ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ভোট কমছে কেন?
পশ্চিমবঙ্গে চলতি সপ্তাহে যে পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে সেখানে শতাংশের হিসাবে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট আবারও কমে গেছে বলে বিশ্লেষকরা হিসাব দিচ্ছেন।
বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে একাধিক ভোটেই বিজেপির ভোট শতাংশ ক্রমাগত কমছে বলেও ফলাফলের বিশ্লেষণে বেরিয়ে আসছে।
যেসব নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণে আসছে, তার মধ্যে যেমন আছে একাধিক বিধানসভা নির্বাচন, তেমনই আছে পৌর নির্বাচনও।
বিজেপি অবশ্য উল্টোদিক থেকে বিশ্লেষণ করে দেখাচ্ছে যে আগের পঞ্চায়েত নির্বাচনের তুলনায় ২০২৩ এর পঞ্চায়েত ভোটে প্রায় দ্বিগুণ আসন তারা পেয়েছে। তারা এটাও বলছে, গত সপ্তাহের নির্বাচনে আর এই সপ্তাহের ভোট গণনার সময়ে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস যে ব্যাপক সন্ত্রাস চালিয়েছে, ভোট লুঠ হয়েছে, তার মধ্যেও গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে প্রায় ১০ হাজার আসনে জয়ী হয়েছেন দলের প্রার্থীরা।
বিজেপির ভোট শতাংশ লাগাতার কমছে
গত বিধানসভা নির্বাচনে ৩৮% ভোট পেয়েছিল বিজেপি। প্রায় দুবছর পরে ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে শতাংশের নিরিখে তাদের ভোট কমেছে ১৫%-রও বেশি।
যদিও ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনের তুলনায় এবারে অনেক বেশি আসন পেয়েছে বিজেপি।
গ্রাম পঞ্চায়েতে প্রায় ৩৫ হাজার আসনে জিতেছে রাজ্যের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস, আর বিজেপি জয়ী হয়েছে প্রায় দশ হাজার আসনে।
পঞ্চায়েত সমিতির ৯৭৩০টি আসনের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে ৬৪৩০টি, আর বিজেপি পেয়েছে ৯৮২টি আসন। ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থার সর্বোচ্চ স্তর, জেলা পরিষদের ৯২৮টি আসনের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস ৬৭৪টি, বিজেপি পেয়েছে মাত্র ২১টি আসন।
আসন সংখ্যার নিরিখে বিজেপির ফলাফল উন্নত হলেও কেন শতাংশের হিসাবে তাদের ভোট কমছে?
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বলছেন, “বিজেপির ভোট শেয়ার যে এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনেই শুধু কমেছে তা নয়। বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে যতগুলো উপনির্বাচন বা পৌর নির্বাচন হয়েছে, সব ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে তাদের ভোটের শতাংশ কমছে।
বিজেপিতে যোগ্য নেতৃত্বের অভাব?
“এর পিছনে তিনটি কারণ আছে,” বলছেন অধ্যাপক চক্রবর্তী। “প্রথমত তাদের যোগ্য নেতৃত্বের অভাব। যেকারণে তারা তৃণমূল কংগ্রেসের শক্তিশালী সাংগঠনিক ব্যবস্থার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছে না। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গে যেভাবে সাধারণ মানুষকে সরাসরি সুবিধা দেওয়ার নানা প্রকল্প করেছেন মুখ্যমন্ত্রী, সেগুলো বিজেপির নির্বাচিত বিধায়ক বা সংসদ সদস্যদের এলাকায় সঠিকভাবে রূপায়ন করতে দেওয়া হচ্ছে না।
“এমনকি বিজেপির বিধায়ক – সংসদ সদস্যরা তাদের এলাকা উন্নয়ন তহবিলের অর্থ দিয়েও কাজ করাতে পারছেন না স্থানীয় প্রশাসনের অসহযোগিতার ফলে,” বলছিলেন অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী।
তার ব্যাখ্যা, উন্নয়ন প্রকল্প বা সুবিধা দেওয়ার প্রকল্পগুলি রূপায়ন না করতে পারার ফলে মানুষের সামনে বিজেপির নির্বাচিত বিধায়ক বা সংসদ সদস্যদের ব্যর্থতার ছবি ফুটে উঠছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অমল সরকার আবার মনে করেন যে বর্তমানের রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব রাজনীতি করতে চাইছেন আদালত আর আধা সামরিক বাহিনীর ওপরে ভরসা করে।
তার কথায়, “শুধুই মামলা করা হচ্ছে আর আধা সামরিক বাহিনী নামানোর দাবি তুলে চলেছেন বিজেপি নেতারা। যেন আদালতের নির্দেশ আর আধা সামরিক বাহিনীই তাদের হয়ে রাজনীতিটা করে দেবে। যোগ্য নেতৃত্বের অভাবের ফলেই এভাবেই চলছে রাজ্য বিজেপি।”
‘ভোট করানোর’ শক্তি নেই বিজেপির
পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের আমল থেকেই ‘ভোট করানো’ হয়ে থাকে। সিপিআইএম তাদের শক্তিশালী সংগঠন দিয়ে এমন একটা ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলেছিল, যার মাধ্যমে শুধু ভোটের সময় নয়, বছরভর এলাকার প্রতিটা বাড়ির খোঁজখবর রাখত তারা আর ভোটের দিন ভোটারদের নিয়ে এসে ভোট দেওয়াতো।
সেই পুরো ব্যবস্থাপনাটাই তৃণমূল কংগ্রেস শিখে নিয়েছে ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পরে।
আবার সিপিআইএমের আমলে যারা ‘ভোট করানো’র ব্যবস্থা করত, তাদের একটা বড় অংশই তৃণমূল কংগ্রেসে চলে এসেছে। ফলে ভোট ব্যবস্থাপনায় তৃণমূল কংগ্রেস অন্য যে কোনও দলের থেকে কয়েক যোজন দূরে আছে। এটা তারা পারে নিজেদের সাংগঠনিক ক্ষমতার জোরে।
সেই ক্ষমতা বিজেপির গড়ে ওঠেনি, যার ফলে ভোট ব্যবস্থাপনায় তারা পেরে ওঠে না বলেই বিশ্লেষকরা মনে করেন।
বিশ্বনাথ চক্রবর্তী আরও বলছিলেন, “এর বাইরে তৃতীয় একটা কারণেও বিজেপির ভোট কমছে, সেটা হল পশ্চিমবঙ্গের বাম-উদারপন্থীদের একটা বড় অংশ বিজেপির দিকে ঘুরে গিয়েছিল। কিন্তু যখনই ২০২১ এর বিধানসভা ভোটে বিজেপি পর্যুদস্ত হল, তারপর থেকেই সেই ভোটারদের একটা অংশ আবারও বামফ্রন্ট-কংগ্রেস জোটের দিকে ফিরতে শুরু করেছে।“
পঞ্চায়েত নির্বাচনে যেখানে শতাংশের হিসাবে বিজেপির প্রায় ১৫% ভোট কমেছে, সেখানে বামফ্রন্ট-কংগ্রেস আর ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের জোটের ভোট বেড়েছে প্রায় ১১%।
‘অনেক গুণ আসন বেড়েছে’: বিজেপি
বিজেপি বলছে ভোটের শতাংশ কমেছে বলে যখন বিশ্লেষণ করা হচ্ছে, অন্যদিকে এটাও তথ্য যে তাদের আসন সংখ্যা অনেকটাই বেড়েছে বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনের তুলনায়। আর সেটাও হয়েছে এমন একটা নির্বাচনে, যেটাকে সুষ্ঠু ভোট হয়েছে এমন কথা তৃণমূল কংগ্রেসের অতি বড় সমর্থকও বলবে না।
“এটা কি ভোট হয়েছে? অবাধে সন্ত্রাস চলেছে, ভোট লুঠ হয়েছে এবারে। কিন্তু তার মধ্যে দাঁড়িয়েও আমাদের হাজার দশেক প্রার্থী তো জিতেছেন! এটা তো একদিক থেকে দেখতে গেলে আমাদের সাফল্য,” বলছিলেন বিজেপি নেতা অধ্যাপক বিমল শঙ্কর নন্দ।
“আবার রাজনৈতিক বাস্তবতাও দেখতে হবে আপনাকে। গত বিধানসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর থেকে যে দলের হাজার হাজার মানুষ ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেছে, তাদের ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, বহু খুন হয়েছে, অনেক নারীর ওপরে অত্যাচার চালানো হয়েছে। তখন থেকেই একটা বার্তা দেওয়া হয়েছে যে বিজেপি করলে তোমার এই দশা হতে পারে। মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে,” বলছিলেন মি. নন্দ।
তার কথায়, ওই আতঙ্কের কারণেই অনেকে বিজেপির দিক থেকে সরে গেছেন।
লোকসভা ভোটে কী প্রভাব পড়বে?
পঞ্চায়েত ভোটের সময় থেকে একবছরও বাকি নেই লোকসভা নির্বাচনের। ওই নির্বাচন হওয়ার কথা ২০২৪ সালের মে মাস নাগাদ।
পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রেক্ষিত আর লোকসভা ভোটের প্রেক্ষিত একেবারেই আলাদা। তবুও পশ্চিমবঙ্গে সবসময়েই লোকসভা ভোটের আগের বছর গ্রাম পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়ে এসেছে, আর পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফল পরের বছরের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের একটা ইঙ্গিত হিসাবে কাজ করে থাকে।
নরেন্দ্র মোদী ২০১৯ সালে যখন দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার জন্য ভোটে লড়লেন, তার ঠিক এক বছর আগে পঞ্চায়েত ভোট হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে।
সেই পঞ্চায়েত ভোটের ফলেই দেখা গিয়েছিল যে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে বামফ্রন্টের জায়গাটা বিজেপি দখল করে নিয়েছে। এক বছর পরের লোকসভা নির্বাচনের ফলেও দেখা গিয়েছিল যে বামফ্রন্ট ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে, আর বিজেপি দখল করে নিয়েছে ১৮টি আসন।
এবছরের পঞ্চায়েত ভোটের ফলও কি তাহলে আগামী বছরের ভোটের ফলাফলের একটা ইঙ্গিত দিতে পারে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অমল সরকারের কথায়, “লোকসভা ভোটের ইস্যু আর পঞ্চায়েতের ইস্যু সম্পূর্ণই আলাদা হবে। লোকসভা নির্বাচনে আমার স্থির ধারণা রামমন্দির উদ্বোধন করে দিয়ে হিন্দুত্বের ইস্যু বিজেপি আবারও তুলে আনবে, আর সঙ্গে থাকবে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করে হিন্দু ভোট একজোট করার প্রচেষ্টা।
“অন্যদিকে লোকসভা নির্বাচনে আধা সামরিক বাহিনী থাকবে, জাতীয় নির্বাচন কমিশনের কড়া নজরদারিতে ভোট হবে। তবুও বলব, যতই আধা সামরিক বাহিনী আসুক, গ্রামস্তরে ভোট করার জন্য যে শক্তিশালী সংগঠন দরকার হয়, সেটা তৃণমূল কংগ্রেসেরই আছে। আর পঞ্চায়েত যাদের দখলে থাকে, ভোটারদের ছায়াও তাদেরই দখলে থাকে পশ্চিমবঙ্গে। তাই যতই হিন্দুত্বের ইস্যু তুলুক বিজেপি, গ্রামস্তরে অ্যাডভান্টেজ পাবে তৃণমূল কংগ্রেসই,” বলছিলেন মি. সরকার।
আবার বিজেপি নেতা অধ্যাপক বিমল শঙ্কর নন্দ বলছেন, “গত পঞ্চায়েত নির্বাচন, যেটা ২০১৮ সালে হয়েছিল, সেখানে যে ব্যাপক সন্ত্রাস হয়েছিল, তার প্রভাব যেমন পড়েছিল ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে, এই নির্বাচনের প্রভাবও পড়বে পরের বছরের লোকসভা ভোটে। আর সেই প্রভাব হবে তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে নেতিবাচক।“
তিনি মনে করেন যে পঞ্চায়েত ভোটে রাজ্য সরকারের নানা প্রকল্প, বিভিন্ন সুবিধার কথা বলে ভোট পাওয়া যায়, যদিও তার দল এই নির্বাচনকে প্রহসন বলে মনে করেন, কিন্তু লোকসভা নির্বাচনে রাজ্য সরকারের সেই সব প্রকল্প দেখিয়ে আর সুবিধা দিয়ে ভোটারদের আকৃষ্ট করতে পারবে না তৃণমূল কংগ্রেস।
সূত্র: বিবিসি বাংলা