বাংলাদেশের পটভূমিতে বঙ্গোপসাগরের সামরিক গুরুত্ব কতটা
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার এক বক্তৃতায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন, গণতন্ত্র ও নির্বাচনের নাম করে তারা চায় যাতে করে ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগর ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে আক্রমণ চালানো যায় এবং, তার ভাষায়, “এই অঞ্চলের দেশগুলোকে ধ্বংস করাই হচ্ছে তাদের উদ্দেশ্য।”
কিন্তু বঙ্গোপসাগর আসলেই সামরিক কৌশলগত দিক থেকে এতটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা কিনা তা নিয়েই রয়েছে বড় প্রশ্ন এবং বিতর্ক।
তবে প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পর বঙ্গোপসাগর ইস্যুটি আবারো নতুন করে আলোচনায় এসেছে। কিছুদিন আগে সেন্টমার্টিন দ্বীপ যুক্তরাষ্ট্র চায় – এমন আলোচনায় সরগরম ছিলো বাংলাদেশের রাজনীতি।
যদিও যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দফতর পরে বলেছে যে সেন্ট মার্টিন নিয়ে বাংলাদেশে যা বলা হয়েছে তা সঠিক নয় এবং এ দ্বীপটি নেয়ার বিষয়ে দেশটি কখনো কোনো আলোচনা করেনি।
এখন আবার বঙ্গোপসাগর ইস্যুটি আলোচনায় এলেও যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে কখনো এমন কোনো পরিকল্পনা বা আগ্রহের কথা প্রকাশ্যে শোনা যায়নি।
কোন কোন বিশ্লেষক বলছেন, এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ মালাক্কা প্রণালী পর্যন্ত, কারণ ওই প্রণালী দিয়েই চীনের ৯০ শতাংশ বাণিজ্য হয়ে থাকে।
আবার কেউ বলছেন, এক সময় যুক্তরাষ্ট্রের মালাক্কা পর্যন্ত আগ্রহ থাকলেও এখন চীনের স্বার্থ ও আগ্রহের কারণে বঙ্গোপসাগরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরেই এমন একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে যুক্তরাষ্ট্র সেন্টমার্টিন বা বঙ্গোপসাগরে একটি সামরিক ঘাঁটি করতে চায়। যদিও এর কোনো দৃশ্যমান তৎপরতা কখনোই দেখা যায়নি। এমনকি কূটনৈতিক পর্যায়েও এমন কোনো চেষ্টা দেখা যায়নি।
এমনকি ১৯৯১ সালে উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের পর বাংলাদেশের অনুরোধে উদ্ধার অভিযান ও মানবিক সহায়তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী ‘অপারেশন সি এঞ্জেল’ পরিচালনা করতে এলে তখনও এ নিয়ে তীব্র রাজনৈতিক বিতর্ক দেখা দিয়েছিলো।
শেখ হাসিনা যা বলেছেন
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যের এক পর্যায়ে বলেন, ভৌগলিক দিক থেকে ভারত মহাসাগর আর অপরদিকে প্রশান্ত মহাসাগর। এই ভারত মহাসাগরই আমাদের বে অফ বেঙ্গল। এর গুরুত্ব অনেক বেশি। প্রাচীন যুগ থেকে এই জায়গা দিয়ে সব ব্যবসা বাণিজ্য চলে।
“আমাদের ভারত মহাসাগরে যত দেশ আছে কারও সাথে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। সম্পূর্ণ নিষ্কণ্টক একটা যোগাযোগ পথ। এই জলপথে আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে নির্বিঘ্নে পণ্য পরিবহন হয়।”
তিনি বলেন, “আজকে আমাদের গণতন্ত্রের নাম নিয়ে, নির্বাচনের নাম নিয়ে, নানা নাম নিয়ে এদেশে এমন একটা অবস্থা সৃষ্টি করতে চায় – যাতে করে ভারত মহাসাগর, বঙ্গোপসাগর- এ জায়গাটা ব্যবহার করা। আর এটাকে ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে আক্রমণ করা ও এ দেশগুলোকে ধ্বংস করা- এটাই হচ্ছে কারও কারও উদ্দেশ্য”।
তিনি আরও বলেন, “সেই উদ্দেশ্য নিয়েই এদের নানা ধরণের টালবাহানা। এটা দেশবাসীকে বুঝতে হবে। আমাদের কিছু আঁতেল আছে জানিনা কখনো তারা এগুলো চিন্তা করে কি-না। এগুলো কখনো উপলব্ধি করে কি-না। সেগুলো না করে তারা এদের সাথে সুর মেলায়। দুটো পয়সার লোভে তারা নানাভাবে এ কাজগুলো করে বেড়ায়”।
প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকার আহবান জানিয়ে বলেন, ভারত মহাসাগরের এ অঞ্চলের দেশগুলো এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন আছে।
তার দাবি, পার্বত্য চট্টগ্রামেও আবার নানা রকমের অশান্তির চেষ্টা চলছে।
“যেহেতু আমি জানি, বুঝি। যে কারণে কিভাবে আমাকে ক্ষমতা থেকে সরাবে আর তাদের কিছু কেনা গোলাম আছে, পদলেহনকারী আছে, তাদের বসিয়ে এ জায়গাকে নিয়ে খেলবে- এটাই হলো প্রচেষ্টা। সেটা আমি ভালো ভাবে বুঝতে পারি,” বলছিলেন তিনি।
কিন্তু বঙ্গোপসাগরের আসলে কোন গুরুত্ব আছে?
কুয়ালালামপুরের মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব চায়নার অধ্যাপক ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী বিবিসি বাংলাকে বলেন, চীনের ওপর নজরদারির জন্যই যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত মালাক্কা প্রণালীর নিয়ন্ত্রণ রাখতে চায় এবং সেজন্যই তারা যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের মধ্যকার জোট কোয়াড গঠন করেছে।
“বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব যতখানি আছে সেজন্য। এই গুরুত্ব বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নয়। তার চীনকে নিয়ে উৎকণ্ঠিত। আর চীনের ৬০ ভাগ বাণিজ্য হয় মালাক্কা প্রণালী দিয়ে এবং এর মধ্যে ৯০ ভাগ পরিবহন জাহাজ-নির্ভর। সেই কারণে ওই এলাকায় সেখানে কড়া নজরদারি চায় যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত,” বলছিলেন মি. আলী।
তবে বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলছেন, এটি ঠিক যে একসময় যুক্তরাষ্ট্রের চিন্তা ছিলো মালাক্কা প্রণালী পর্যন্ত।
“কিন্তু এখন তাদের কৌশল পাল্টেছে। ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি বিবেচনায় নিলে ভারত মহাসাগরের প্রেক্ষিতেই বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব বেড়েছে। বিশেষ করে চীনের স্বার্থ ও উপস্থিতি বেড়ে যাওয়ার কারণেই বঙ্গোপসাগরের কৌশলগত গুরুত্ব অন্যদের কাছে বেড়েছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
বঙ্গোপসাগরে আর কারও ঘাঁটি আছে
সমর কৌশল বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ ও মিয়ানমার অংশে কোনো সামরিক ঘাঁটি নেই।
তবে ভারতের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে দেশটির বিমান ও নৌ বাহিনীর যৌথ ঘাঁটি আছে।
অন্যদিকে, ২০০৮ সাল থেকে সিঙ্গাপুরে মার্কিন ঘাঁটি আছে কারণ এটা মালাক্কা প্রণালির দক্ষিণে।
চীনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ সামরিক সক্ষমতা সম্পন্ন এ ঘাঁটি তৈরি করেছে বলে বলছিলেন সৈয়দ মাহমুদ আলী।
নাকি বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব ভারতের জন্য
বিশ্লেষকদের মতে, বঙ্গোপসাগরের ভৌগলিক অবস্থান সামরিক কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্ব পাওয়ার মতো নয়। মূলত বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার বঙ্গোপসাগরের উপকূল ঘেঁষে এর অবস্থান।
এর মধ্যে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক এখন খুবই ঘনিষ্ঠ আর মিয়ানমার চীন-ঘেঁষা হলেও সেখানে ভারতের শক্ত অবস্থান আছে।
সেই বিবেচনায় বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব ভারতের জন্যই বেশি। সে কারণেই ব্রিটেনের কাছ থেকে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কর্তৃত্ব পাওয়ার পর থেকেই ওই অঞ্চলকে আলাদা গুরুত্ব দিচ্ছে ভারত।
দেশটির একটি যৌথ কমান্ড কাজ করছে সেখানে কারণ এটা মালাক্কা প্রণালীর পশ্চিম দিকের অংশ যেখান দিয়ে চীনের জাহাজ চলাচল করে এবং দেশটির মোট বাণিজ্যের বড় অংশই এ পথ দিয়ে হয়। এ কারণেই এলাকাটি নিয়ন্ত্রণের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত নজরদারি করে আসছে।
মূলত চীন সাগর থেকে বের হয়ে এসে ভারত মহাসাগরে আসতে হলে মালাক্কা ছাড়া উপায় নেই। এর দক্ষিণে সিঙ্গাপুর। আরেকটু দক্ষিণে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ।
এ সব বিষয় বিবেচনা করে সিঙ্গাপুরে যুক্তরাষ্ট্র একটি ঘাঁটি তৈরি করেছে ২০০৮ সালে। মূলত চীনের কারণে মালাক্কা প্রণালীর নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয় থেকেই যুক্তরাষ্ট্র এটি করেছে।
এ ভয়টি শুরু হয়েছে মূলত ২০০৬-০৭ সালের দিকে। ওই সময় কোয়াডের যাত্রা শুরু হয় এবং তাদের একটি নৌ-মহড়া অনুষ্ঠিত হয় যাতে কোয়াড সদস্যদের বাইরে সিঙ্গাপুরও অংশ নিয়েছিলো।
বিশেষ আমন্ত্রণ পেয়ে মার্কিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারে থেকে মহড়াটি দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন সৈয়দ মাহমুদ আলী।
তিনি বলছেন, “এদিকে ভারত মহাসাগরের আন্দামান ও নিকোবরে ভারতের যৌথ কমান্ড ঘাঁটি আর ওদিকে কোয়াডের মূল ঘাঁটি সিঙ্গাপুর এবং সেখানেই করা হয়েছে মার্কিন ঘাঁটি। এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যদের জন্য বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব আছে বলে মনে হয় না।”
এ অঞ্চলের দেশগুলোকে নিয়ে শঙ্কাই যৌক্তিক?
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বঙ্গোপসাগরকে ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে আক্রমণ করা ও এ দেশগুলোকে ধ্বংস করা- এটাই হচ্ছে কারও কারও উদ্দেশ্য।
বঙ্গোপসাগর ঘিরে বা কাছাকাছি দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে – বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও শ্রীলংকা।
এর মধ্যে থাইল্যান্ডের সাথে চীনের মৈত্রী দীর্ঘদিনের আবার মিয়ানমারের সাথে চীনের সখ্যতা আছে। অন্যদিকে, মিয়ানমারের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ পেয়েছে। কারণ চীনের তেল ও গ্যাসের দুটো পাইপলাইন আকিয়াব পর্যন্ত বিস্তৃত।
অথচ চীনকে ঠেকানোর জন্য ২০০৪ সালে মালাক্কা প্রণালীর নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পরিকল্পনা ঢেলে সাজিয়েছিলো যুক্তরাষ্ট্র এবং এর অংশ হিসেবেই কোয়াড গঠন করা হয়েছিলো।
মাহমুদ আলী বলছেন, “বঙ্গোপসাগরের যতটুকু গুরুত্ব সেটা এজন্যই। বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে এর কোনো গুরুত্ব বা বিশেষত্বের কোনো বহি:প্রকাশ দেখা যায়নি। কারণ বাংলাদেশ নয়, তারা সবদিক দিয়ে নজর রাখতে চায় চীন ও তার গতিবিধির ওপর”।
সূত্র: বিবিসি বাংলা