চেঙ্গিশ খান
চেঙ্গিশ খান (১১৬২-১২২৭ খ্রিষ্টাব্দ) ছিলেন মোঙ্গল জাতির অন্যতম যোদ্ধা, সামরিক নেতা, চেঙ্গিশবংশীয় রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা।
১১৬২ খ্রিষ্টাব্দে আধুনিক মঙ্গোলিয়ায় উত্তরাঞ্চলের খেনতি পর্বতমালার অন্তর্ভুক্ত বুরখান খালদুন পর্বতের খুব কাছে দেলুন বলদাখ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর শৈশব কেটেছিল ওনন নদীর পাড়ে তৃণচারণ ভূমিতে।
চেঙ্গিশ খানের পিতা ইয়েসুকাই ছিলেন মোঙ্গলদের একটি গোষ্ঠীর অধিপতি। জন্মের পর চেঙ্গিশ খানের নাম রাখা হয় তেমুইন। তাঁর নয় বছর বয়সের সময় তাঁর বাবা বিপক্ষীয় উপজাতীদের হাতে নিহত হন। এই কারণে পরবর্তী কয়েক বছর তাঁর পরিবারের ভয়ে আত্নগোপন করে থাকে। পরিবারে ছিলেন তাঁর মা, তিনি নিজে এবং তার তিন জন ছোট ভাই ছিল। তাদের কোনো সহায়-সম্পত্তি ছিল না।এই সময় তার পরিবারের ওপর নির্ভরশীল লোকেরাও একে একে সরে পড়েছিল। এই সময় তার পরিবারের গৃহপালিত পশুগুলো পর্যন্ত প্রতিপক্ষরা ছিনিয়ে নেয়া হল।
চেঙ্গিশ খান বড় হওয়ার পর একজন অত্যন্ত ভাল অশ্বারোহী সৈনিক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। প্রথম দিকে তাঁর ইচ্ছা ছিল বাবার আগের শক্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। ১২০৩ খ্রিষ্টাব্দের দিকে জামুখার নামক এক বাহিনীর সাথে যুদ্ধে পরাজিত হন। এরপর থেকে তিনি নিজের বাহিনীকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেন।
চেঙ্গিশ খান প্রথমেই নিকটস্থ একটি বড় জাতির নেতার সঙ্গে বন্ধুত্ব করলেন। তিনি ওই জাতির নেতার সঙ্গে মাঝা মাঝে বাইরে শিকার করতে যেতেন। রাতে একই তাবুতে ঘুমাতেন। মাঝে মাঝে তিনি নেতার পরিবারের সবাইকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়াতেন। ধীরে ধীরে দু’জনের মধ্যে মৈত্রী খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল। তা ছাড়া, চেঙ্গিশ খানের ওপর জাতির জনসাধারণের আস্থাও দিন দিন বাড়ছিল। তারা চেঙ্গিশ খানের যোগ্যতা সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করতো। তারা মনে মনে ভাবতো যে, চেঙ্গিশ খান ‘খো হ্যান’ হবার যোগ্য। ‘খো হ্যান’ মানে মঙ্গোলীয় জাতির সর্বোচ্চ প্রশাসক। তাদের আন্তরিক পরার্মশ শুনে কয়েকজন উপপদস্থ কর্তা একসঙ্গে এ-ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনা করলেন।
অবশেষে তারা একমত হলেন যে, ‘খো হ্যান’ হবার জন্য চেঙ্গিশ খানই সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর, তারা সবাই চেঙ্গিশ খানের সামনে এসে বললেন: ‘ঈশ্বর আপনাকে আমাদের জাতির সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে বাছাই করেছেন। আমাদের কোন আপত্তি নেই। এখন থেকে আপনার নেতৃত্বে আমরা সম্মিলিত হয়ে শত্রুদের সঙ্গে লড়াই করবো। এখন থেকে যদি আমরা আপনার নির্দেশ না-শুনি, তবে আপনি আমাদেরকে মেরে ফেলতে পারেন।’ তখন থেকেই চেঙ্গিশ খান মঙ্গোলীয় জাতির সর্বোচ্চ প্রশাসক হলেন। ঘটনা ঘটেছিল ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। এই খো হ্যান শব্দ থেকেই পরবর্তী সময়ে খান উপাধি দেন।
১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে চেঙ্গিশ খানের বাহিনী মোঙ্গলীয় জাতির পশ্চিম অঞ্চলের শেষ উপজাতির সঙ্গে লড়াই হয়। দু’পক্ষের মধ্যে লড়াই চলেছিল প্রায় এক মাস ব্যাপী। এই যুদ্ধে চেঙ্গিশ খানের বাহিনী জয়লাভ করে। এই উপজাতির সর্বোচ্চ নেতা আত্মসমর্পন করলে, চেঙ্গিশ খানের নাম গোটা মোঙ্গলীয় মালভূমিতে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর তিনি গোটা মোঙ্গোলীয় মালভূমির জমি তার আত্মীয়স্বজন ও ছোট-বড় নেতাদের মাঝে বণ্টন করে দেন। এছাড়া ১৬ বছর বেশি এবং ৭০ বছর কম বয়সী পুরুষ মানুষদের তিনি সেনাবাহিনীতে নেন। এই সৈনরা শান্তির সময় তারা চাষাবাদ করতো এবং যুদ্ধের সময় করতো যুদ্ধ।
সে সময় মোঙ্গলিয়া চীনের অধীনে ছিল। চীনের আধিপত্য বিনষ্ট করার জন্য, তিনি তাঁর সেনাবাহিনীকে অত্যন্ত শক্তিশালী করে গড়ে তোলেন। ১২১১ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে তিনি ও তার চার ছেলে জিন রাজবংশের বিরুদ্ধে অভিযানের আয়োজন সুসম্পন্ন করেন। মাত্র তিন মাসের মধ্যে তারা চীন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন জনডু বা বতর্মানের পেইচিং অঞ্চলে পৌঁছে গেলেন। এই অভিযানে বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন তাঁর তৃতীয় পুত্র ওগেদাই খান এবং চতুর্থ পুত্র তোলুই খান।
সেনাবাহিনী গড়ার পর, তিনি ও তার চার ছেলে (জোসি খান, চাগতাই খান, ওগেদাই খান ও তোলুই খান) চীন অভিযান শুরু করেন। মাত্র তিন মাসের মধ্যে তাঁরা চীন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন জনডু বা বতর্মানের পেইচিং অঞ্চলে পৌঁছে গেলেন। লড়াইয়ে চেঙ্গিশ খানের বাহিনী চীন রাষ্ট্রের সৈন্যদের কাছ থেকে তিন হাজার ঘোড়া ও অজস্র মূল্যবান জিনিস ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়। যুদ্ধে পরাজয়ের পর, চীনের রাজা জুনডু থেকে পালিয়ে বিনলিয়েন নামক একটি জায়গায় চলে যান।
১২১৯ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে চেঙ্গিশ খানের সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল প্রায় দুই লক্ষ । এরপর তিনি মধ্য এশিয়া অভিযান চালান এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি জয়ী হন। এই সময় পারস্য ও কেন্দ্রীয় এশিয়ায় শাসক খারজুম শাহ মুহাম্মদের সঙ্গে বৈরিতার সৃষ্টি হয় চেঙ্গিশ খানের। ১২২০ খ্রিষ্টাব্দে চেঙ্গিশ খান, তৎকালীন পারস্য সাম্রাজ্যের অন্যতম নগর সমরকন্দ দখল করেন এবং নগরটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিলেন।
এরপর ১২২১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি খারজুম রাজ্য আক্রমণ করেন। খারজুমের সুলতান কাস্পিয়ান সাগরের দিকে পালিয়ে গেলে, এই রাজ্য তাঁর অধিকারে আসে। অন্যদিকে এই রাজ্যের যুবরাজ জালাল উদ্দিন মাঙ্গবার্নী পাঞ্জাবে আশ্রয় নেন। চেঙ্গিশ খাঁ তাঁকে অনুসরণ করে সিন্ধু পর্যন্ত অগ্রসর হন। এই সময় চেঙ্গিশ খাঁ পশ্চিম-পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালান। উপায়ান্তর না দেখে মাঙ্গবার্নী ইলতুৎমিস্-এর সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু ইলতুৎমিস্ মাঙ্গবার্নীকে সাহায্য করতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনার পক্ষাপাতী ছিলেন না। তাই তিনি মাঙ্গবার্নীর প্রার্থনা নাকোচ করে দেন। এর ফলে চেঙ্গিশ খা সন্তুষ্ট হয়ে, ইলতুৎমিস্-এর রাজ্য আক্রমণ না করে, ভারত ত্যাগ করেন।
১২২৪ খ্রিষ্টাব্দে ভারত থেকে ফেরার পথে তিনি পারশ্যের খোয়ারাজমিয়ান রাজ্য দখল করেন। পরে মধ্য এশিয়ার ইলি নদীর তীরে বিজয় উৎসব পালন করেন।
১২২৫ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে তিনি পীত সাগর থেকে শুরু করে ইরান, ইরাক, এবং দক্ষিণ রাশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে সাম্রাজ্য স্থাপন করেন।
১২২৭ খ্রিষ্টাব্দে এক লড়াইয়ের সময় তিনি ঘোড়া থেকে মাটিতে পড়ে গেলেন। পরের দিন তার জ্বর এলো। এর আট দিন পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ১২২৭ সালে চেঙ্গিশ খানের মৃত্যুর পর, চেঙ্গিশ খানের রাজ্য বা খানাত তিনটি ভাগে বিভাজিত হয়ে যায়। এই ভাগগুলো হলো-
মাওয়ারাননহর ও কাশগর এলাকা: এই অঞ্চলের শাসক হন চেঙ্গিশ খানের দ্বিতীয় পুত্র চাগতাই খান। চাগতাই খানের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় চাগতাই খানাত। তিনি বর্তমান উত্তর পশ্চিম চীনের আলমালিকে রাজধানী স্থাপন করেছিলেন।
বালখাশ হ্রদের পূর্ব প্রান্ত থেকে মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত। এই অঞ্চলের শাসক হন চেঙ্গিশ খানের তৃতীয় পুত্র ওগেদাই খান।
উত্তর মঙ্গোলিয়া: এই অঞ্চলের শাসক হন চেঙ্গিশ খানের চতুর্থ পুত্র তোলুই খান। এই তিনটি রাজ্যত্বের ভিতরে মোঙ্গল সাম্রাজ্যের অধিপতি ছিলেন তোলুই খান। মূলত অপর দুটি খানাত ছিল তোলুই খানের অধীনস্থ রাজ্য।
ইতিহাসে অনেক সময় তাঁকে বর্বর বা হিংস্র আক্রমণকারী হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু মধ্যযুগীয় রাজ্য বিস্তারে কোনো সম্রাটই কম হিংস ছিল না। তিনি আত্মপ্রচারে বিমুখ এমন একজন সম্রাট ছিলেন যার সাথে তুলনা করা যায় এমন সম্রাট খুব বেশি দেখা যায় না। চেঙ্গীস তার জীবদ্দশাতেই বিশাল বড় বড় সব সাফল্য অর্জন করেছিলেন, কিন্তু তিনি কাউকে দিয়ে তার প্রতিকৃতি আঁকান নি, কোন বিজয়ের জন্য স্মৃতি সৌধ তৈরি করেন নি। এমন কি তাঁর প্রচলিত কোনো মুদ্রার পিঠে নিজের ছবি বসান নি। তাঁর রাজ সভার কোনো কবি তার গৌরব গাঁথা নিয়ে গান কিংবা কবিতা লেখান নি। তিনি যখন মারা যান তখন তার জন্মভূমিতে কবর দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে গিয়েছিলেন এবং কোনরকম স্মৃতিসৌধ বানাতে নিষেধ করে গিয়েছিলেন।
তথ্য আদান প্রদান ছিলো চেঙ্গীস খানের সাফল্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আর একারণে তিনি চালু করেছিলেন ইয়াম (Yam) পদ্ধতির। ইয়াম পদ্ধতির কারণে তার তথ্য বাহকেরা দিনে প্রায় ২০০ মাইলেরও বেশি পথ পাড়ি দিয়ে এক যায়গা থেকে অন্য যায়গায় তথ্য নিয়ে যেতে পারত। এজন্য তিনি বিভিন্ন চেকপোস্ট তৈরি করেছিলেন যেখানে সবসময়ই তথ্য বাহকদের জন্য ঘোড়া, খাদ্য, এবং পানির সুব্যবস্থা থাকত। এর রক্ষাণাবেক্ষণে নিয়োজিত ব্যক্তিরা চাওয়া মাত্র তথ্য বাহকদের এইসব সেবা প্রদান করতে বাধ্য ছিলো। ফলে দূরবর্তী অঞ্চলের মধ্যে সবসময়ই খুব সহজেই যোগাযোগ রক্ষা করতে সমর্থ ছিলেন।
অনেক সময় সাধারণ নাগরিকরাও তথ্যবাহকদের তাদের নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ খবর আদান-প্রদানের কাজে ব্যবহার করতে পারত। তথ্য বহনের এই রাস্তা ধরেই তিনি ব্যবসায় নিয়োজিত দেশী বিদেশী ক্যারাভানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আদেশ দিয়েছিলেন। তার কড়া নির্দেশ ছিলো কেউ যেন এ সমস্ত ক্যারাভান আক্রমণ না করে। এর ব্যত্যয় ঘটলে তার শাস্তি ছিলো ভয়াবহ। আর এর ফলেই সম্ভব হয়েছিলো পূর্ব এবং পশ্চিমের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আদান প্রদানের।