টিনএজ কী:
ইংরেজি থার্টিন থেকে নাইন্টিন অর্থাৎ তেরো থেকে উনিশ বছর বয়সের ছেলেমেয়েদের টিনএজার বা বয়ঃসন্ধিকাল বলা হয়। যদিও টিনএজারদের কিছু বিষয় থাকে যা আরও দু চার বছর পর্যন্ত চলতে থাকে। এই তেরো থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষের। বিশেষ করে একটি ছেলের জন্য।
টিনএজের চরিত্র:
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তার ছুটি গল্পে টিনএজারদের ব্যাপারে বলেছিলেন “তেরো চৌদ্দ বয়সের ছেলের বালাই আর নাই”। অর্থাৎ এই বয়সটি এতোই দুরন্ত উদ্দীপক উশৃঙ্খল যে তাদের চরিত্রের নির্দিষ্ট কোনো ছবি আঁকা যায়না। এই বয়সে কখন কার কেন মন খারাপ হবে কেউ জানেনা। কার কখন কী ভালো লাগে সেটা সে নিজেও ভাবতে পারেনা। এই সময়টাতে প্রতিটি ছেলে তাদের শারীরিক এবং মানসিক নিত্যনতুন পরিবর্তন লক্ষ্য করে। সেসব পরিবর্তনের কথা সে কাউকে না বলতে পারে, না কেউ বুঝতে চেষ্টা করে। যারফলে ছেলেরা যথেষ্ট সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে।
সঠিক পরামর্শ এবং সিদ্ধান্তের কারণে এই বয়সের সিংহভাগ ছেলে ভুল পথে পরিচালিত হয়ে যায়।কেননা তারা তাদের প্রয়োজন সঠিকভাবে সবার কাছে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়। এই চঞ্চল উদ্যমী বাঁধনহারা সময়টা হচ্ছে বয়ঃসন্ধীকাল। এটা হচ্ছে চরম অস্থির একটি সময়। এই সময়ের ছেলেদের মানসিক অবস্থা কেউ বুঝতে পারে না।
বয়ঃসন্ধিকালের যে দিকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে একটি ছেলের জৈবিক চরিত্র। এই জৈবিকতা একটি ছেলেকে হয় ধ্বংস করে দেয় নয়তো পারিপার্শ্বিক সাপোর্ট পেয়ে নিজেকে সুদৃঢ় রাখে। কেননা এই বয়সটা হচ্ছে খুবই স্পর্শকাতর বিশেষকরে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ। এই বয়সে জৈবিক চাহিদার যে ঝড়ের সূচনা হয় তা নিজের অনুকূলে নিতে অধিকাংশ ছেলেই ব্যর্থ হয়। তাই এই বয়সের চরিত্র বলতে যে বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে জৈবিক চাহিদার নিয়ন্ত্রণের চরিত্র।
টিনএজ কীভাবে পথহারা:
এই বয়সটি যেকোনো ছেলেদের জন্য খুবই বেদনাদায়ক। এই ছেলেরা কখনোই নিজের প্রয়োজন কাউকে সঠিকভাবে বোঝাতে সমর্থ হয়না। একটি বালাক হঠাৎ করেই যখন পুরুষালি চরিত্রে চলে আসে তখন স্বাভাবিকভাবেই তার আশেপাশের লোকজন তাকে সহজ ভাবে মেনে নিতে পারে না। তার আশেপাশের লোকজন তাকে বয়স্ক কাতারে ফেলে দেয় আর নিজে চিন্তা করে সেতো এখনো ছোট! পরিবেশ মনে করছে ছেলেটি বড় হয়ে গেছে। কিন্তু সে বুঝতে পারে না কীভাবে সে বড় হয়ে গেলো। এই দ্বিমুখী সংঘর্ষের কারণে ছেলেটির মানসিক অবস্থার চরম অবনতি হয়। এই অবনতির ধারা অব্যাহত হলে ছেলেটি পথ হারিয়ে ফেলে। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে এই বয়সের পথহারা হওয়ার।
ক) বন্ধুমহল:
বয়ঃসন্ধির এই চরম মর্মান্তিক অবস্থায় তার পাশে দাঁড়ায় তার বন্ধুরা। সে বড়দের চরিত্রে ঢুকার সাথে সাথে শারীরিক যে কৌতূহল গুলো চোখে পড়ে, তা বিস্তারিত জানার একমাত্র উৎস হয়ে উঠে তার চেয়ে দু চার বছরের বড় বন্ধুমহল। যারা ইতিমধ্যে এই পর্বটি পার করেছে বা করছে। যেহেতু এই বয়সটি হলো চরম কৌতূহলী আকাঙ্ক্ষার সময়। প্রতিটি বিষয়ই এখন তার কাছে নতুন। যা দেখে যা করছে তার কাছে সবই নতুন। খুব কম সংখ্যক ছেলেরা এই শারিরীক সাংঘর্ষিক মনস্তাত্বিক সময়টাতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
যারফলে যারা কৌতূহলী তারা বন্ধুদের খপ্পরে পড়ে অনিয়ন্ত্রিত জৈবিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে নতুন শারিরীক যে পরিবর্তন তারা অনুভব করে, তার স্বাদ আস্বাদন করতে গিয়ে নিজেদের উপর অনৈতিক জৈবিক চর্চায় জড়িত হয়ে যায়। যা তাদের শারিরীক এবং মানসিক একটি বিরাট ক্ষতির মুখে ফেলে দেয়।
খ) সহজ পর্নোগ্রাফী:
বয়ঃসন্ধিকালীন ছেলেদের ধ্বংসের মূল কারণ হচ্ছে সহজ পর্নোগ্রাফী। যেহেতু এই বয়সের ছেলেদের শারীরিক সঠিক জ্ঞান থাকে না। যারফলে বন্ধুদের খপ্পরে পরে তারা প্রথম পর্নোগ্রাফীতে যুক্ত হয়। পরবর্তীতে সমাজ এবং রাষ্ট্রের বদৌলতে সহজ পর্নোগ্রাফীতে তারা জড়িয়ে পড়ে। বর্তমান সহজলভ্য তথ্যপ্রযুক্তির কারণে টিনএজারদের এই ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে।
গ) নিষিদ্ধ কৌতূহল:
মানবিক গুণাবলীর একটি একটি গুণ হচ্ছে সহজাত কৌতূহল। এই বয়সে নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি অতিমাত্রায় কৌতূহল কাজ করে। যেকারণে বড়রা যা করতে নিষেধ করে তার প্রতি তাদের কৌতূহল কাজ করে। নারীপুরুষের গোপন বিষয় গুলো নিয়ে এই বয়সে তুমুল আগ্রহ জন্ম নেয়। এই আগ্রহ থেকেই কৌতূহলের সৃষ্টি হয়। সেই কৌতূহল নিবারণ করতে গিয়ে তারা ভয়ংকর এক ফাঁদে পা দিয়ে ফেলে। যে ফাঁদ থেকে সহজে তারা বেরিয়ে আসতে পারেনা।
ঘ) পারিবারিক ছিন্ন বন্ধন:
আমাদের মতো তৃতীয়বিশ্বের দেশগুলোতে সামাজিক শিক্ষিত লোক খুবই কম। পরিবার গুলোতে জীবন এবং জীবিকাই প্রাধান্য পায় বেশী। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মাথাঘানোর মতো সময় এখানে থাকে না। তাই বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ে কোনো ছেলেই সঠিক স্নেহ ভালোবাসা পায় না। যেকারণে এই উন্মাদনার উদ্দাম সময়গুলোতে ছেলেরা পরিবার থেকে দূরে সরে যায় ধীরে ধীরে। পারিবারিক এই দূরত্ব একটি ছেলেকে তার পরিবার থেকে তাকে অনেক দূরে ঠেলে দেয়। যে দূরত্ব আর কখনোই হয়তো ঠিক হয় না।
পারিবারিক ভালোবাসা সহমর্মিতার অভাবে একটি ছেলে খারাপ পরিবেশে জড়িয়ে পড়ে। তার কাছে সুন্দর সম্পর্কের আর কোনো মূল্য থাকে না। নিষিদ্ধ জৈবিক আকৃষ্টতা তার মানবিক বোধ শক্তিকে নষ্ট করে ফেলে। সে উদ্দাম উত্তাল সময়ে ভুলে যায় সামাজিক সম্পর্ক গুলোর কথা। এই নিষিদ্ধ আকৃষ্টতা তাকে টেনে নিয়ে যায় পৈশাচিক জৈবিক তাড়নার দিকে। এবং এক সময় সে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে সমাজে নানান জায়গায় অপকর্মে পারদর্শী হয়ে উঠে। তাই পারিবারিক সুন্দর সামাজিক বন্ধন এই বয়সের ছেলেদের খুবই প্রয়োজন।
ঙ) সহজলভ্য পতিতাবৃত্তি:
সামাজিক বিভিন্ন কারণে নারীদের একটি শ্রেণী পতিতায় পরিনত হয়। জীবিকার জন্য তারা সস্তা পতিতাবৃত্তিতে লিপ্ত হয়। এই সস্তা পতিতাবৃত্তির কারণে বয়ঃসন্ধি ছেলেদের একটি বড় অংশ অপ্রাপ্তবয়স্ক অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। যারা এই ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হয়ে যায় তারা সহজে সেই পথ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না।
চ) ধর্মীয় অনুশাসন না থাকা:
একটি ছেলে জৈবিক তাড়নায় ধ্বংসের মূলে রয়েছে ধর্মীয় অনুশাসনহীন জীবন যাপন। যে পরিবার ধর্মীয় অনুশাসনের চর্চা করে সেই পরিবারের ছেলেরা সহজে এইসব অশ্লীল বিষয় মেনে নেয় না। তারা গোপন বিষয় গোপনে রাখতে শিক্ষা পায়। যারকারণে ধার্মিক পরিবারের সন্তানেরা নিজেদেরকে পাপ থেকে দূরে রাখতে সচেষ্ট হয়। কেননা তারা ছোট থেকেই একটি সুন্দর ধর্মীয় ব্যবস্থাপনায় বড় হওয়ার কারণে তাদের মধ্যে অশ্লীলতা কম কাজ করে। যে পরিবারে সঠিক ইসলামী অনুশাসনের চর্চা হয় সেইসব পরিবারের ছেলেরা এইসব কর্মকান্ডকে পাপ মনে করে দূরে থাকার চেষ্টা করে। তাই যে পরিবারে ধর্মীয় অনুশাসন নেই সেইসব পরিবারের সদস্যরা এই বয়সে অনৈতিক কাজে বেশী জড়িয়ে পড়ে।
ছ) রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্য:
বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্যের কারণে বয়ঃসন্ধিকালীন ছেলেদের বিভিন্ন অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে থাকার কারণে তাদের মধ্যে বেপরোয়া ভাব কাজ করে। এই বেপরোয়া ভাবের কারণে তারা বাঁধাহীনভাবে অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে জড়িয়ে পড়ে। এই খারাপ সময়টিতে তারা অশ্লীলতার চরম শিখরে পৌঁছে যায়। যেহেতু পরিবার থেকে বন্ধনহীন এবং সামাজিক ভাবে শক্তি প্রাপ্ত, সেহেতু তারা নিষিদ্ধ জগতে নিঃসংকোচে দাপিয়ে বেড়ায়। এই নষ্ট জীবনযাপন তাদের এক ধ্বংসাত্মক জীবনের মুখোমুখী করে দেয়। যা তারা পরবর্তী জীবনে অনুধাবন করতে পারে।
জ) গুরুত্বহীন জৈবিকতা:
আমাদের সমাজে ছেলেরা বালেগ হলে যে, তাদের ভিতরে একটি জৈবিক চাহিদা কাজ করে সেটা সমাজ এবং পরিবার উপেক্ষা করে। সমাজ এবং পরিবার কখনোই এইসব বুঝতে চেষ্টা করে না। তাদের অজ্ঞতার কারণে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হয় আমাদের দেশে। অথচ এই জৈবিক চাহিদা আর দশটি মানবিক চাহিদার মতোই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একটি মানুষ প্রচন্ড রোদে হেটে গেলে যেমন পানির জন্য তৃষ্ণার্ত হয়। ঠিক তেমনি যৌবনের প্রথম দিকে ছেলেদের এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। যা তাদের গোপন দরজার পাশে নয়তো ভাঙা বাড়ির অন্দরে নিজের নিকৃষ্ট যৌনাচারে লিপ্ত করে। সুতরাং এই জৈবিক চাহিদার কথা আমাদের উপেক্ষা করা উচিত নয়।
পরিবারের করণীয়:
একটি ছেলের এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যে প্রতিষ্ঠানটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে সেটি হচ্ছে পরিবার। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সুন্দর একটি বন্ধুত্বপূর্ন বন্ধন সবচেয়ে বেশী কাজ করে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে খুব কম পরিবারই এমন পাওয়া যায় যারা তাদের সন্তানদের রক্ষা করতে পারে। আমাদের সামাজিক কিছু সীমাবদ্ধতা এখনো রয়েছে। এখানে সন্তানের সাথে গোপন বিষয় গুলো খোলামেলা আলোচনা হয় না। এই সময়টিতে একটি মেয়ে পরিবারের অন্য মেয়ে সদস্য থেকে কিছু না কিছু সাপোর্ট পেয়ে থাকে।
কিন্তু সেই জায়গায় একটি ছেলে কখনোই সেই সাপোর্টটি পায় না। হতে পারে ধর্মীয় গোঁড়ামি অথবা অজ্ঞতা। তাই পরিবারের বিভিন্ন করনীয় রয়েছে ছেলেদের এই ধ্বংসাত্মক জীবন থেকে রক্ষা করার জন্য।
ক) বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক:
পরিবারের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক একটি ছেলেকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। একটি ছেলে যখন নিষিদ্ধ বিষয় গুলো সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা পায়, তখন সে তার কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত হতে পারে। যখন তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে কী ভালো আর কী খারাপ তখন সে নিজে নিজেই ভালো থাকতে চেষ্টা করবে যতটুকু পারা যায়।
তাই সবসময়ের মতো প্রতিটি পরিবারকে আগে এগিয়ে আসতে হবে এইসব ছেলেদের রক্ষা করতে। যখন একটি ছেলেকে বুঝানো হবে কী করলে কী ক্ষতি হতে পারে এবং কখন কী করার সঠিক সময়। তখন এইসব বিষয়ে অজ্ঞ ছেলেরা সঠিক বিষয় গুলো বুঝার চেষ্টা করবে। তাই পরিবারের উচিত তাদের বয়ঃসন্ধিকালীন ছেলেদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করে তাদের বিষয়গুলো সহজভাবে উপস্থাপন করে সমাধান দেওয়া।
খ) ধর্মীয় চর্চা:
প্রতিটি পরিবারের উচিত সঠিক ধর্মীয় চর্চা গুলো নিয়মিত করা। প্রতিটি সন্তানকে সঠিক নৈতিক জ্ঞান দেওয়া। সেইসাথে ধর্মীয় বিষয় গুলো সামনে এনে অশ্লীল পাপাচার থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করা।
গ) সঠিক নজরদারি:
এই বয়সের ছেলেদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগীরি করলে ফলাফল খুবই খারাপ হয়। তাই পরিবারের উচিত সন্তানের প্রতি সঠিক নজরদারি। ছেলে কখন কোথায় যায়। কার কার সাথে মেলামেশা করছে। যাদের সাথে মিশছে তাদের পারিবারিক চরিত্র এবং ইতিহাস জানা জরুরী। যদি কোন খারাপ পরিবেশ বা বন্ধুর সংস্পর্শে চলে আসে তবে তাকে সাথে সাথে সাবধান করে দিতে হবে। তাও জোরপূর্বক নয়। সুন্দর এবং চমৎকার উপস্থাপনার মাধ্যমে তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে, সে যার সাথে মিশছে সে কেন খারাপ। তার সাথে মেশার ফলে কী কী ক্ষতি হতে পারে ভবিষ্যতে।
যদি পরিবারের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে তাদের সাথে মিশে তাহলে ভবিষ্যতে সে কী কী সুবিধাবঞ্চিত হবে সে ব্যাপারে সঠিক ধারণা দেওয়া। এই ক্ষেত্রে বিভিন্ন দৃষ্টান্ত তার সামনে তুলে ধরতে হবে।
বর্তমান সময়ে ছেলেরা অনেক এগিয়ে আছে। এই বয়স সম্পর্কিত তাদের বিভিন্ন বই পড়তে দেওয়া যেতে পারে। এই বয়সের ক্ষতিকর দিক গুলো তুলে ধরে বিভিন্ন ডকুমেন্টারী দেখানো যেতে পারে। সেইসাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাদের সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখতে হবে। কখনোই তাদের একাকীত্বে থাকতে দেওয়া যাবে না। এই বয়সের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো নারী ঘটিত সমস্যা।
বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ের প্রথম চার পাঁচ বছরে ছেলেরা প্রচন্ড রকম আবেগী হয়। এই সময়টিতে তাদেরকে সঠিক পরিচর্যা করা না গেলে অনেক সময় ব্যাপক ক্ষতি হয়ে যায়। আমাদের দেশে এই বয়সের ছেলেমেয়েদের অপ্রাপ্তবয়স্ক প্রেমের হাজার হাজার ঘটনা ঘটছে। যা পরিবারের অজান্তে বিয়ে পর্যন্ত গড়িয়ে যায়। পরে পরিবারের হস্তক্ষেপেও এইসব সম্পর্ক টিকিয়েও রাখা যায় না। কেননা চরম উত্তেজনার সময়ে তারা যে ভুল করে। কিছুদিন যাওয়ার পর তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরে আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। তাই পরিবারের উচিত হবে তাদের সাথে সবসময় সার্বিক যোগাযোগ রাখা।
ঘ) কঠোর না হওয়া:
বয়ঃসন্ধিকালীন ছেলেদের সাথে কখনোই কঠোর আচরণ করা যাবেনা। প্রতিটি পরিবারের উচিত এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সাথে লক্ষ্য রাখা। অধিকাংশ ছেলেই বয়ঃসন্ধির মানসিক চাপ নিতে পারে না। কোনো ভুলের কারণে যদি ছেলেদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা হিতে বিপরীত হয়।
হঠাৎ কোনো শারিরীক ও মানসিক আঘাত পেলে ছেলেরা তা আজীবন মনে পুষিয়ে রাখে। পরিবারের যে সদস্য দ্বারা সে হেনস্তা হয় তাকে সে জীবনের তরে ভালো চোখে দেখে না। যারফলে একটি সুন্দর সম্পর্কের মৃত্যুর হয়। বয়ঃসন্ধিকালীন আঘাত ছেলেদের বিপথে যেতে ত্বরান্বিত করে। তাই যেকোনো পরিস্থিতিতে কখনোই ছেলেদের সাথে কঠোর হওয়া যাবেনা। সুন্দর সুদীপ্ত উপস্থাপনের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে। তাকে এটা বোঝাতে হবে যে আপনি তার ভবিষ্যৎ ভালোর জন্যই পরামর্শ দিচ্ছেন। আপনি যে তার হিতাকাংখী সেটা তাকে বুঝতে দিতে হবে।
ঙ) সঠিক সময়ে বিয়ে:
আমাদের দেশে সঠিক সময়ে ছেলেদের বিয়ে দেওয়া হয়না। যার কারণে ছেলেরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে খারাপ পথে জৈবিক প্রয়োজন মিটায়। সেটা হতে পারে নিজের শরীরের উপর অত্যাচার করে। অথবা অনৈতিক শারীরিক সম্পর্ক করে। তাই প্রতিটি পরিবারের উচিত ছেলেদের খোঁজ খবর নিয়ে প্রয়োজনে বিয়ে দিয়ে তাদের সঠিক পথে আনা।
চ) অবাধ তথ্যপ্রযুক্তি রোধ:
বর্তমান সময়ের ছেলেরা যে উৎস থেকে সবচাইতে বেশী ধ্বংসের দিকে চলে যাচ্ছে, তা হচ্ছে অবাধ তথ্যপ্রযুক্তি। আমাদের বর্তমান পিতামাতারা ছেলেদের ১৩ /১৪ বছর হওয়ার আগেই হাতে হাতে মোবাইল ধরিয়ে দিচ্ছেন। এই বাধা সর্বোচ্চ এসএসসি পর্যন্ত। প্রতিটি ছেলে কলেজে যাওয়ার সাথে সাথে মোবাইল পেয়ে যাচ্ছে। আর বাবা মায়েরাও ছেলেদের কাছে ওয়াদাবদ্ধ হয়ে যান মোবাইল দেওয়ার। কিন্তু এটা খুবই মারাত্মক একটি ভুল সিদ্ধান্ত। এই মোবাইল প্রতিটি ছেলের চরম উন্মাদনার যৌবন জ্বালার দাহ্য বস্তুর মতো। ছেলেদের এই অস্থির মুহূর্তে মোবাইলটি জ্বলন্ত উনুনে কেরোসিনের মতো। যা তাদের জ্বলে পুড়ে শেষ করার জন্য যথেষ্ট।
এই মোবাইলের দ্বারা আজ আমাদের সমাজে অপকর্মের ছাড়াছাড়ি। সহজ ইন্টারনেটের কারণে ঘরে দরজা বন্ধ করেই ছেলেরা ডুব দেই নষ্ট দুনিয়ার নীল পর্নোগ্রাফীতে। কোনো মা বাবাই জানতে পারে না তাদের সোনার টুকরো ছেলের তারা কী ক্ষতি করে ফেলেছে।
তাই ভার্সিটির আগে কখনোই ছেলেদের এনড্রয়েড ফোন দেওয়া যাবে না। যদি দিতেই হয় তবে স্কুল জীবনে নয়। আর তখনই দিতে পারবেন যখন আপনি নিজেই এই মোবাইলে পারদর্শী হবেন। কেননা আপনাকে অবশ্যই তার উপর নজরদারি রাখতে হবে। কেননা ছেলেকে নজরদারিতে না রাখলে ভবিষ্যতে আপনারই ক্ষতি।
সমাজের করণীয়:
এই বয়সের ছেলেরা সবচেয়ে বেশী যে সাপোর্ট বর্তমানে পাচ্ছে সেটা হচ্ছে সমাজ। সমাজের কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের কারণে এইসব ছেলেরা দিনদিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই আমাদের কিশোর সমাজকে সঠিক পথে টিকিয়ে রাখতে হলে সমাজের বিশেষ ভূমিকা পালন করা দরকার।
ক) সহজ পতিতাবৃত্তি বন্ধ:
সমাজের আনাচে কানাচে সহজলভ্য যে পতিতাবৃত্তি চলে তা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। যাতেকরে কোনো কিশোর হাত বাড়ালেই নষ্ট জায়গার খোঁজ না পায়।
খ) কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ:
রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে সমাজে বিভিন্ন কিশোর গ্যাংস্টার সৃষ্টি করে এক শ্রেণীর স্বার্থবাদী মানুষ। তাদের প্রশ্রয়ে এইসব উঠতি বয়সের ছেলেরা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করে যখন তারা পরিবার থেকে বাঁধাহীন হয়ে যায়। এবং সেইসাথে সমাজের বড়ভাইয়ের আশ্রয় পায়। তখন তারা সহজেই যেকোনো পাপে জড়িয়ে পড়ে। এই জৈবিক পাপ যে কত ভয়ংকর তারা সেই সময় কখনোই টের পায় না। তাই সমাজ থেকে কিশোর গ্যাংস্টার সৃষ্টি বন্ধ করতে হবে।
গ) মুরুব্বীদের শাসন:
গত দশ পনেরো বছর ধরে আমাদের সমাজে মুরুব্বীদের শাসন উঠে গেছে। যদিও এর অনেক গুলো কারণ রয়েছে। কিন্তু এটা একটি সমাজে খুবই প্রয়োজন। আগে এক সময় রাস্তাঘাটে ছেলেরা যেমন তেমন ভাবে পোশাক পড়তে বা চুলের ফ্যাশন করে কাটিং দিতো পারতো না। সমাজে ইভটিজিং ছিলো না। কিন্তু এখন রাজনৈতিক পেশিশক্তির কারণে সমাজে রাজনৈতিক নেতার দাপটে সমাজের মুরুব্বীদের ক্ষমতা কমে গেছে। যারফলে সামাজিক শাসনের যে শিকল ছিলো তা ছিঁড়ে গেছে। এই শাসন শৃঙ্খলা ধ্বংস হওয়ার কারণে সমাজে উঠতি বয়সের ছেলেরা বিভিন্ন অপকর্মের পাশাপাশি অনৈতিক শারীরিক সম্পর্কের জন্য যথেষ্ট সুযোগ এবং সুবিধা নিচ্ছে। এইসব খবর অনেকক্ষেত্রে তাদের পরিবারও জানে না।
ঘ) সৃজনশীলতার বিকাশ:
আমাদের দেশে একটি সময় ছিলো যখন ছেলেরা দল বেধে বিভিন্ন সামাজিক সংঘটনে কাজ করত। বিশেষ করে প্রতিটি পাড়া মহল্লায় ক্লাব ছিলো। ক্লাবের উদ্যোগে খেলাধুলাসহ বিভিন্ন সৃজনশীল কাজ হতো। যা গত দশ পনেরো বছরে স্তিমিত হয়ে পড়েছে। এইসব সুষ্ঠ সৃজনশীল চর্চা একটি সমাজের ছেলেমেয়েদেরকে সুন্দর পথে চলতে সাহায্য করে। তারা যখন এইজাতীয় বিভিন্ন ভালো কাজে নিমগ্ন থাকে তখন তারা খারাপ পরিবেশ এবং নষ্ট সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকতে পারে। তাই যদি সুন্দর একটি কিশোর সমাজ চাইলে আমাদের অবশ্যই খেলাধুলাসহ ইসলামী সংস্কৃতির সৃজনশীল সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করতে হবে।
মুক্তির পথ:
ক) ধর্মীয় অনুশাসন:
বয়ঃসন্ধিকালীন এইসব ছেলেদের ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে একমাত্র মুক্তির পথ হচ্ছে ধর্মীয় অনুশাসন। সমাজ এবং পরিবারে যদি সঠিক ধর্মীয় অনুশাসনের চর্চা করা হয় তাহলে আমরা খুব সহজেই এই খারাপ পরিস্থিতি থেকে কিশোর সমাজকে উদ্ধার করতে পারি। যদি ছোট থেকেই ধর্মীয় নৈতিক শিক্ষা দেওয়া হয় তবে তাদের মধ্যে অশ্লীলতা নিয়ে ধর্মীয় ভীতি কাজ করবে। আর যে পরিবারে ধর্মীয় সঠিক জ্ঞান শিক্ষা দেওয়া হয় সেই পরিবারের ছেলেরা সর্বদা আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকে। আল্লাহর সত্যিকারের ভয় থাকার ফলে তারা দুনিয়াবী পাপ থেকে সবসময় দূরে থাকার চেষ্টা করে। যার ভিতর আল্লাহর ভয় কাজ করে তাকে আল্লাহ নিজেই সাহায্য করে। সুতরাং প্রতিটি পরিবারের উচিত ছেলেদের সঠিক ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া।
খ) সঠিক সময়ে বিয়েঃ
আমাদের সমাজে একটি ভুল রীতি চালু আছে। তা হচ্ছে ছেলেদের বয়স হয়ে গেলেও সঠিক সময়ে বিয়ে না করানো। একটি ছেলে বালেগ হয় চৌদ্দ পনেরো বছরে। এই বসয় থেকেই ছেলেদের ভিতরে তীব্র জৈবিক চাহিদা কাজ করে। এই তীব্রতা কোনো বাঁধা বা কথা মানে না। এই জৈবিক জোয়ারে ছেলেরা প্রায় পথহারা হয়ে যায়। তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করতে হলে বা পাপ থেকে দূরে রাখতে হলে অবশ্যই সঠিক সময়ে বিয়ে দিতে হবে।
আমাদের দেশে ছেলেরা প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে করতে পারে না। অথবা বোনের বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত ছেলেদের বিয়ে করতে দেওয়া হয় না। এই দীর্ঘ একটি সময় ছেলেরা কীভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করবে পাপ না করে? এই পাপের দায়িত্ব প্রতিটি মা বাবাকে নিতে হবে। আগের দিনে ছেলেরা বিয়ে করেও পড়াশোনা করতো। এখন পড়াশোনা শেষ করার পরও আরো দু চার বছর পর চাকরি, এরপর আরো চার বছর পর বিয়ের চিন্তা করে পরিবার। যা মোটেই সঠিক নয়। ছেলেদের আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত হতে জোর দিতে হবে। সেইসাথে পরিবারকেও সাহায্য করতে হবে ছেলেদের সঠিক পথে আসার।
অনেক সময় দেখা যায় ছেলেরা একেবারে খারাপ হয়ে গেলে তারপরে বিয়ে করায়। কিন্তু ততদিনে সব শেষ হয়ে যায়। এইসব ছেলেরা যে বিয়ে করার পরও সঠিক পথে এসেছে তার কোনো প্রমাণ নেই। তাই আমাদের উচিত সঠিক সময়ে ছেলেদের বিয়ে দিয়ে তাদেরকে খারাপ পথ থেকে ফিরে আসতে সাহায্য করা।
সর্বশেষ কথা:
বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ে একটি ছেলে যে কী পরিমাণ কষ্টে থাকে তা ঐ বয়সী একটি ছেলে ছাড়া আর কেউ বর্ণনা করতে পারবে না। এই ক্ষুদ্র বয়সে হঠাৎ করে বড় হয়ে যাওয়া সে সহজে মেনে নিতে পারে না। এর কারণ পরিবার এবং সমাজ তাকে মানসিক ভাবে বড় না করে শারীরিক ভাবে বড় ভেবে ফেলে আচরণ করতে থাকে। যারকারণে সে বুঝে উঠতে পারে না আসলেই সে ছোট না কি বড়।
সেইসাথে নিজের শারীরিক কৌতূহল থেকে নিত্যনতুন অভিজ্ঞতা নিতে সে পা বাড়ায় খারাপ পথে। একান্ত গোপনে এমন সব কিছু করে যা তাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। এই ধ্বংস হতে পারে শারীরিক হতে পারে নৈতিক, হতে পারে ধর্মীয়। তাই এদের সাহায্য করতে আমাদের প্রতিটি পরিবার এবং সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে।