দেউলিয়া ঘোষণা করা শ্রীলঙ্কার ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প
ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করা শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে পর্যটন ও রেমিট্যান্সের পালে হাওয়া লেগেছে। ইতোমধ্যে ঋণ পরিশোধও শুরু করেছে দেশটি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশা করছে, এই ত্রৈমাসিকে অর্থনীতিতে আবার প্রবৃদ্ধি শুরু হবে, যা অনেক অর্থনীতিবিদের প্রত্যাশার চেয়ে দ্রুত সময়ে ঘটবে।
বৈদেশিক ঋণে জর্জরিত হয়ে এক বছর আগে আমদানি ব্যয় মেটাতে পারছিল না শ্রীলঙ্কা। ফলে নিত্যপণের দাম হয়ে যায় আকাশছোঁয়া। বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের পাশপাশি তীব্র জ্বালানি সংকটে ধুঁকতে থাকে দেশটির জনগণ। ব্যাপক রাজনৈতিক সহিংসতায় মুখে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছিল তৎকালীন রাজাপাকসা সরকারকে। বিদেশে পালিয়ে যান তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসাকে।
সেই পরিস্থিতি এখন অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে শ্রীলঙ্কা। অল্প সময়ে উল্লেখযোগ্যহারে কমেছে মুদ্রাস্ফীতি। এ ছাড়া অর্থনীতির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ পর্যটন খাত আবারও জমে উঠছে। জ্যামিতিক হারে বাড়ছে রেমিট্যান্স।
ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প
কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক প্রিয়াংঙ্গা দুনুসিংহে মনে করেন, শ্রীলঙ্কার এমন প্রত্যাবর্তনের পেছনে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু নীতির ভূমিকা রয়েছে। তিনি বলেন, ‘কিছু নীতির ফলে রেমিট্যান্স ও পর্যটনের মতো কিছু খাত উজ্জীবিত হয়েছে। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দারুণ সমন্বয়ের কারণেই এমনটি ঘটেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকার ব্যয় কমিয়ে রাজস্ব বাড়িয়েছে। সংস্কার কার্যক্রম জোরদার করেছে। এর ইতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে দেখা যাচ্ছে।’
বিভিন্ন ঋণদাতা দেশ এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর মতো সংস্থার সঙ্গে সরকার আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে দুনুসিংহে বলেন, ‘গত বছর বিপুল সংখ্যক শ্রমিক বিদেশ গেছে। এতে রেমিট্যান্স বাড়ছে। আবার পর্যটনখাতও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।’
এই বছর পর্যটনের আয় ৩০ শতাংশ এবং রেমিট্যান্সে ৭৬ শতাংশ বৃদ্ধির ফলে শ্রীলঙ্কার কোষাগারে ৩.২ বিলিয়ন ডলার যোগ করেছে। এর ফলে মে মাসে রিজার্ভ গত ১৪ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩.৫ বিলিয়ন ডলার ছুঁয়েছে। চলতি বছর দেশটির মুদ্রার মূল্য ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে৷
তবে মুদ্রার অবমূল্যায়ন আর ভর্তুকি কমিয়ে কর আহরণ বিস্তৃত করে রাজস্ব আয় বাড়ানোকে ‘ট্রাম্প কার্ড’ হিসেবে দেখছেন শ্রীলঙ্কার সাংবাদিক ও বিশ্লেষক শিহার আনিজ। তিনি বলেন, ‘বাজারে গেলে পরিস্থিতি টের পাওয়া যায়। তবে সংকট থেকে এখনও পুরোপুরি বের হয়ে আসতে পারেনি শ্রীলঙ্কা। বিদেশি ঋণ পরিশোধ শুরুর পর থেকে আসল পরিস্থিতি বোঝা যাবে।’
যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল
দায়িত্ব নিয়েই কয়েকটি খাতে সংস্কারের পাশাপাশি আইএমএফের সঙ্গে ঋণ সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা শুরু করেন রনিল বিক্রমাসিংহে। মার্চে আইএমএফ বোর্ডের অনুমোদনের পর অনেকটাই স্বস্তি ফেরে দেশটিতে।
নিত্যপণ্য ও বিদ্যুতের দাম কমানোর পাশাপাশি অতি দরিদ্রদের আর্থিক সহায়তা দিতে শুরু করে সরকার। সেই সঙ্গে গত বছর বিদেশে কর্মী পাঠিয়ে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে দ্বীপরাষ্ট্রটি।
অবশ্য সংকট সামলাতে সংস্কার কর্মসূচির অংশ হিসেবে কিছু খাতে কর বাড়ানো আবার কোনটাতে ভর্তুকি কমানোর মতো অজনপ্রিয় পদক্ষেপও নিতে হয়েছে সরকারকে।
সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ
দেশ ও দেশের বাইরে থেকে শ্রীলঙ্কা মোট ঋণ এখন ৫০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এর মধ্যে চীন, জাপান এবং ভারতকে দিতে হবে ১১ বিলিয়ন ডলারের মতো। আবার মোট ঋণের ২৮ বিলিয়ন ডলার শোধ করতে হবে ২০২৭ সালের মধ্যে।
লঙ্কান সরকার অবশ্য ঋণ পুনর্বিন্যাসের জন্য সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এতে সফল হলে কিছুটা স্বস্তি পাবে দেশটি।
শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইন্স, শ্রীলঙ্কা টেলিকম এবং শ্রীলঙ্কান ইনস্যুরেন্স কর্পোরেশনের মতো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোকে বেসরকারিকরণের পরিকল্পনা নিয়ে বেকায়দায় আছে সরকার। অবশ্য ব্যয় কমাতে এ ছাড়া তেমন বিকল্প নেই সরকারের হাতে।
এ ছাড়া ভর্তুকি কমানো বা বাদ দেওয়ার কারণে অনেক খাতে মানুষের ব্যয় বেড়ে গেছে। এতে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে সরকারবিরোধী ক্ষোভ দানা বাঁধছে। অন্যদিকে নিয়মিত বেতন-ভাতা দিয়ে প্রশাসনিক কার্যক্রম সচল রাখাটাও লঙ্কান সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
সূত্র: বিবিসি