বিদ্রোহের পরই কি ওয়াগনার প্রধান প্রিগোজিনের ‘মৃত্যুঘণ্টা’ বেজে গিয়েছিল?

সাময়িকী ডেস্ক
সাময়িকী ডেস্ক
7 মিনিটে পড়ুন

বিদ্রোহের পরই কি ওয়াগনার প্রধান প্রিগোজিনের ‘মৃত্যুঘণ্টা’ বেজে গিয়েছিল?

জুনের শেষ দিকে ইয়েভজেনি প্রিগোজিন মস্কোতে যখন এক বিদ্রোহী মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, তখন থেকেই রাশিয়ার পর্যবেক্ষকরা তাকে ‘আ ডেড ম্যান ওয়াকিং’ বা প্রাণহীন একজন মানুষের মত বলে বর্ণনা করছিলেন। অর্থাৎ তারা অনুমান করছিলেন প্রিগোজিনের সময় আর বেশিদিন নেই।

সম্প্রতি ভাড়াটে বাহিনীর এই নেতার আয়ু সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে সিআইএ পরিচালক উইলিয়াম বার্নস বলেছিলেন: “আমি যদি প্রিগোজিন হতাম তবে আমি আমার খাবার যিনি পরীক্ষা করেন, তাকে বরখাস্ত করতাম না।”

যদি কখনও প্রমাণিত হয় যে ক্রেমলিন ইচ্ছাকৃতভাবে, ঠাণ্ডা মাথায় প্রতিশোধ নিতে ইয়েভজেনি প্রিগোজিনকে বহনকারী বিমানটিকে মধ্য-আকাশে ধ্বংস করে দিয়েছে, তাহলেও এটি রাশিয়ার ইতিহাসে একটি ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ হিসেবেই উল্লেখিত থাকবে।

ভাড়াটে বাহিনী ওয়াগনারের ভেতরে এবং বাইরে একদা দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি, এক সময়ের রাঁধুনি এবং হট ডগ বিক্রেতা প্রিগোজিনের বহু সংখ্যক ভক্ত ও অনুসারী রয়েছেন।

- বিজ্ঞাপন -

ঠিক দুই মাস আগে রোস্তভ-অন-ডনে একদিনের অসমাপ্ত বিদ্রোহের সময় সাধারণ মানুষ তাকে যেভাবে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছিল তা হয়তো অনেকেই দেখেছেন।

তবে মস্কোতে তার অনেক শত্রুও ছিল, বিশেষ করে রুশ সেনাবাহিনীর উচ্চপদে আসীন নেতারা। যাদের তিনি প্রায়শই এবং প্রকাশ্যেই সমালোচনা করতেন।

তবে তার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল সম্ভবত প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ডিঙিয়ে ২৩শে জুন মস্কোতে সেই বিদ্রোহ শুরু করা। যদিও তিনি তখন পুতিনের নাম উল্লেখ করেননি।

কিন্তু ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া যখন ইউক্রেনে হামলা শুরু করে, তখন তার পেছনে মস্কো যে কারণ দেখিয়েছিল তা নিয়ে প্রকাশ্যে কঠোর সমালোচনা করে প্রিগোজিন ক্রেমলিনকে খেপিয়ে তুলেছিলেন।

বিদ্রোহের পরই কি ওয়াগনার প্রধান প্রিগোজিনের 'মৃত্যুঘণ্টা' বেজে গিয়েছিল?
প্রাক্তন রুশ গুপ্তচর আলেকজান্ডার লিটভিনেনকো ২০০৬ সালে তেজস্ক্রিয় পোলোনিয়াম-২১০ বিষে আক্রান্ত হয়েছিলেন।ফাইল ছবি

তিনি রুশদের বলেছিলেন যে তারা প্রতারিত হয়েছে এবং দুর্বল নেতৃত্বের কারণে তাদের ছেলেরা ইউক্রেন যুদ্ধে মারা যাচ্ছে। এটি ছিল প্রচলিত বিশ্বাস এবং পুতিনের ওই দিনের ভিডিও বার্তায় তিক্ততার ছাপ ছিল স্পষ্ট।

- বিজ্ঞাপন -

পুতিন মস্কোতে প্রিগোজিনের অগ্রযাত্রাকে ‘বিশ্বাসঘাতকতা‘ এবং ‘পিঠে ছুরিকাঘাত’ বলে অভিহিত করেছিলেন।

বিশ্বাসঘাতক বা যারা তাকে চ্যালেঞ্জ করে তাদের কখনো ক্ষমা করেন না ভ্লাদিমির পুতিন।

প্রাক্তন রুশ গোয়েন্দা কর্মকর্তা আলেকজান্ডার লিটভিনেনকো দলত্যাগী হওয়ার পর তাকে তেজস্ক্রিয় পোলোনিয়াম-২১০ এর বিষ দেয়া হয়েছিল, যার প্রভাবে ২০০৬ সালে লন্ডনের একটি হাসপাতালে তিনি তিলে তিলে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুবরণ করেন।

- বিজ্ঞাপন -

পরে তদন্তে জানা যায় যে এই মারাত্মক পদার্থটি ঘাতকরা রাশিয়া থেকে তাদের সাথে করে নিয়ে এসেছিল এবং এটি শুধুমাত্র রাশিয়ার সরকারি গবেষণাগারে পাওয়া যায়।

যদিও মস্কো ওই ঘটনায় তাদের সম্পৃক্ততা কথা অস্বীকার করেছে, কিন্তু যে দুই সন্দেহভাজনকে এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে চিহ্নিত করা হয়েছিল তাদেরকে বিচারের জন্য আত্মসমর্পণ করার প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিল দেশটি।

প্রায় একই পরিণতি হতে পারতো সের্গেই স্ক্রিপালের সাথেও, যিনি ছিলেন একজন প্রাক্তন রুশ কেজিবি অফিসার এবং পরে তিনি ব্রিটেনে আশ্রয় নেন। ২০১৮ সালে তিনি এবং তার মেয়ে ইউলিয়া অল্পের জন্য মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন।

জিআরইউ বা রাশিয়ার শীর্ষ গোয়েন্দা কার্যালয়ের কর্মকর্তারা স্যালসবিউরিতে তার বাড়ির দরজার হাতলে নোভিচক নার্ভ এজেন্ট লাগিয়ে রেখেছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে।

একটি ফেলে দেওয়া পারফিউমের বোতলে এই মারাত্মক এজেন্টটি ছিল। পরে উইল্টশায়ারের স্থানীয় বাসিন্দা ডন স্টার্জেস বোতলটি খুঁজে পান, যিনি নিজের কব্জিতে সেটি লাগানোর পরপরই মারা যান।

বিদ্রোহের পরই কি ওয়াগনার প্রধান প্রিগোজিনের 'মৃত্যুঘণ্টা' বেজে গিয়েছিল?
সের্গেই স্ক্রিপাল ২০১৮ সালে নোভিচক নার্ভ এজেন্ট বিষক্রিয়া থেকে অল্পের জন্য বেঁচে যান।

রাশিয়ার অভ্যন্তরে সমালোচক এবং ব্যবসায়ীদের এক দীর্ঘ তালিকা রয়েছে, যারা আকস্মিক মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন, তাদের কেউ কেউ ‘বাড়ির ওপর তলার জানালা থেকে পড়ে’ গিয়ে মারা গিয়েছেন।

প্রেসিডেন্ট পুতিনের সবচেয়ে সোচ্চার প্রতিপক্ষ, আলেক্সেই নাভালনি, এখন রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত জালিয়াতির অভিযোগে সাজা ভোগ করছেন।

দুই হাজার কুড়ি সালে তাকেও সাইবেরিয়ার একটি ফ্লাইটে নোভিচক নার্ভ এজেন্ট বিষ প্রয়োগে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। তিনি মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিলেন।

তবে প্রিগোজিনের বিষয়টি একদম আলাদা ছিল, তার মৃত্যুতে রুশ জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।

তিনি এমন একজন ব্যক্তি যিনি ক্রেমলিনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিলেন এবং অনেক রুশ নাগরিকের কাছে তিনি ছিলেন জাতীয় বীরের মতো।

এর আগে ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত তার ভাড়াটে সৈন্যের বাহিনী ওয়াগনার গ্রুপটি মূলত সাবেক রুশ স্পেজনাজ (বিশেষ বাহিনী) অপারেটিভ এবং নিবেদিত প্রাণ সৈন্যদের নিয়ে গঠন করা হয়েছিলো।

এটি পূর্ব ইউক্রেনে অত্যন্ত সক্রিয় ছিল, যেখানে তারা ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীকে বাখমুত থেকে বিতাড়িত করেছিল। এতে তারা বড় ধরণের খ্যাতি অর্জন করে। যে খ্যাতি দুর্বল নেতৃত্বের নিয়মিত রুশ সেনাবাহিনী কখনোই পায়নি।

ওয়াগনারের প্রভাব আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে যখন প্রিগোজিন ব্যক্তিগতভাবে রাশিয়ায় দণ্ডিত ধর্ষক এবং খুনিসহ হাজার হাজার সাজাপ্রাপ্তকে নিজের দলে ভেড়াতে শুরু করেন।

পূর্ব ইউক্রেনে এই বাহিনী শক্তিশালী কামানের মতো কাজ করেছিল। যেখানে কমান্ডাররা তাদের শত্রুদের পরাস্ত করতে বার বার এই সৈন্যদের লড়াই চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছিলো।

বিদ্রোহের পরই কি ওয়াগনার প্রধান প্রিগোজিনের 'মৃত্যুঘণ্টা' বেজে গিয়েছিল?
ইয়েভজেনি প্রিগোজিন (বাম) ২০১১ সালে একটি নৈশভোজে ভ্লাদিমির পুতিনকে (মাঝে) খাবার পরিবেশন করার ছবি। ফাইল ছবি রয়টার্স

ওয়াগনার কয়েক বছর সিরিয়াতেও কাজ করেছে, কিন্তু মূলত আফ্রিকাতেই তারা ক্রেমলিনের জন্য কৌশলগত সাফল্য বয়ে এনেছিল। সেখানে তারা অত্যন্ত কার্যকর একটি ব্যবসায়িক মডেল তৈরি করে, যা সেখানকার অগণতান্ত্রিক সরকারগুলোর কাছে জনপ্রিয় প্রমাণিত হয়।

ভিআইপিদের সুরক্ষা দেয়া থেকে শুরু করে নির্বাচনকে প্রভাবিত করা, সমালোচকদের মুখ বন্ধ করানোসহ নানা ধরনের ‘নিরাপত্তা পরিষেবা’ প্রদানের বিনিময়ে তারা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে স্বর্ণ এবং বহুমূল্য খনিজ সম্পদ নিয়ন্ত্রণের অধিকার পায়।

সেখান থেকে অর্জিত অর্থ মস্কোতে যেত এবং অচিরেই তারা প্রচুর অর্থের মালিক হয়, কিন্তু ওই সব দেশের জনগণের ভাগ্যে প্রকৃত কোন পরিবর্তন হয়নি।

মালি এবং মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে ওয়াগনারবাহিনীর বিরুদ্ধে গণহত্যাসহ অসংখ্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। তবুও তারা আফ্রিকা মহাদেশের বিশাল এলাকা জুড়ে ফরাসি এবং অন্যান্য পশ্চিমা শক্তিকে হটিয়ে নিজেদের প্রতিস্থাপনে সফল হয়েছে।

এ সপ্তাহেই টেলিগ্রাম চ্যানেলে প্রিগোজিনের একটি ভিডিও সামনে আসে। ভিডিওটি মালির কোন ঘাঁটিতে ধারণ করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেখানে তাকে বলতে দেখা যায়, ওয়াগনার বাহিনী আফ্রিকায় তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করবে এবং আফ্রিকার মানুষদের ‘স্বাধীনতা’ এনে দেয়ারও অঙ্গীকার করা হয়।

এসব সত্ত্বেও ওয়াগনারের অনেকেই মস্কোতে ফিরে এসেছে, বিশেষ করে সামরিক গোয়েন্দাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা ওয়াগনারকে এক ধরণের ‘বোঝা’ মনে করতেন, যিনি যেকোন সময় বিগড়ে যেতে পারেন এবং পুতিনের জন্য একটি ‘সম্ভাব্য হুমকি’ হয়ে উঠতে পারেন।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!