অজাতশত্রু ছিলেন ভারতের প্রাচীন জনপদ, মগধের রাজা। এর অপর নাম কূনিত।
অজাতশত্রু জীবনী
অজাতশত্রুর পিতার ছিলেন রাজা বিম্বিসার। বিম্বিসার-এর স্ত্রী কোশলদেবীর গর্ভে তাঁর পুত্র অজাতশত্রুর জন্ম হয়। কথিত আছে অজাতশত্রু তাঁর পিতা বিম্বিসারকে কারাগারে প্রেরণ করেন। পরে তিনি পিতার হাত-পা কেটে তাতে নুন এবং অম্ল মাখিয়ে কষ্ট দেন। এরপর তাঁকে কয়লার আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেন। এই শোকে তাঁর মা কোশলদেবী মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
ধারণা করা হয় বিম্বিসার খ্রিষ্টপূর্ব ৪৯০-৪৯৩ অব্দের দিকে মৃত্যুবরণ করেন। সেই হিসেবে তাঁর রাজত্বের শুরু হিসেবে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৯০-৪৯৩ অব্দ ধরা হয়। সিংহাসন লাভের পর, অজাতশত্রু গঙ্গানদীর তীরস্থ পাটলিগ্রামে একটি ছোট দুর্গের মতো একটি বসতি তৈরি করেন।
বিম্বিসার-এর স্ত্রী এবং অজাতশত্রুর মা কোশলদেবী ছিলেন কোশল-রাজ প্রসেনজিৎ-এর বোন। বোনের অকাল মৃত্যুর জন্য প্রসেনজিৎ অজাতশত্রুকে দায়ী করেন এবং বোনের হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য প্রসেনজিৎ মগধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এই সুযোগে বৈশালীর বৃজি ও পাবার মল্লরাও মগধের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। কিন্তু বিম্বিসার-এর গড়া বিশাল সুদক্ষ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো বাহিনীই জয়লাভ করতে সক্ষম হয় নি। পরাজয় অনিবার্য মেনে প্রসেনজিৎ শেষ পর্যন্ত অজাতশত্রুর সাথে সন্ধি করতে বাধ্য হন। সন্ধির শর্ত অনুসারে প্রসেনজিৎ তাঁর কন্যা ভাজিরার সাথে অজাতশত্রুর বিবাহ দেন। এই সময় বিবাহের যৌতুক হিসেবে প্রজেনজিৎ কাশী অঞ্চলকে অজাতশত্রুর হাতে অর্পণ করেন। এই ঘটনার পর থেকে কোশল রাজ্যের পতন শুরু হয়।
কোশল-রাজ প্রসেনজিতের সাথে দ্বন্দ্ব মিটে যাওয়ার পর, অজাতশত্রু বৈশালীর বৃজি ও পাবার মল্লরাদের শায়েস্তা করার জন্য উদ্যোগ নেন। তিনি প্রথমে গঙ্গা এবং শোন নদীর সঙ্গমস্থলে পাটালিগ্রামে একটি অস্থায়ী দুর্গ নির্মাণ করেন। এরপর কূটনৈতিক তৎপরতায় স্থানীয় ছোট ছোট রাজ্যগুলোর ভিতরে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেন। এরপর দুর্বল রাজ্যগুলো আক্রমণ করে নিজ রাজ্যের অধিকারের আনেন। টানা ১৬ বৎসর যুদ্ধ করার পর অজাতশত্রু সমগ্র বৈশালী জয় করতে সক্ষম হন।
‘অবদান-শতক’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, প্রথম জীবনে তিনি বৌদ্ধ ধর্মের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাঁর পিতা বিম্বিসার ছিলেন গৌতম বুদ্ধের ভক্ত। তিনি তাঁর অন্তঃপুরে বুদ্ধের পায়ের নাখ ও চুলের উপর একটি স্তূপ নির্মাণ করেছিলেন। অজাতশত্রু বিম্বিসার মৃত্যুর পর এই স্তূপে পূজা বন্ধ করে দেন। এক দাসী গোপনে পূজা দিতে গেলে তাকে হত্যা করা হয়। এরপর তিনি প্রজাদের গৌতম বুদ্ধের কাছে যাওয়া নিষেধ করে দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি পিতাকে হত্যা করার জন্য দারুন মনোকষ্টে ভুগতেন। এই পরিতাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তিনি বুদ্ধের সাথে দেখা করেন। ত্রিপিটকের সূত্রপিটকের দীর্ঘনিকায় অংশের ‘সামঞ্ঞ ফল সূত্রে’ দেখা যায়, তিনি গৌতম বুদ্ধের সাথে দেখা করে দীর্ঘ আলাপ করেছেন। পরিশেষে তিনি বুদ্ধের কাছে পিতৃহত্যার কথা স্বীকার করে তার প্রতিকার প্রার্থনা করেছেন।
গৌতম বুদ্ধ নির্বাণলাভের পর, অল্প দিনের ভিতরে মতাদর্শগত বিভেদ প্রকট হয়ে উঠে। তা ছাড়া এই সময়ের ভিতরে বুদ্ধের যোগ্য শিষ্যদের অনেকে মৃত্যুবরণও করেন। বুদ্ধের বাণী এবং তার ব্যাখ্যা বিলীন হওয়া বা বিকৃত হওয়ার আশংকা তীব্রতর হয়ে উঠে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য, ৪৮৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মগধের মহারাজ অজাতশত্রুর সহায়তায় মহাকাশ্যপ এক বৌদ্ধসভার আয়োজন করেন। কথিত আছে রাজগৃহের সপ্তপর্ণী নামক গুহায় এই সভায় যোগদান করেছিলেন। এই সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে বুদ্ধের অন্যতম শিষ্য আনন্দের নেতৃত্বে সংগৃহীত হয়েছিল ধর্মাংশ এবং আর বুদ্ধের অপর শিষ্য উপালি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিনায়ংশ। পরে এই দুই সংগ্রহকে বিষায়ানুসারে ভাগ করে, তৈরি করা হয়েছিল বিনয়পিটক ও সূত্রপিটক। পরে সূত্রপিটকের একটি অংশ পৃথক করে অভিধম্মপিটক নামক তৃতীয় পিটক তৈরি করা হয়। এই তিনটি পিটকের সংকলনই হলো ত্রিপিটক।
একই সাথে তিনি জৈন ধর্মকে বিশ্বাস করতেন। তিনি বহুবার সপরিবারে জৈনগুরু মহাবীরের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন।
পালি সাহিত্যে জাতকের গল্প থেকে জানা যায় যে, অজাতশত্রু নিষ্ঠুর প্রকৃতির রাজা ছিলেন। তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬০ অব্দের দিকে মৃত্যবরণ করেন। এঁরপর তাঁর পুত্র উদয়ন ৪৬০-৪৪০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। জাতকের গল্প থেকে জানা যায় যে, যেদিন অজাতশত্রর আদেশে তাঁর পিতাকে হত্যা করা হয় সেদিনই উদয়ন জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু পুরাণ মতে অজাতশত্রুর পুত্রের নাম ছিল দারসোকা। আর উদয়ন ছিলেন দারসোকার পুত্র। এই বংশের শেষ রাজা নাগদাসকে হত্যা করে তাঁর মন্ত্রী শৈশুনাগ মগধের সিংহাসন অধিকার করেন।
তথ্যসূত্র:
- ভারতের ইতিহাস। অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।
- পালি সাহিত্যে বৌদ্ধ উপাখ্যান: রসবাহিনী এবং অন্যান্য গ্রন্থ। দীপংকর শ্রীজ্ঞান বড়ুয়া
- সূত্রপিটক দীর্ঘ-নিকায় (প্রথম খণ্ড)। অনুবাদক রাজগুরু শ্রীমৎ ধর্মরত্ন মহাস্থবির। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দ।
- হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনা-সংগ্রহ (তৃতীয় খণ্ড)। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ। জুলাই ২০০১।