ইউরোপে বাড়ছে উগ্র ডানপন্থী দলগুলোর প্রভাব
ফ্রান্সের অবস্থা এখন ছুরির ফলার ওপর দিয়ে হাঁটার মতো। মঙ্গলবার প্যারিসের কাছে ফরাসী-আলজেরিয়ান এক ১৭-বছরের তরুণ পুলিশের গুলিতে নিহত হবার পর যে সহিংসতা শুরু হয় – তা এখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে।
ফ্রান্সে এ ধরনের দাঙ্গা যে আগে হয়নি তা নয়। কিন্তু এবার নিহতের পরিবারের প্রতি সহানুভূতি থেকে হোক বা পুলিশের প্রতি সমর্থন থেকেই হোক – যে আবেগ-অনুভূতির বহিপ্রকাশ ঘটছে, তার এমন তীব্রতা ২০০৫ সালের পরে আর দেখা যায়নি।
একদিকে দেখা যাচ্ছে – প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হিমশিম খাচ্ছেন। আর অন্যদিকে তার রাজনৈতিক শত্রু উগ্র-দক্ষিণপন্থী মারিন লা পেন হয়তো তার নিরাপত্তা এবং অভিবাসন-বিরোধিতার ক্ষেত্রে কড়া বার্তার কারণে জনমত জরিপে এর ফায়দা ওঠাবেন।
ইউরোপের সর্বত্র উগ্র-ডানদের উত্থান ঘটছে
এখন ইউরোপে আপনি চারদিকে তাকিয়ে দেখুন – উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম সর্বত্রই রংবেরং এর উগ্র-দক্ষিণপন্থী পার্টিগুলোর উত্থান ঘটছে।
এদের কেউ অতীতচারী বা নস্টালজিক জাতীয়তাবাদী, কেউবা লোকরঞ্জনবাদী বা পপুলিস্ট জাতীয়তাবাদী, কেউ আবার নব্য-ফ্যাসিস্ট শিকড় থেকে গজানো কট্টর রক্ষণশীল পার্টি।
বিংশ শতাব্দীতে ইউরোপে নাৎসী জার্মানি আর ফ্যাসিস্ট ইতালির বিরুদ্ধে যে ব্যাপক যুদ্ধ হয়েছিল – তারপর এখানে বেশির ভাগ ভোটারের মনে একরকম অনুভূতি তৈরি হয়ে গিয়েছিল যে চরম ডানপন্থীদেরকে আর কখনো ভোট দেয়া যাবে না। মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো উগ্র ডানপন্থী দলগুলোর সাথে সহযোগিতা করতে অস্বীকার করতো।
কিন্তু সেই সব পুরোনো ‘ট্যাবু’ এখন আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে।
ইউরোপে উগ্র ডানদের উত্থান শুরু হয়েছিল ভিয়েনা থেকে
সেটা ২০০০ সালের কথা। আমি তখন থাকতাম ভিয়েনাতে। সে বছরই প্রথম একটি মধ্য-ডানপন্থী দল আর ফ্রিডম পার্টি নামে একটি উগ্র-ডানপন্থী দলের সাথে কোয়ালিশন গড়ে।
সে সময় এটা সারা দুনিয়ার সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছিল। এমনকি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ভিয়েনার ওপর কূটনৈতিক নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করেছিল।
আর এখন – ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ইতালিতে ক্ষমতাসীন জর্জা মেলোনি। তিনি এমন একটি পার্টির প্রধান যার উৎস প্রোথিত নব্য-ফ্যাসিস্ট আন্দোলনে।
ইতালি, ফিনল্যান্ড থেকে হাঙ্গেরি – সবখানেই উগ্র-ডানরা বাড়ছে
ফিনল্যান্ডে তিন মাস ধরে বিতর্ক চলার পর ‘দ্য ফিন্স’ নামের উগ্র ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী পার্টি সম্প্রতি ক্ষমতাসীন কোয়ালিশন সরকারে যোগ দিয়েছে।
সুইডেনের পার্লামেন্টে এখন দ্বিতীয় বৃহত্তম পার্টি হচ্ছে অভিবাসন-বিরোধী এবং বহুসংস্কৃতিবাদ বিরোধী সুইডেন ডেমোক্র্যাটস। ডানপন্থী কোয়ালিশন সরকারের তারা এক গুরুত্বপূর্ণ সমর্থনদাতা।
গত রোববার গ্রিসের নির্বাচনে তিনটি উগ্র ডানপন্থী দল পার্লামেন্টে ঢোকার জন্য যথেষ্ট আসন জিতেছে।
অন্যদিকে স্পেনে সাম্প্রতিক আঞ্চলিক নির্বাচনে ভক্স পার্টি নামে একটি বিতর্কিত জাতীয়তাবাদী দল এতটাই ভালো ফল করেছে – যা সকল হিসেব-নিকেশকে ভুল প্রমাণ করেছে।
এটিই হচ্ছে ১৯৭৫ সালে ফ্যাসিস্ট একনায়ক জেনারেল ফ্রাংকোর মৃত্যুর পর স্পেনে প্রথম সফল উগ্র-ডানপন্থী পার্টি।
স্পেনে আর তিন সপ্তাহ পরেই জাতীয় নির্বাচন এবং তারপর এই ভক্স পার্টি হয়তো রক্ষণশীলদের সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠন করবে – এমন কথাবার্তা এর মধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।
পোল্যান্ড আর হাঙ্গেরিতেও এখন আছে কট্টর রক্ষণশীল, একনায়কতান্ত্রিক মনোভাবের সরকার।
এই তালিকা লম্বা হচ্ছে তো হচ্ছেই।
জার্মানিতে উঠছে এএফডি
এমনকি জার্মানিতেও উগ্র ডানপন্থী পার্টির উত্থান হচ্ছে – যে দেশটি তাদের নাৎসী অতীত নিয়ে খুবই স্পর্শকাতর।
সেখানে এখন জনমত জরিপগুলোয় দেখা যাচ্ছে – চ্যান্সেলর ওলাফ শোলৎজের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট (এসপিডি) পার্টির সাথে হয় সমানে-সমানে, নয়তো সামান্য এগিয়ে আছে উগ্র-ডানপন্থী দল এএফডি।
গত সপ্তাহ শেষেই জার্মানিতে এএফডির একজন প্রার্থী এই প্রথমবারের মতো একটি স্থানীয় নেতৃত্বের পদে জয়লাভ করেছেন।
এসপিডি একে “রাজনৈতিক বাঁধ ভেঙে দেবার মত ঘটনা” বলে আখ্যায়িত করছে।
তাহলে কী ঘটছে ইউরোপে?
সুতরাং প্রশ্ন হলো, ইউরোপে কী ঘটছে তাহলে? সত্যিই কি ইউরোপের লক্ষ লক্ষ ভোটার উগ্র ডানপন্থার দিকে মোড় নিচ্ছে? নাকি তারা এর মধ্যে দিয়ে তাদের প্রতিবাদ জানাচ্ছে?
এ প্রশ্নও করা যায় যে, ইউরোপে কি তাহলে শহুরে উদারপন্থী ভোটার এবং বাদবাকি রক্ষণশীল ভোটারদের মধ্যে একরকম মেরুকরণ ঘটছে? তা ছাড়া, আমরা যখন কিছু দলকে ‘উগ্র ডানপন্থী’ তকমা দিচ্ছি তখন আমরাই বা আসলে কী বোঝাচ্ছি?
বিশেষ করে নির্বাচনের আগে যদি অভিবাসন-বিষয়ে কোন মূলধারার রাজনীতিকের কথাবার্তা শোনেন তাহলে দেখবেন – তারা কতটা কট্টরপন্থীর মত শোনাতে পারেন।
যেমন মধ্য-ডানপন্থী ডাচ প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটের কথাই ধরুন।অথবা শুনে দেখুন নিরাপত্তার প্রশ্নে স্বঘোষিত মধ্যপন্থী এমানুয়েল ম্যাক্রঁর কথাবার্তা ।
ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশন্স এর পরিচালক হলেন মার্ক লিওনার্ড। তিনি বলছেন, এ ব্যাপারটি মারাত্মক সব বৈপরীত্যে ভরা।
একদিকে দেখা যাচ্ছে বেশ কিছু মূলধারার রাজনীতিবিদ সম্প্রতি উগ্র-ডানপন্থীদের শ্লোগান বা অবস্থানকে আত্মসাৎ করে নিয়েছেন। তারা আশা করছেন এতে ওই দলগুলোর সমর্থকরা তার পক্ষে চলে আসবে। কিন্তু এর ফলে উগ্র-ডানপন্থাকে রাজনীতির মূলধারার অংশ দল বলে মনে করাতে সহায়ক হচ্ছেন তারা।
একই সঙ্গে আবার ইউরোপের বেশ কিছু উগ্র ডানপন্থী দল ইচ্ছে করেই নিজেদের রাজনীতির মধ্যপন্থার কাছাকাছি নিয়ে আসছে – যাতে তারা আরো মধ্যপন্থী ভোটারের সমর্থন পাবে বলে আশা করছে।
রাশিয়া ও ব্রেক্সিটের ক্ষেত্রে অবস্থান
উদাহরণ হিসেবে রাশিয়ার ব্যাপারে তাদের মনোভাবটা দেখা যাক। উগ্র ডানপন্থী দলগুলো যেমন ইতালির দ্য লিগ, ফ্রান্সের মারিন লা পেন এবং অস্ট্রিয়ার ফ্রিডম পার্টি – এদের ঐতিহ্যগতভাবেই মস্কোর সাথে ঘনিষ্ঠতা ছিল।
কিন্তু রাশিয়া ইউক্রেনে অভিযান চালানোর পর এসব দলের নেতারা তাদের কথাবার্তার ধরণ পাল্টে ফেলেছেন।
মার্ক লিওনার্ড বলছেন, উগ্র-ডানপন্থী দলগুলোর সাথে ইইউ-র সম্পর্কের কথা।
২০১৬ সালে ব্রিটেনের ব্রেক্সিট ভোটের পর ব্রাসেলসে একটা ভয় তৈরি হয়েছিল যে এর পর হয়তো ফ্রান্স, ডেনমার্ক ও ইতালি ইইউ থেকে বেরিযে যেতে চাইবে।
অনেক ইউরোপিয়ান দেশের নেতাদেরই ইইউর ব্যাপারে গভীর সংশয় আছে। তবে বেশিরভাগ ইউরোপীয় ভোটারের জন্যই ইইউ ত্যাগ বা ইউরো ত্যাগের মত ধারণা ‘খুব বেশি বিপ্লবী’ ছিল ।
সে জন্য উগ্র-ডান দলগুলো এখন আর ইইউ বা ইউরো ত্যাগের কথা বলছে না।
জনমত জরিপে দেখা যায়, ইউরোপিয়ানদের মধ্যে ইইউ-তে থাকার চিন্তাই এখন বেশি জনপ্রিয়।
সে কারণে এখন উগ্র-ডানপন্থী দলগুলো বলছে ইইউ-র সংস্কারের কথা – ইইউ থেকে বেরিয়ে যাবার কথা বলছে না।
এসব দলগুলো ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের নির্বাচনে ভালো করবে বলে জরিপে আভাস মিলছে।
মূলধারার রাজনীতি নিয়ে অসন্তোষ
প্যারিস-ভিত্তিক ইনস্টিটিউট মনটেইন-এর ইউরোপ কর্মসূচির পরিচালক জর্জিনা রাইট বলছেন, তিনি মনে করেন মূলধারার রাজনীতি নিয়ে অসন্তোষ সৃষ্টি হবার কারণেই উগ্র-ডানপন্থীদের পুনরুত্থান ঘটছে।
তিনি বলছেন, উগ্র-ডানপন্থীরা যেরকম সোজা-সাপ্টাভাবে কথা বলে তা ইউরোপের অনেক ভোটারই পছন্দ করছে। তা ছাড়া তিনটি ক্ষেত্রে ঐতিহ্যবাহী ধারার রাজনীতিবিদরা তাদের প্রশ্নের জবাব দিতে পারছে না- এতেও তারা হতাশ।
এ তিনটি ক্ষেত্র হলো:
১. আত্মপরিচয় সংক্রান্ত ইস্যু: খোলা সীমান্ত নিয়ে আতংক, জাতীয় আত্মপরিচয় এবং ঐতিহ্যগত মূল্যবোধের অবক্ষয়।
২. অর্থনীতি : বিশ্বায়নকে প্রত্যাখ্যানের মানসিকতা এবং ভোটারদের সন্তান ও নাতি-নাতনীদের জন্য উন্নততর ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা মিলছে না – সে জন্য তারা ক্ষুব্ধ।
৩. সামাজিক ন্যায়বিচার: যেসব নিয়মনীতি নাগরিকদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে তার ওপর জাতীয় সরকারগুলোর নিয়ন্ত্রণের অভাব।
এ বছর নেদারল্যান্ডসে উগ্র-ডানপন্থী লোকরঞ্জনবাদী দল ফার্মার-সিটিজেন মুভমেন্ট পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষে সবচেয়ে বেশি আসন পায়। এ ঘটনা সংবাদমাধ্যমে বড় খবর হয়।
ফ্রান্সে এমানুয়েল ম্যাক্রঁ পেট্রোলের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করলে তিনি উগ্র-ডানপন্থী গ্রুপ ও তথাকথিত হলুদ-ভেস্টধারী বিক্ষোভকারীদের প্রতিবাদের সম্মুখীন হন।
অন্যদিকে জার্মানিতে গ্রিন পার্টি যেসব পরিবেশগত সংস্কার করার অঙ্গীকার করেছিল – তা তারা বাজেট ও জনরোষের ভয়ে বাস্তবায়ন করতে পারছে না।