রাশিয়ায় বিমান বিধ্বস্ত , যাত্রী ছিলেন ওয়াগানর প্রধান প্রিগোজিন
রাশিয়ার রাজধানী মস্কো থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গগামী একটি উড়োজাহাজ দেশটির তিয়েভের অঞ্চলে বিধ্বস্ত হয়েছে, যে বিমানের যাত্রী তালিকায় ছিল ভাড়াটে সেনাদল ওয়াগনারের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিনের নাম।
রুশ কর্তৃপক্ষের বরাতে দেশটির সংবাদমাধ্যম আরটি জানিয়েছে, বুধবার রাতে এ ঘটনায় ওই বিমানের ১০ আরোহীর সবাই মারা গেছেন।
রাশিয়ার বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ রোসাভিয়েশন এক বিবৃতিতে বলেছে, এমব্রেয়ার-১৩৫ উড়োজাহাজটির ১০ আরোহীর ৭ জন ছিলেন যাত্রী, আর তিনজন ক্রু। ওই বিমানের যাত্রীদের তালিকায় ওয়াগনার প্রধান প্রিগোজিনের নাম ছিল।
ইউক্রেইন যুদ্ধে রাশিয়ার হয়ে ভাড়া খাটা ওয়াগনার বাহিনী গত জুনে প্রিগোজিনের নেতৃত্বে মস্কোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল, যা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়।
বিবিসি লিখেছে, রুশ প্রতিরক্ষা বাহিনী মস্কোর উত্তরে তিভের অঞ্চলে বিমানটিকে গুলি করে ভূপাতিত করেছে বলে ওয়াগনার সংশ্লিষ্ট টেলিগ্রাম চ্যানেল গ্রে জোনে দাবি করা হয়েছে।
রোসাভিয়েশন বলছে, বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় তাদের একটি কমিশন ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে। আর রাশিয়ার তদন্ত সংস্থা বলেছে, তারা এ ঘটনায় ফৌজদারি তদন্ত শুরু করেছে।
তাস জানিয়েছে, ব্যক্তিগত বিমানটি উড্ডয়নের আধা ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে বিধ্বস্ত হয়। বিধ্বস্ত হওয়ার পর ওই উড়োজাহাজে আগুন ধরে যায়। সেখান থেকে ইতোমধ্যে দশজনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে আরেক বার্তা সংস্থা আরআইএ।
স্থানীয় বাসিন্দাদের বরাতে গ্রে জোন বলছে, বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার আগে দুটো বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায় এবং পরে দুটো ভ্যাপার ট্রেইল দেখেন তারা।
ঘটনাস্থলের একটি ভিডিও বিশ্লেষণ করে সিএনএন লিখেছে, বিধ্বস্ত ওই উড়োজাহাজটির রেজিস্ট্রেশন নম্বর এবং আকৃতি ও রঙ প্রিগোজিনের নামে নিবন্ধিত একটি উড়োজাহাজের সঙ্গে মিলে যায়।
ফ্লাইট ট্র্যাকিং সেবা ফ্লাইটরেডার টোয়েন্টিফোরের তথ্যে দেখা যায়, স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা ১১ মিনিটে মাটি থেকে ২৬ হাজার ফুট উচ্চতায় থাকতে বিমানটির সঙ্গে কন্ট্রোল টাওয়ারের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর প্রায় খাড়াভাবে মাটিতে নেমে আসে এমব্রেয়ার উড়োজাহাজটি।
তবে প্রিগোজিনের মালিকানাধীন আরেকটি বিজনেস জেট মস্কো অঞ্চলে নিরাপদে অবতরণ করেছে বলে খবর দিয়েছে গ্রে জোন।
গত জুন মাসের ওই ব্যর্থ বিদ্রোহের পর থেকে অনেকটা অন্তরালেই ছিলেন ৬২ বছর বয়সী ইয়েভগিনি প্রিগোজিন; ঠিক দুমাস পর গত সোমবার তিনি এক ভিডিওতে আবির্ভূত হন।
ওয়াগনার গ্রুপের টেলিগ্রাম চ্যানেলগুলোতে পোস্ট করা ওই ভিডিওতে প্রিগোজিনকে দেখা যায় যুদ্ধের সাজপোশাকে। তাকে বলতে শোনা যায়, আফ্রিকাকে তারা ‘আরও মুক্ত’ করছেন।
বিভিন্ন দেশের জন্য ভাড়াটে হয়ে কাজ করা এই মিলিশিয়া বাহিনীর হাজারো যোদ্ধা আফ্রিকা মহাদেশে রয়েছে বলে মনে করা হয়। সেখানে তাদের লাভজনক ব্যবসায়ীক স্বার্থ রয়েছে।
প্রিগোজিনের সৈন্যরা মালি ও সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকসহ বিভিন্ন দেশে রয়েছে। এসব দেশে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তুলছে জাতিসংঘসহ মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো।
সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে ওয়াগনারের দুই প্রধানের ওপর গত মাসে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাজ্য। তাদের বিরুদ্ধে সেখানে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ করেছে দেশটি। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, আফ্রিকায় অবৈধ সোনার ব্যবসার মাধ্যমে ওয়াগনার যোদ্ধারা টাকা কামাচ্ছে।
সর্বশেষ ভিডিও বার্তায় প্রিগোজিনকে বলতে শোনা যায়, ইসলামি জঙ্গিসহ অন্যান্য অপরাধীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পাশাপাশি ওয়াগনার খনিজ অনুসন্ধান করছে।
এর আগে গত মাসে আফ্রিকা-রাশিয়া শীর্ষ সম্মেলনের সময় সেন্ট পিটার্সবার্গে ক্যামেরায় ধরা পড়েছিলেন প্রিগোজিন। ওই ছবিতে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা রাষ্ট্রদূত ফ্রেডি মাপোকার সঙ্গে তাকে করমর্দন করতে দেখা যায়।
ইয়েভগেনি প্রিগোজিন ছিলেন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। তাকে ‘পুতিনের শেফ’ নামেও ডাকা হয়, কারণ তিনি ক্রেমলিনে খাবার সরবরাহ করতেন।
২০১৪ সালে ওয়াগনার প্রতিষ্ঠার পর ওই বছরেই তাদের প্রথম অপারেশন ছিল ক্রাইমিয়া দখলে রাশিয়াকে সাহায্য করা। ইউক্রেইন যুদ্ধের আগে ওয়াগনারের সদস্য ছিল ৫ হাজারের মত, যাদের বেশিরভাগই রাশিয়ার অভিজাত স্পেশাল ফোর্সের সদস্য।
তবে গত জুনে প্রিগোজিন জানিয়েছিলেন, ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরুর পর ওয়াগনারের সদস্য বেড়ে হয়েছে ২৫ হাজার।
ইউক্রেইনে যুদ্ধের মধ্যেই রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ওয়াগনারের অন্তর্দ্বন্দ্বের শুরু। ইউক্রেইনে ওয়াগনার গ্রুপের ভাড়াটে যোদ্ধাদের পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র, সরঞ্জাম ও গোলাবারুদ সরবরাহে ব্যর্থ হওয়ায় কয়েক মাস ধরেই রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সের্গেই শোইগু এবং সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল ভ্যালেরি গেরাসিমভের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছিল প্রিগোজিনকে।
এরপর প্রেসিডেন্ট পুতিন যখন ইউক্রেইনে যুদ্ধরত সব ভাড়াটে গোষ্ঠীকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে আসতে বলেন, তখনই প্রিগোজিন তা প্রত্যাখ্যান করেন। সামরিক বাহিনীর অধীনে তার বাহিনী ঢুকে পড়লে, তার প্রভাব যে খর্ব হবে তা বুঝতে পেরেছিলেন তিনি।
এরপর গত জুনের শেষভাগে ৫ হাজার যোদ্ধাসহ সাঁজোয়া যানের বহর নিয়ে মস্কো অভিমুখে যাত্রা করেন ওয়াগনার বস। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তারা মস্কোর ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে পৌঁছে যায়।
তবে শেষ পর্যন্ত ঘটনা বেশি দূর গড়ায়নি। ক্রেমলিনের সঙ্গে সমঝোতার পর ওয়াগনারপ্রধান বিদ্রোহে ক্ষান্ত দেন এবং সৈন্যদের ঘাঁটিতে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
ওই ঘটনা রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে এমন জায়গায় ঠেলে দিয়েছিল যে, তিনি তার একসময়ের মিত্র প্রিগোজিনকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহের’ দায়েও অভিযুক্ত করেন; ওই সশস্ত্র বিদ্রোহকে বর্ণনা করেন ‘রাশিয়ার পিঠে ছুরিকাঘাত’ হিসেবে।
অন্যদিকে প্রিগোজিন তার বিদ্রোহকে অভ্যুত্থান নয়, বরং ‘ন্যায়বিচারের জন্য পদযাত্রা’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন।
তবে রুশ পর্যবেক্ষকদের অনেকেই বলছিলেন, ওই ব্যর্থ বিদ্রোহের পর প্রিগোজিন কার্যত একজন জীবন্মৃতে পরিণত হয়েছেন, কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন একসময় ঠিকই প্রতিশোধ নেবেন।