্বিতীয় সবচেয়ে বড় অংশীদার বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠক শেষে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এমন কথা বলেন মি. লাভরভ।
তিনি বলেছেন, “দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ আমাদের ভালো এবং দীর্ঘদিনের অংশীদার। গত ৫০ বছর ধরে আমরা আমাদের সম্পর্ক বন্ধুত্ব ও সমতার ভিত্তিতে গড়ে তুলছি।”
দোভাষীর মাধ্যমে দেয়া বক্তব্যে মি. লাভরভ আরো বলেন, “কোভিড মহামারির মতো নানা প্রতিবন্ধকতার পরও আমরা আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ধরে রেখেছি এবং আজ আমরা সব ক্ষেত্রে আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরো মজবুত করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছি।”
তিনি বলেন, “আমরা আমাদের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক জোরদার করতে সম্মত হয়েছি। আমরা আরো লক্ষ্য করেছি যে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পর বাংলাদেশ দ্বিতীয় বড় অংশীদার।”
এরআগে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে সময় সন্ধ্যা সোয়া ছয়টার দিকে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন মি. লাভরভ।
রুশ কোন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এটাই প্রথম বাংলাদেশ সফর।
পরে ঢাকার একটি হোটেলে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বৈঠকে বসেন। পরে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সংবাদ সম্মেলনে রাশিয়া এবং বাংলাদেশের গণমাধ্যম কর্মীদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন মি. লাভরভ।
‘বিকল্প মুদ্রায় লেনদেনের পথ খুঁজছি’
রাশিয়ার উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশের রূপপুর পাওয়ার প্লান্টের বকেয়া অর্থ পরিশোধে সমস্যা হচ্ছে – উল্লেখ করে মি. লাভরভকে প্রশ্ন করা হয়, এর সমাধানে কী করছে রাশিয়া।
জবাবে মি. লাভরভ বলেন, “আমি মনে করি, আমরা খুব দ্রুত নানা ধরণের পেমেন্ট সিস্টেমের ব্যাপারে পদক্ষেপ নিচ্ছি, যা হবে মূলত কোন দেশের নিজস্ব মুদ্রায়।”
মার্কিন ডলারের কথা উল্লেখ না করলেও, সেটিকে ইঙ্গিত করে মি. লাভরভ বলেন, “…সেটি এমন কোন দেশের মুদ্রা হবে না যারা সেটিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে।”
রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে ‘সাপ্লাই চেইন’ বা সরবারহ ব্যবস্থা ব্যাহত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, রূপপুর প্রকল্পের সব উপাদান নির্দিষ্ট সময়ে সরবরাহ করা হবে। এটা পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যাবে।
বাংলাদেশে রাশিয়ার প্রধান বিনিয়োগ প্রকল্প রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ প্রাক্কলিত সময়ের মধ্যে হচ্ছে উল্লেখ করে মি. লাভরভ বলেছেন, অক্টোবরে এ প্রকল্পে জ্বালানির প্রথম চালানটি পৌঁছাবে বাংলাদেশে।
‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ অগ্রহণযোগ্য’
রোহিঙ্গা সংকটের মতো বড় বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে – উল্লেখ করে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী মি. লাভরভ বলেছেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাইরের পক্ষগুলোর একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান খুজে বের করা উচিত। রাশিয়া সেটাই করে যাচ্ছে। মিয়ানমারের সাথে এটা নিয়ে আলোচনা অব্যাহত থাকবে।
রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেন, “বাইরের কিছু পক্ষ এই বিষয়টিকে ব্যবহার করে চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করছে এবং তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করছে। আমি বিশ্বাস করি, এতে হিতে বিপরীত হবে এবং একই সাথে এটা অগ্রহণযোগ্যও বটে।”
তিনি বলেন, “আমরা সাধুবাদ জানাচ্ছি যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের চাপ সত্ত্বেও বাংলাদেশ তার নিজস্ব স্বার্থের কথা মাথায় রেখে তাদের পররাষ্ট্রনীতি অপরিবর্তিত রেখেছে।”
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, “দুই পক্ষের বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যু, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ এবং রাশিয়ার বৃহত্তর বাজারে প্রবেশাধিকার নিয়ে আলোচনা হয়েছে।”
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, “আমরা যুদ্ধ চাই না। আমরা চাই আলোচনা ও সংলাপের মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান হোক।”
জ্বালানি খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ
সংবাদ সম্মেলনে মি. লাভরভ উল্লেখ করেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুই দেশের বাণিজ্যিক লেনদেন দুই বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ওঠানামা করত।
তবে ২০২২ সালে সেটি প্রায় তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে।
কিন্তু সম্প্রতি সেটি কিছুটা কমে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, দুই দেশের বাণিজ্য বিষয়ক কমিশনের সদস্যরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন এবং সর্বশেষ চলতি বছরের মার্চেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
রূপপুর পরমানু বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাইরেও বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে রাশিয়ার আগ্রহের কথা তুলে ধরেন মি. লাভরভ।
তিনি বলেছেন, গ্যাস খাতে বাংলাদেশের সাথে রাশিয়ার কিছু প্রকল্প রয়েছে। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় কোম্পানি গ্যাজপ্রম ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশে ২০টির বেশি কূপ খনন করেছে এবং তারা এটা অব্যাহত রাখবে।
রাশিয়ার সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো বাংলাদেশে এলএনজি সরবরাহের বিষয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
এছাড়া গম এবং সার সরবরাহ করার বিষয়েও আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মি. লাভরভ।
রাশিয়া বাংলাদেশের সাথে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম যেমন জাতিসংঘ, আসিয়ানসহ সব জায়গায় তাদের সহায়তা অব্যাহত রাখবে বলে জানান তিনি।
শুক্রবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে গণভবনে বৈঠকের কথা রয়েছে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর।
এরপর দুপুরে তিনি ঢাকা থেকে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিতে যাবেন।
আসিয়ানের শীর্ষ সম্মেলন শেষ করে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা থেকে ঢাকায় আসেন তিনি।
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম কোন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমন এক সময় এই সফর করছেন, যখন ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়া আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কবলে রয়েছে, অন্যদিকে সুুষ্ঠু নির্বাচন ঘিরে বাংলাদেশ সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে।
বাংলাদেশের কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ সময়ে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সফরের মধ্যে দিয়ে রাশিয়া একদিকে যেমন বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুত্ব এবং সমর্থন অব্যাহত রাখার জন্য আহবান জানাবে, সেই সঙ্গে রাজনৈতিক বা কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশের পাশে থাকার বার্তাও দিতে চায় দেশটি।