বিজ্ঞানী’ শব্দটা শুনলে আমাদের অনেকের মনে এমন একজন মানুষের প্রতিরূপ ভেসে ওঠে, যিনি কি না তাঁর কর্মক্ষেত্র ব্যতীত জগৎ-সংসারের আর সব থেকে বিচ্ছিন্ন। সমাজ ও তাঁর চারপাশে কী হচ্ছে, সে বিষয়ে তিনি অবগত নন, কিংবা এসব বিষয় তাঁকে নাড়া দেয় না। কিন্তু ধারণাটি যুগে যুগে ভুল প্রমাণ করে এসেছেন মহান বিজ্ঞানীরা। সমাজের নানা বাধা বিপত্তিকে উপেক্ষা করে তাঁরা একদিকে যেমন তাঁদের কাজ চালিয়ে গিয়েছেন, একইভাবে তাঁদের কাজের দ্বারা মানবসমাজের সমস্যা দূর করতেও ব্রতী হয়েছেন।
সমাজ ও জনগণ থেকে তাঁরা ও তাঁদের কাজ যে বিচ্ছিন্ন নয়, এবং তাঁদের কাজের পরিসীমা যে কেবল গবেষণাগারে নিবদ্ধ নয়, তা তাঁরা জীবনভর প্রমাণ করে গিয়েছেন। আর এমন জীবনের উদাহরণ খুঁজতে হলে আমাদের দূরদেশে যেতে হয় না। আমাদের দেশেই জন্মেছিলেন এমন জনদরদী একজন বিজ্ঞানী। তাঁর নাম আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বা সংক্ষেপে পি. সি. রায়। তাঁর পরিচয় এক শব্দে দেওয়া দুঃসাধ্য। তিনি একাধারে ছিলেন অধ্যাপক, জ্ঞান তাপস রসায়নবিদ লেখক, সমাজসেবক, স্বদেশী ব্যবসার উদ্যোক্তা ও ভারতবর্ষে রাসায়নিক শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রথম স্থপতি।
ভুবনমোহিনী দেবী ও হরিশচন্দ্র রায়ের পুত্র প্রফুল্ল চন্দ্র রায় তৎকালীন যশোর জেলার রাড়ুলি গ্রামে ১৮৬১ সালের ২ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। বাবা হরিশচন্দ্র রায় ছিলেন স্থানীয় জমিদার। বনেদি পরিবারের সন্তান প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের পড়ালেখা শুরু বাবার প্রতিষ্ঠিত এমই স্কুলে। ১৮৭২ সালে তিনি কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন, কিন্তু রক্ত আমাশায় রোগের কারণে তার পড়ালেখায় ব্যাপক বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। বাধ্য হয়ে তিনি নিজ গ্রামে ফিরে যান।
১৮৭৪ সালে পুনরায় কলকাতায় ফিরে অ্যালবার্ট স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকেই ১৮৭৮ সালে তিনি স্কুল ফাইনাল তথা প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।এরপর তিনি মেট্রোপলিটন কলেজে (বর্তমান বিদ্যাসাগর কলেজ) ভর্তি হন। ১৮৮১ সালে সেখান থেকে কলেজ ফাইনাল তথা এফএ পরীক্ষায় (এইচএসসি) পাশ করে তিনি প্রেসিডেন্সী কলেজে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন। এরপর প্রেসিডেন্সী থেকে গিলক্রিস্ট বৃত্তি নিয়ে তিনি স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যান। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বিএসসি পাশ করেন এবং সেখানে ডিএসসি ডিগ্রী লাভের জন্য গবেষণা শুরু করেন। দুই বছরের কঠোর সাধনায় তিনি এই গবেষণা সমাপ্ত করেন এবং পিএইচডি ও ডিএসসি ডিগ্রী লাভ করেন।
এমনকি তার এই গবেষণাপত্রটি শ্রেষ্ঠ মনোনীত হওয়ায় তাকে হোপ প্রাইজে ভূষিত করা হয়।
বিজ্ঞানী পিসি রায় ১৮৮৮ সালে দেশে ফিরে প্রেসিডেন্সী কলেজের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। প্রায় ২৪ বছর অধ্যাপনাকালে রসায়ন নিয়ে তিনি অনেক গবেষণাও চালিয়েছেন। তার নিজস্ব গবেষণাগার থেকেই বেঙ্গল কেমিক্যাল কারখানা সৃষ্টি হয়।
১৯০১ সালে তা কলকাতার মানিকতলায় ৪৫ একর জমিতে স্থানান্তর করা হয়। তখন নাম রাখা হয়, বেঙ্গল কেমিক্যাল এন্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস লিমিটেড। যা ভারতবর্ষের শিল্পায়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
১৮৯৫ সালে তিনি মার্কারি (ও) নাইট্রেট (মারকিউরাস নাইট্রাইট) আবিষ্কার করেন। যা বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। এটি তাঁর অন্যতম প্রধান আবিষ্কার। তিনি তাঁর সমগ্র জীবনে মোট ১২টি যৌগিক লবণ এবং ৫টি থায়োএস্টার আবিষ্কার করেন। কেবল চাকরি লাভের জন্য শিক্ষিত হওয়ার ইচ্ছা ও প্রচেষ্টার মনোভাব থেকে বের হয়ে আসতে প্রফুল্লচন্দ্র আজীবন বাঙালি শিক্ষার্থীদের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তৎকালীন সমাজে, শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা লাভ করে কতিপয় পেশাতে নিয়োজিত হওয়াকেই শিক্ষার লক্ষ্য মনে করতেন। আর, সেসব চাকরি না পেলে তাঁরা অভাবেই দিন কাটাতেন। প্রফুল্লচন্দ্র শিক্ষার্থী ও তরুণদের এমন মানসিকতা দেখে সর্বদা পীড়িত হতেন। তবে অন্যান্য অনেকের সাথে তাঁর পার্থক্য ছিল এই যে – শুধু পীড়িত হয়ে বসে না থেকে তিনি এ নিয়ে লেখালেখি করতেন।
একই সাথে, তিনি দৃষ্টান্ত স্থাপনস্বরূপ স্বদেশী ব্যবসার গোড়াপত্তন করেছিলেন এবং গড়ে তুলেছিলেন একদল প্রকৃত বিজ্ঞান শিক্ষার্থী, যে শিক্ষার্থীরা পৃথিবীর জ্ঞানভাণ্ডারের সমৃদ্ধিতে মৌলিক অবদান রেখেছেন। প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর অধ্যাপনার গুণে ছাত্রদের আকৃষ্ট করে ভারতীয় রসায়ন বিজ্ঞানী গোষ্ঠীর সৃষ্টি করেন এবং ভারতে রসায়ন চর্চা তথা গবেষণার পথ উন্মুক্ত করেন। প্রেসিডেন্সী কলেজে শিক্ষকতার সময় তাঁর বিখ্যাত ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, নীলরতন ধর, পুলিনবিহারী সরকার, রসিকলাল দত্ত, মেঘনাদ সাহা, প্রমুখ। ছাত্রদের সঙ্গে তাঁর নিবিড় প্রীতির বন্ধন ছিল। ছাত্রদের দীক্ষা দিতেন এই বলে -“গরিব মানুষের পয়সায় লেখাপড়া শিখছিস। এদের কৃতজ্ঞতার ঋণের বোঝা কিন্তু একদিন ফিরিয়ে দিতে হবে।”
অধ্যাপনার পাশাপাশি দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য তিনি কাজ শুরু করেছিলেন। এজন্য, তিনি দেশি-ভেষজ পদ্ধতি ব্যবহার করে শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠার কথা ভাবেন। তাঁর এসব উদ্যোগের মিলিত রূপই হল “বেঙ্গল কেমিক্যাল কারখানা”। এটি পরবর্তীকালে পরিণত হয় বিশাল “বেঙ্গল কেমিক্যাল এন্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস লিমিটেড” নামের প্রতিষ্ঠানে। এটিই ভারতবর্ষের রাসায়নিক দ্রব্য ও ওষুধ প্রস্তুতের প্রথম কারখানা। সে সময়ে ভারতে বিদেশি ওষুধের সাথে পাল্লা দিয়ে দেশীয় এ কোম্পানী প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রফুল্লচন্দ্র স্বীয় শ্রমে এখানে ওষুধ তৈরি থেকে শুরু করে এর প্রচার এবং বিক্রি করার কাজ পর্যন্ত করেছেন। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে উৎসারিত এসব কাজের পাশাপাশি তিনি কয়েকবার বৃহত্তর আকারে ত্রাণ কর্মসূচীর কাজে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন এবং দিক নির্দেশনা দেন। বাংলায় তখন ঘন ঘন বন্যা হত।
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ছিলেন প্রকৃত দেশপ্রেমিক। বিজ্ঞানের মাধ্যমে দেশের উন্নতি সাধন করা তথা পরাধীন ভারতীয়দের আত্মমর্যাদাকে বাড়ানোই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য।স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী বীরদের প্রতি তাঁর ছিল গভীর সহানুভূতি। সব ধরনের জাতীয় শিক্ষা, শিল্পোদ্যোগের প্রতি অকৃপণ সহায়তা ও মানবকল্যাণে অর্জিত অর্থের অকাতর বিতরণ তাঁকে দেশবাসীর সামনে বিশিষ্ট করে তুলেছে। এই মহান বিজ্ঞানী ক্লাসে বাংলায় লেকচার দিতেন এবং তাঁর বাচন শৈলী ছিল অসাধারণ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন শিক্ষার উন্নতিকল্পে তিনি প্রায় দু লক্ষ টাকা দান করেন। দরিদ্র ছাত্রদের অর্থসাহায্যও তিনি করতেন। জাতিভেদ, বাল্যবিবাহ, পণপ্রথা প্রভৃতি হিন্দু সমাজের কুসংস্কারের বিরোধী ছিলেন তিনি। ভূমিকম্প, বন্যা, দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি দেশের প্রাকৃতিক বিপর্যয় তিনি অকাতরে দান করেছিলেন।
১৯৪৪, ১৬ জুন। প্রয়াত হন অকৃতদার এই মনীষী। কিন্তু তাঁর প্রয়াণের পরে, এমনকি তাঁর জীবিত অবস্থাতেও বাঙালি, ভারতীয়রা কতটা রক্ষা করতে পেরেছে প্রফুল্ল-ঐতিহ্য? জীবিত অবস্থায় তাঁর শেষ জন্মদিন পালিত হয় মেঘনাদ সাহার উদ্যোগে। কিন্তু এ জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে তিনি সমস্যায় পড়েছিলেন। আর প্রফুল্লচন্দ্রের মৃত্যুর পরে সমসময়ে তাঁর সাধের শিল্প প্রতিষ্ঠানটি নিয়েও নানা প্রশ্ন সামনে আসে! দুঃসাধ্য অধ্যবসায়ে জয় করবে নব নব জ্ঞানের সম্পদ। আচার্য নিজের জয়কীর্তি নিজে স্থাপন করেছেন উদ্যমশীল জীবনের ক্ষেত্রে, পাথর দিয়ে নয়, প্রেম দিয়ে। আমরাও তার জয়ধ্বনি করি।’’ সেদিন প্রফুল্লচন্দ্রকে পাশে বসিয়ে ‘রবীন্দ্রনাথ’ কথাগুলি বলেছিলেন। আজ তাঁদের কেউই নেই। রয়ে গেছে তাঁদের স্মৃতিগুলো।
আমরা কতটা তার বিজ্ঞান চর্চা সাধনাকে প্রাত্যহিক জীবনে প্রয়োগ ঘটাতে পেরেছি। আমরা যেদিন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের মতো বিজ্ঞানীদের সামাজিক অবদান ও জীবন দর্শনকে মেনে চলতে পারবো তবেই আমাদের বিজ্ঞান সচেতনতার প্রসারের পাশাপাশি আমাদের দেশ ও জাতির উত্তরণ কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছাবে। পরিশেষে এই মহান বিজ্ঞান মনীষীকে জন্মদিনে জানাই অন্তস্থ ভালোবাসা শ্রদ্ধা ও প্রগাঢ় ভক্তি।
✍️এই নিবন্ধটি সাময়িকীর সুন্দর এবং সহজ জমা ফর্ম ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। আপনার লেখা জমাদিন!