ভারতের মণিপুরের হাল এখন সিরিয়া বা লেবাননের মতো
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুরে নতুন করে শুরু হওয়া সহিংসতায় বিভিন্ন স্থানে নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সশস্ত্র জনতার সংঘর্ষ চলছে, সরকারি সম্পত্তি ও কর্মকর্তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
রাজ্যের শাসক দল বিজেপির প্রেসিডেন্ট অধিকারীমায়ুম সারদা দেবীর বাড়িতেও হামলা চালানো হয়েছে। থংজু বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপির প্রধান কার্যালয়টিও জ্বালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে।
রাজ্যের পরিস্থিতিকে লিবিয়া, লেবানন, নাইজেরিয়া বা সিরিয়ার সঙ্গে তুলনা করে মণিপুরের একজন সাবেক শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা মন্তব্য করেছেন, তাঁর রাজ্য এখন ‘স্টেটলেস’ – যেখানে মানুষের জীবন ও সম্পত্তি ইচ্ছেমতো কেড়ে নেওয়া চলে।
দুদিন আগেই দেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আর. কে. রঞ্জন সিংয়ের ইম্ফলের বাসভবন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাজ্যের আরও বহু বিজেপি নেতা-মন্ত্রীকেও আক্রমণের নিশানা করা হচ্ছে।
মণিপুরের পরিস্থিতির জন্য বিজেপির রাজনীতিকে দায়ী করে বিরোধী দল কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধী বলেছেন, মণিপুর যে জ্বলছে এবং সেখানে একের পর এক প্রাণহানি হচ্ছে, সেই ব্যর্থতার দায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর।
মণিপুরের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির জরুরি বৈঠক ডাকার দাবি জানিয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেস এমপি ডেরেক ও’ব্রায়েন।
এদিকে দেশের প্রায় সাড়ে পাঁচশো নাগরিক সংগঠন, শিক্ষাবিদ ও আইনজীবী এক যৌথ বিবৃতি জারি করে বলেছেন, বিজেপির ‘বিভাজনের রাজনীতি’ই মণিপুরে এই সহিংসতার সূচনা করেছে।
প্রধানমন্ত্রী মোদীকে এই সঙ্কট নিয়ে মুখ খুলে জবাবদিহি করতে হবে – এই দাবিও জানানো হয়েছে ওই যৌথ বিবৃতিতে।
নতুন করে সহিংসতা
গত মাসে মণিপুরে মেইতেই ও নাগা-কুকি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে যে রক্তাক্ত সংঘাত শুরু হয়েছিল তা সাময়িকভাবে থিতিয়ে এলেও গত তিন-চারদিনে তা আবার নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে।
শুক্রবার (১৬ই জুন) রাত দশটা নাগাদ বিষ্ণপুরের কোয়াকটা শহরে ও চূড়াচাঁদপুর জেলার কাংভাই গ্রামে একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠী স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র থেকে প্রায় চার-পাঁচশো রাউন্ড ফায়ারিং করলে উত্তেজনা চরমে ওঠে।
সরকারি কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, তখন থেকেই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে বিচ্ছিন্নভাবে গুলিচালনার ঘটনা ঘটেই চলেছে।
তারা আরও বলছেন, বিভিন্ন গোষ্ঠীর লোকরা এক এক জায়গায় জড়ো হচ্ছেন এবং তারপর সংঘবদ্ধভাবে সরকারি সম্পত্তি বা নেতা-মন্ত্রীদের বাড়িতে হামলা চালানোর বা জ্বালিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টায় সেনাবাহিনী, আসাম রাইফেলস, র্যাপিড অ্যাকশন ফোর্স ও রাজ্য পুলিশের যৌথ বাহিনী রাজধানী ইম্ফলের রাস্তায় মধ্যরাতেও টহল দিচ্ছে।
ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আর. কে. রঞ্জন সিং-সহ বহু বিজেপি নেতার বাড়ি ও কার্যালয়ে হামলা চালানো হয়েছে।
রাজ্যের প্রভাবশালী বিজেপি নেতা এবং বিদ্যুৎ ও বনমন্ত্রী টি বিশ্বজিৎ সিং যে বিধানসভা কেন্দ্রে থেকে জিতে এসেছেন, সেই থংজুতে বিজেপির প্রধান দপ্তরটিও হামলাকারীরা জ্বালিয়ে দিয়েছে।
এর আগে বুধবার সন্ধ্যায় রাজ্যের একমাত্র মহিলা ক্যাবিনেট মন্ত্রী ও কুকি নেত্রী নেমচা কিপগেনের ইম্ফলের বাড়িতেও আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। ঘটনার সময় তিনি অবশ্য বাড়িতে ছিলেন না।
বাড়িঘর ও দোকানপাটে আগুন ধরাতে আসা দুষ্কৃতীদের নিরাপত্তা বাহিনী বাধা দিতে গেলে বহু জায়গায় সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটছে। তাতে বেশ কয়েক জায়গায় বেসামরিক মানুষজন জখমও হয়েছেন।
সিরিয়ার সঙ্গে তুলনা
ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক লে: জেনারেল এল নিশিকান্ত সিং, যিনি নিজে একজন মণিপুরী, এই পটভূমিতেই গত বৃহস্পতিবার একটি টুইট করেন – যা দিল্লিতেও রীতিমতো আলোড়ন ফেলে দিয়েছে।
তিনি সেখানে লেখেন, “আমি মণিপুর থেকে আসা অতি সাধারণ একজন ভারতীয়, যিনি এখন অবসর জীবন কাটাচ্ছি। আমার সেই স্টেট এখন স্টেটলেস (চরম অরাজক)।”
“লিবিয়া, লেবানন, নাইজেরিয়া, সিরিয়া প্রভৃতি দেশের মতো এখানেও যে কেউ যখন খুশি জীবন বা সম্পত্তি ধ্বংস করে ফেলতে পারে।”
লে: জেনারেল সিং সেই সঙ্গেই লেখেন, “মনে হচ্ছে যেন মনিপুরকে নিজের কৃতকর্মের ফল ভোগ করার জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কেউ কি শুনছেন?”
এই টুইটের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষিত হয় প্রাক্তন ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল ভেদ মালিকের, যিনি নিশিকান্ত সিংয়ের বক্তব্যকে ‘এক্সট্রাঅর্ডিনারি স্যাড কল’ বলে বর্ণনা করেন।
প্রধানমন্ত্রী মোদী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংকে ট্যাগ করে জেনারেল ভেদ মালিক বলেন, মণিপুরের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিকে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে জরুরি দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে, নিজের বাড়ি হামলায় ভস্মীভূত হয়ে যাওয়ার পর প্রকাশ্যেই সে কথা বলেছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আর. কে. রঞ্জন সিং-ও।
সাংবাদিকদের তিনি আরও বলেন, “আমি নিজে হিন্দু। যারা আমার কষ্টার্জিত উপার্জনে তৈরি বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে তারাও হিন্দু – কাজেই এটাকে ধর্মীয় সহিংসতাও বলতে পারছি না।”
মন্ত্রীর ওই মন্তব্যের পর শিবসেনা (উদ্ধব) গোষ্ঠীর এমপি প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদী মন্তব্য করেন, “আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার কথা কোনও বিরোধী দলীয় নেতানেত্রী বলছেন না – বলছেন সরকারেরই একজন মন্ত্রী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কী শুনছেন?”
মণিপুরের এই সঙ্কট শুরু হওয়ার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গত মাসের শেষ দিকে একবারই ওই রাজ্যে সফর করেছেন এবং একটি ‘শান্তি কমিটি’ গঠনের কথাও জানিয়েছেন।
কিন্তু সেই কমিটি যে কোনও কাজে আসছে না তা মণিপুরের ঘটনাপ্রবাহ থেকেই স্পষ্ট।
সূত্র: বিবিসি বাংলা