জি-২০ সম্মেলনের আগে দিল্লিতে বস্তি উচ্ছেদ
ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির জনতা ক্যাম্প এলাকার একটি বসতি থেকে মাত্র ৫০০ মিটার দূরে বিশ্বের শিল্পোন্নত ও বিকাশমান অর্থনীতির দেশগুলোর জোট জি-২০’র শীর্ষ সম্মেলন শুরু হতে যাচ্ছে। বসতির বাসিন্দারা এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জেনে আশা করেছিলেন যে, এতে তারা উপকৃতই হবেন। কিন্তু তাদের সেই আশায় গুড়েবালি। এখন বস্তি থেকেই উচ্ছেদ হয়েছেন তারা। হয়ে পড়েছেন গৃহহীন।
ধর্মেন্দ্র কুমার, খুশবু দেবী ও তাদের তিন সন্তানের মতো দিল্লিতে এখন এমন অসংখ্য গৃহহীন মানুষের দেখা মিলছে। যাদের বাড়িঘর গত কয়েক মাসে ভেঙে ফেলা হয়েছে। সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দা ও সমাজকর্মীরা বলেছেন, আগামী ৯-১০ সেপ্টেম্বরের শীর্ষ সম্মেলনের সৌন্দর্যবর্ধন কাজের অংশ হিসেবে বস্তি উচ্ছেদ করা হয়েছে।
বস্তিবাসীর বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়ার অভিযান পরিচালনা করেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তারা। তারা বলেছেন, সরকারি জমিতে বেআইনিভাবে বাড়িঘর তৈরি করা হয়েছে এবং সেখান থেকে সেসব সরিয়ে ফেলাটা নিয়মিত কাজের অংশ।
জনতা ক্যাম্পের মতো বস্তিতে বাড়িগুলো জোড়াতালি দিয়ে বছরের পর বছর ধরে তৈরি করা হয়। সেখানকার বেশিরভাগ বাসিন্দাই কাছাকাছি এলাকায় কাজ করেন এবং কয়েক দশক ধরে তাদের ছোট বাড়ির সীমানার মধ্যে বসবাস করেন।
দিল্লির এই বস্তি উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়েছিল চার মাস আগে। গত মে মাসের এক উত্তপ্ত সকালে জনতা ক্যাম্পে হানা দেয় বুলডোজার। বাড়িঘর ধ্বংসের ভিডিওতে দেখা যায়, টিন শেডের তৈরি ছোট ছোট ঘরগুলো মাটিতে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এক সময় যারা এসব ঘরে বসবাস করতেন, সেদিন তাদের অনেকেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই ধ্বংসযজ্ঞ দেখছেন তো অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়ছেন।
জি-২০ সম্মেলনের প্রধান ভেন্যু প্রগতি ময়দানের কাছেই জনতা ক্যাম্পের অবস্থান। দিল্লির স্বাভাবিক দৃশ্যের প্রতীকও বলা যায় এই ক্যাম্পকে। দিল্লির ২ কোটি বাসিন্দার বেশিরভাগই অপরিকল্পিত বিভিন্ন জেলায় বসবাস করেন। ২০২১ সালে দেশটির আবাসন ও নগর কল্যাণবিষয়ক মন্ত্রী হরদ্বীপ সিং পুরী সংসদে বলেছিলেন, দিল্লির অননুমোদিত কলোনিগুলোতে প্রায় ১ কোটি ৩৫ লাখ মানুষ বসবাস করেন।
গৃহহীনদের নিয়ে কাজ করা নয়াদিল্লি-ভিত্তিক সংগঠন সেন্টার ফর হলিস্টিক ডেভেলপমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও নির্বাহী পরিচালক সুনীল কুমার আলেদিয়া বলেন, সরকার সৌন্দর্যবর্ধনের নামে বাড়িঘর উচ্ছেদ করছে এবং ভাসমান লোকজনকে সরিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এসব লোকের কী হবে সেবিষয়ে কোনও উদ্বেগ ছাড়াই এটি করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, এটি যদি করতেই হয়, তাহলে সেখানকার বাসিন্দাদের তা সময় মতো জানিয়ে দেওয়া এবং পুনর্বাসন করা উচিত ছিল।
গত মাসে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের এক আদেশে বলা হয়, দখলদাররা দখলে নেওয়া সরকারি সম্পত্তির মালিকানা দাবি করতে পারেন না। তবে সরকারি সম্পত্তি খালি করে দেওয়ার জন্য তারা সময় চাইতে পারেন। একই সঙ্গে তারা পুনর্বাসনের জন্য আবেদনও করতে পারেন।
গত জুলাইয়ে দেশটির সংসদে দেওয়া বক্তৃতায় আবাসন ও নগর কল্যাণবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কুশল কিশোর বলেছিলেন, ১ এপ্রিল এবং ২৬ জুলাইয়ের মধ্যে নয়াদিল্লিতে অন্তত ৪৯ বার উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এই অভিযানের মাধ্যমে প্রায় ২৩০ একর সরকারি ভূমির মালিকানা পুনরুদ্ধার করা হয়েছে।
তিনি বলেছেন, জি-২০ সম্মেলন উপলক্ষ্যে নগরীর সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য কোনও বাড়িঘর উচ্ছেদ করা হয়নি।
তবে জনতা ক্যাম্প গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় অত্যন্ত বিস্মিত হয়েছেন সেখানকার বাসিন্দা মোহাম্মদ শামীম। তিনি বলেন, তিনি ভেবেছিলেন, জি-২০ সম্মেলনে অংশ নেওয়া ‘বড় বড় মানুষেরা’ হয়তো তাদের মতো ‘গরীবদের কিছু দেবেন।’
মোহাম্মদ শামীম বলেন, এখানে ঠিক তার উল্টোটা ঘটেছে। বড় মানুষরা আসবেন, আমাদের কবরের ওপর বসবেন এবং খাবেন। জনতা ক্যাম্প বসতির বাসিন্দা কুমার প্রগতি ময়দানের একটি অফিসে কেরানি হিসেবে কাজ করেন। বাড়িঘর ভেঙে ফেলায় এবং পরিবারকে উচ্ছেদ করায় ব্যাপক কষ্টে দিনাতিপাত করছেন তিনি।
ধর্মেন্দ্র কুমার বলেন, ‘আমাদের যদি এখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে আমার সন্তানদের লেখাপড়ারও ক্ষতি হবে। স্কুলটি কাছাকাছি হওয়ায় তারা এখান থেকে পড়তে পারে।’ তার দুই সন্তান পাঁচ বছরের সৃষ্টি ও ১০ বছরের ইশান্ত ওই এলাকার একটি সরকারি স্কুলে পড়াশোনা করছে। কুমারের আনোখি নামের ৯ মাস বয়সী আরেক মেয়ে রয়েছে।
ধর্মেন্দ্র কুমারের পরিবারে তার স্ত্রী খুশবু দেবীর বাবাও রয়েছেন। ১৩ বছর ধরে তারা ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করে আসছিলেন। সম্মেলনের আগে জমিটি খালি করে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কারণ হিসেবে তাদের জানানো হয়েছিল, এলাকাটি পরিষ্কার করতে হবে।
দেবী রয়টার্সকে বলেন, ‘যদি তাদের জায়গা পরিষ্কারই করতে হয়, তাহলে তার মানে এই নয় যে গরীবদের সরিয়ে দিতে হবে। দরিদ্রদের দেখতে যদি খুব খারাপ লাগে, তাহলে তারা সুন্দর কিছু তৈরি করতে পারতেন। তারা একটি পর্দা বা একটি চাদর লাগাতে পারতেন, যাতে দরিদ্রদের দেখা না যায়।’
প্রশাসনের কর্মকর্তারা বুলডোজার দিয়ে তাদের বাড়িঘর ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার পর চলে যাওয়ার সাথে সাথে কুমার ও তার স্ত্রী ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করেন। এসব জিনিসপত্র তারা রাস্তার পাশে রাখেন। পরে এসব আসবাবপত্র তিন চাকার গাড়িতে তুলে জনতা ক্যাম্প থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে মাসিক আড়াই হাজার রুপিতে ভাড়া নেওয়া একটি ঘরে নিয়ে যান।
উচ্ছেদের দুই মাস পর গত আগস্টে এই পরিবারটি জনতা ক্যাম্প এলাকার একটি অংশে ফিরে আসে। আর এই অংশটিতে বুলডোজার হানা দেয়নি। সেখানে তারা এক কক্ষের একটি বাসা ভাড়া নিয়েছে সাড়ে তিন হাজার রুপিতে।
কুমার বলেন, আগে আমরা যে জায়গায় ছিলাম সেখান থেকে আমার বাচ্চাদের জন্য প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল। আমি চাই তারা পড়াশোনা চালিয়ে যাক এবং ভালো কিছু করুক। আমরা তাদের জন্য এখানে ফিরে এসেছি।
সূত্র: রয়টার্স