আজকের কবিতায় কবির ব্যক্তিজীবনের প্রতিফলনই বেশি ঘটে। কবিতা হয়ে ওঠে ব্যক্তিনিভৃতির বারান্দা। কবি নিজস্ব দৃষ্টিতেই তাঁর জীবনসীমানার পরিমাপ করেন। তিনি যেমন সূর্য-চাঁদ উদিত হওয়া দেখেন; তেমনি অস্ত যাওয়াও দেখেন। তার নিজস্ব দিনযাপন এবং রাত্রিযাপনও স্থান পায় কবিতায়। কবি কী পেলেন, কী পেলেন না, কী অচরিতার্থ থাকল সেই হাহাকারের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। প্রেম-প্রণয় এমনকী রতিলীলার নানা অন্তরায়, ব্যর্থতা, আত্মহত্যাপ্রবণতার আবেগও অভিক্ষিপ্ত ছায়াপাত ঘটায়। মানুষের প্রাণশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে লিবিডো। প্রতিটি মানুষ প্রধানত দুটি ভাবনাকে কেন্দ্র করেই জীবনের পরমার্থ অন্বেষণ করে। প্রথম ভাবনাটি হল যৌনতা এবং দ্বিতীয় ভাবনাটি হলো ঈশ্বর যা থেকে আধ্যাত্মিকতার সৃষ্টি হয়। আমরা যদি সব সফল এবং সার্থক কবিতাকেই সামনে এনে দাঁড় করায়, তাহলে কোনো না কোনোভাবে এই দুটি ভাবনার মধ্যে একটিকে খুঁজে পাব। এখন সার্থক কবিতা বলতে কী বোঝায় সেই প্রশ্নে আমাদের কাছে অনেক বিতর্কের সৃষ্টি হতে পারে। অনেক কবি-সমালোচক মনে করেন, সার্থক কবিতা জীবনের দাবি থেকে আসে। যা সত্য, যা অনির্বচনীয়, যা সুন্দর এবং যা আত্মগত তা-ই সার্থক কবিতা। কিন্তু আমরা জানি অনেক কবিতাই ইঁট কাঠ পাথরের বর্ণনায় আবার রাজা-বাদশার স্তুতিবাদে তীব্র হয়ে উঠেছে। সেসব কি কবিতা নয়?
উত্তরে একথা বলা যায়: হ্যাঁ সেসবও কবিতা. ওডজাতীয় কবিতার মধ্যেই সেগুলির অবস্থান। সেগুলির মধ্যেও গীতিপ্রবণতা প্রবল, কিন্তু তা আকারে দীর্ঘ, কোনো বস্তু বা অবস্তুক ভাবকে অবলম্বন করে লেখা হয়। গ্রীস এবং ইংরেজি সাহিত্যে রয়েছে ওডের ঐশ্বর্যপূর্ণ ভাণ্ডার। প্রাচীন ওড মঞ্চে কোরাসের আকারে নৃত্য সহযোগে পরিবেশন করা হতো। বাংলা সাহিত্যেও এই ওড জাতীয় গীতিকবিতার প্রভাব পড়ে মধুসূদনের ‘ব্রজাঙ্গনা’ কাব্যে। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশও ওড কবিতা রচনা করেন। এই ধারার কবিতার মধ্যে ব্যক্তিহৃদয় সরাসরি উপস্থিত হতে পারে না। কোনো চরিত্র বা ভাবকে অবলম্বন করে কবি নিজেকে প্রকাশ করেন। কবি কখনো রাধা রূপে, কখনো কৃষ্ণ রূপে উপস্থিত হন। কখনো জগৎসংসারের কথা বলেন। কখনো প্রকৃতির কথা। একটা গভীর এবং বিস্তৃত আয়োজনে তা সমুদ্রের মতো হয়ে ওঠে। তখন ব্যক্তিবাচক ক্ষুদ্র ‘আমি’কে পরোক্ষভাবে অনুধাবন করতে হয়। যেমন জীবনানন্দ দাশের ‘সিন্ধুসারস’ কবিতায় দেখতে পাই:
“জানি পাখি, শাদা পাখি, মালাবার ফেনার সন্তান,
তুমি পিছে চাহোনাকো,তোমার অতীত নেই, স্মৃতি নেই, বুকে নেই আকীর্ণ ধূসর
পাণ্ডুলিপি; পৃথিবীর পাখিদের মতো নেই শীতরাতে ব্যথা আর কুয়াশার ঘর।
যে-রক্ত ঝরেছে তারে স্বপ্নে বেঁধে কল্পনার নিঃসঙ্গ প্রভাত
নেই তব; নেই নিম্নভূমি—নেই আনন্দের অন্তরালে প্রশ্ন আর চিন্তার আঘাত।”
কবিতার প্রথমেই ‘দু’এক মুহূর্ত শুধু রৌদ্রের সিন্ধুর কোলে তুমি আর আমি’ বলেই কবি শুরু করেছেন, তারপর আর কোথাও নিজেকে উপস্থিত করেননি। শুধু সিন্ধুসারসকে নিয়েই ইতিহাস ও মানবসভ্যতার উত্থান-পতনের হিসাব করেছেন। বর্ণনা দিয়েছেন। মানবহৃদয়ের কষ্টলালিত জীবনযাপনের খোঁজ যে সিন্ধুসারস রাখে না তা বলেছেন। কিন্তু কবি হয়েছেন নিরপেক্ষ দ্রষ্টা ও স্রষ্টা।ওড কবিতায় ব্যক্তিকবির প্রবেশ সম্ভব হয় না। বিশাল আয়োজনে তিনি হারিয়ে যান। তাই যেকোনো সাহিত্যেই এই কবিতার সৃষ্টি কম। বর্তমানে এই জাতীয় কবিতাও খুব একটা লেখা হয় না।
তাহলে সাম্প্রতিককালের কবিরা কোন্ ধারার কবিতা বেশি লিখছেন?
সাম্প্রতিককালে মানুষের আয়ুর সীমানা ক্ষুদ্র। ভোগ-সুখ-ঐশ্বর্যের অন্বেষণে তারা সর্বদা ব্যাকুল। জীবনের স্থিরতা বলে কিছু নেই। পরকালের প্রতিও মানুষ আসক্ত নন। ধর্মের বাণীও মানুষের কাছে কল্যাণকামী কোনো ঐশ্বর্যের ঠিকানা নয়। সর্বত্রই এক ভঙ্গুর অবিশ্বাস বা দ্বান্দ্বিকতাবাদের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। বিমূঢ় বিভ্রান্ত মানুষ যখন দেবতা ঈশ্বর বা রাষ্ট্রের কাছে আশ্রয়হীন, ভরসাহীন—তখনই তার আত্মস্বর কারুণ্যের তীব্র দাহ নিয়ে উপস্থিত হয়। তখন মঙ্গলকাব্য নয়, বৈষ্ণবপদ নয়, ওড টু এ নাইটিঙ্গেল নয়, ওড টু এ ওয়েস্ট উইন্ড নয়—লেখা হতে থাকে ব্যক্তিহৃদয়ের আশা-আকাঙ্ক্ষা, বেদনা-অভিমান, রাগ-অনুরাগ, পাওয়া-না-পাওয়া। কবি সরাসরি নিজের কথা, নিজের ভাষায়, নিজের মুখে বলতে পারেন। ‘আমি’ সর্বনামটি প্রবলভাবে জানান দেয় কবিতায় ব্যক্তি অবস্থানের। কিন্তু সেই ‘আমি’ সমগ্র মানুষের তথা যুগের তথা সময়ের ‘আমি’তে রূপান্তরিত হয়। অর্থাৎ এক ‘আমি’ বহু ‘আমি’র ধারক ও বাহক। একজনের কণ্ঠস্বরে বহুর কণ্ঠস্বর শোনা যায়। গীতিকবিতায় ব্যক্তির ভাঙচুরই মুখ্য বিষয়। সাধারণত এই ভাঙচুর প্রেম থেকেই আসে। প্রণয়িনীর বিচ্ছেদ অথবা অপ্রাপ্তিজনিত কারণে যে বিরহের সৃষ্টি হয় বা শূন্যতার এক বিস্তৃত আকাশ উপস্থিত হয়—সেখানেই চলে এই কবিতার আয়োজন। প্রেমিকহৃদয় তার সমূহ যাতনা-ক্রন্দনগুলি শব্দের অভিক্ষেপে নিজেকে প্রদর্শন করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার অপূরণীয় চাহিদাগুলি অসামাজিক, যৌনতাড়িত বিপন্নতার ঘোর থেকে উদ্ভূত হয়। তাই সর্বসমক্ষে প্রকাশ করাও যায় না। কেননা তা দণ্ডনীয় অপরাধ হতে পারে। তাই বিভিন্ন কৌশলে ইঙ্গিত এবং রূপকে, অথবা না-বলা স্পেসের মধ্যেই রাখতে হয়। এই কারণেই ব্যক্তি হৃদয়ের ক্ষত ও শূন্যতা বা জটিল আলো-অন্ধকার অনেক সময়ই পাঠকের গোচরে আসে না। তখনই কবিতাকে জটিল অথবা দুর্বোধ্য বলে মনে হয়। কিন্তু মানবীয় প্রবৃত্তির মূল ধারক লিবিডো। যা আদিম ও অকৃত্রিম প্রভাব বিস্তার করে। জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি তার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। সিগমুন্ড ফ্রয়েড এই কারণেই বলেছেন:
“It is that we are never so defenseless against suffering as when we love, never so helplessly unhappy as when we have lost our loved object or its love.”
অর্থাৎ আমরা ভালোবাসার জন্য কষ্টের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে পারি। কিন্তু যখন আমরা আমাদের প্রেম অথবা প্রিয়জনকে হারাই, তখনই অসহায় হয়ে পড়ি।
এই অসহায়তা আত্মগত এবং অন্তর্গত। এর দহন ও দাহ বিচ্ছেদ বেদনাকে ঘনীভূত করে। ফলে জীবন বিন্যাসে কিছুটা উল্লঙ্ঘন দেখা দেয়, যা অস্বাভাবিক ক্রিয়া-কাণ্ডেরই প্রতিফলন ঘটায়। সিগমুন্ড ফ্রয়েড তাই আবারও বলেছেন:
“The behavior of a human being in sexual matters is often a prototype for the whole of his other modes of reaction in life.”
অর্থাৎ যৌনতার ক্ষেত্রে একজন মানুষের আচরণ প্রায়ই তার জীবনের অন্যান্য প্রতিক্রিয়ার সম্পূর্ণ প্রোটোটাইপ অর্থাৎ আদিরূপ। এই আদিরূপের কোনো পরিবর্তন ঘটে না। যে কোনো পর্যায়ের মানুষই হোক বা প্রাণী হোক—যৌনতার কারণেই পারস্পরিক সংঘাত বা হত্যা সংগঠিত করতে পারে। অতীত ইতিহাসে যতগুলি মহাকাব্য বা আখ্যান কাব্য রচিত হয়েছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই আদিরূপ সংঘাতের প্রতিরূপ দেখতে পাই। সুতরাং লিবিডো অবিচ্ছিন্ন আদি-উৎসের সঞ্চার বলা চলে। কবিতা এই বোধের সম্মোহন থেকেই মনের চেতন-অবচেতন বা অচেতন স্তরকে উন্মুক্ত করার মাধ্যম। কবিতাপাঠ কালে আমরা অনুধাবন করতে পারি মনের কোন্ স্তরের ভাষায় উপনীত হচ্ছি। অনেক সময় তা অটোমেটিক রাইটিং হিসেবেও চলে আসে। তখন বিমূর্ত বা অবাস্তব কবিতার জন্ম হয়। এবং সেগুলিও যে গীতিকবিতা তা বলাই বাহুল্য। এই ধারার কয়েকটি কবিতা উল্লেখ্য:
১,”অক্ষয় ডায়েরির ভাঁজে, পুড়তেছে জন্মান্ধ মানুষ
এবং, সে কথা চিহ্নসমেত লেখা হচ্ছে— শেকড়ে!
ভাঙা— রোদবৃক্ষ, রাত্রির যোনি জুড়ে শুয়ে থাকে
ত্রস্তলিপি, নিঃশব্দ সোমপুর, ভাষার ভেতর ফুটে
আছো এক ব্যর্থ হাসি— চ্যাপলিন, উড়ছে পত্রাদি,
নদীতটে বসে শুনি ত্রিফলা ধ্বস্ত পুরাণ, যেন বা
বাণপ্রস্থ— চন্দ্রাহত প্রাচীর, হাওয়ার রন্ধ্রে ঘুমিয়ে
একজন সামুরাই— খসা তরবারি, কফিন, একটি
দীর্ঘ— কবিতা, যার নিঃশ্বাসের ভারে কাঁপছে দূর
একত্রিশে জানুয়ারি…”
(তানহিম আহমেদ: ভাঙা রাত্রির জরায়ু থেকে)
২,”সকল ক্ষতি করুণায় দুধ হয়ে যায়
সভ্যতার পরীক্ষা কেন দেব আমি
আমার মনের বনে
কেন তর্ক জেগে আছে
বাতাসের ক্ষয়ের রূপে
কাঠের অন্ধকার
পরীক্ষায় কি কালী দেবে
কালী কষতে দিয়ে
তোমার ইচ্ছা ছাড়া আমি চলি
কে তা বলেছে
তুমি নিজে চালাও নিজে শাস্তি দাও
মা তোমার বেরঙ ফুল রঙিন হল
আমার মনের মতো
অতদূর দুধ কেবল
আমার মা-টি হয়”
(আমি আমার নবজাতক: অনুপম মুখোপাধ্যায়)
৩,”চেয়ার। বোটানিক্যাল ফিগার৷ বন থেকে চুরি হয়ে যাওয়া কান্না। এখানে ছিলো। আমাদের ভীড়ে। সবাইকে মেরে ফেলা হয়েছে। চেয়ারটা দেখেছে। ঘরে ফিরে হাতলে হাত রাখতেই নিজের কান্না শুনছি। হাতলে ছিলো রক্ত। পায়াতে ঘ্রাণ পিষ্ট হচ্ছে; যাকে পিশা হয়েছে তার৷ দ্রুতসময় কান্না আত্মস্থ করছে বাতাসের৷ অন্যরুমে যাইতে যাইতে ভাবতেছি; দীর্ঘদিন চেয়ারের লগে থাকতে থাকতে মানুষগুলা চেয়ার হইছে নাকি চেয়ারটা মানুষ?”
(চেয়ার: ইবনে শামস)
প্রথম কবিতায় ‘অক্ষয় ডায়েরি’ যদি জীবনযাপনের ক্ষেত্র হয়, তাহলে ‘জন্মান্ধ মানুষ’ তো লিবিডোরও ধারক। কেননা তা আদি প্রবৃত্তিরই অন্ধতা নিয়ে আজীবন পুড়ছে।’শেকড়’ শব্দে সেই আদি উৎসকেই বহন করে। তারপর ‘রোদবৃক্ষ’,’রাত্রির যোনি’,’ত্রস্তলিপি’, ‘সোমপুর’ সবকিছুই তার ক্ষেত্রভূমি হয়ে ওঠে। ‘ব্যর্থহাসি’ কথাটিই চার্লি চ্যাপলিনসহ উচ্চারিত হলে ঐতিহাসিক নিদর্শনে তা স্থিতি জানান দেয়। পরবর্তী শব্দগুলিও অর্থাৎ ‘সামুরাই’ পর্যন্ত সবই দীর্ঘ কবিতা যা সভ্যতা রচনা করেছে। একত্রিশ জানুয়ারি সময় সীমানাকে উল্লেখ করা সত্ত্বেও তা হয়েছে আবহমান।
দ্বিতীয় কবিতায় ‘ক্ষতির দুধ হওয়া’ অটোমেটিক রিয়ালিজমের বা কিউবিজমের প্রভাব বলা যায়। আর মুক্তজীবন সভ্যতার কাছে দায়বদ্ধ থেকেও ‘বাতাসের ক্ষয়ের রূপ’ এবং ‘কাঠের অন্ধকার’ হয়ে ‘কালী কষতে দেওয়া’র মধ্যেও ইচ্ছার বিবরণ চলে এসেছে। বাস্তবে এর খেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। শুধু মায়ের বেরং ফুল রঙিন হওয়াতেই আদি উৎসের পর্যাপ্ততা ধরা পড়ে। বাস্তবতাকে অবাস্তবতা-ই নিয়ন্ত্রণ করেছে—বলেই বিশেষণও পাল্টে গেছে। ‘অতদূর দুধ কেবল/ আমার মা-টি হয়’ হাইফেন যুক্ত শব্দে।
তৃতীয় কবিতায় চেয়ার বোটানিক্যাল ফিগার হয়ে উঠে তার অস্তিত্ব জানান দিয়েছে। কিন্তু ‘বনের চুরি করা কান্না’,’ভিড়’, ‘মেরে ফেলা’
শব্দগুলি এক একটা গল্প তৈরি করতে চেয়েছে। অবশ্য তা গল্প হয়ে ওঠেনি। কান্না একটা চরিত্র হয়েও তা মানুষের না চেয়ারের বোঝা যায়নি। লিবিডো ভিন্ন এক তাৎপর্যে আশ্রিত হয়েছে শুধু চেয়ারের উল্লেখে। সময়ের কান্না আত্মস্থ করেই তার ব্যাপ্তিযাত্রা। ‘ভাবতেছি’ ক্রিয়াপদটি আত্মগত অনুজ্ঞা থেকেই সমূহ সভ্যতাগামী মানুষের ক্রিয়ায় রূপান্তরিত হয়েছে। অ্যাবস্ট্রাক্ট কবিতা অ্যাবসার্ড কবিতায় সহজেই চলাচল করতে পারে। লিবিডো যেমন ভদ্র মার্জিত বিলাসী সৌন্দর্য পিয়াসী আবেগের জন্ম দেয়, তেমনি লিবিডো ব্যর্থতাকেও আত্মধ্বংসী পাগলামি বা আত্মহত্যাকারীতে রূপান্তরিত করে। কবিতা দুই পথেই লক্ষ্যে পৌঁছতে চায়। প্রচলিত শিল্পবোধকে অস্বীকার করে সিলেবাসের বাইরে আত্মপীড়নের অথবা আত্মযাপনের স্বপ্নাদর্শকে গ্রহণ করে। রক্ষণশীলতাকে কাম্য মনে করে না। তাই ভালো কবিতা প্রতিমুহূর্তে আমাদের কাছে অনাস্বাদিত নতুন বলে মনে হয়। বহুমুখী পর্যবেক্ষণ না থাকলে তাকে গ্রহণ করা যায় না।অলিভার ওয়েন্ডেল হোমস(১৮০৯-১৮৯৪) আমেরিকান চিকিত্সক ও কবি। তাঁর একটি উদ্ধৃতি স্মরণযোগ্য:
“Wisdom is the abstract of the past, but beauty is the promise of the future.”
(Oliver Wendell Holmes, Sr.)
অর্থাৎ প্রজ্ঞা অতীতের বিমূর্ততা, কিন্তু সৌন্দর্য ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি।এই অতীতের বিমূর্ততার ওপরেই ভবিষ্যতের সৌন্দর্য দাঁড়িয়ে থাকে। সাধারণত এই কবিতা প্রধানত ধ্বনির ওপর তার অর্থের জন্য নির্ভরশীল। কবি এডিথ সিটওয়েল একেই বিমূর্ত কবিতা বলে অভিহিত করেছেন। এডিথ সিটওয়েল নিজে ওই ধারার বেশকিছু উল্লেখযোগ্য কবিতা লিখেছেন। তাঁর কাব্যসঙ্কলনের নাম Facade(ফাসাদ)।
তাঁর একটি কবিতা এখানে উদ্ধৃত হল:
steel facade
“behind her steel facade
is a sorrow with no reason
emotions locked imprisoned
morph into despair
behind her steel facade
hides a boiling, raging love
longing to be free
like a tiny white-winged dove
behind her steel facade
is a well filled deep with tears
coiling like storm waters
like her deepest darkest fears
behind her steel facade
lives a hope with dying light
with smoke and flickering life
it died and turned to night”
ইস্পাত সম্মুখভাগ
“তার ইস্পাত সম্মুখের পিছনে
একটি দুঃখ আছে কোনো কারণ ছাড়াই
আবেগ বন্ধ করে রাখা
কারুকার্যকে হতাশায় আটকে
তার ইস্পাত সম্মুখের পেছনে
একটি উষ্ণতা লুকিয়ে আছে, রাগী ভালোবাসা মুক্ত হতে চায়
ছোট্ট সাদা ডানাওয়ালা ঘুঘু
তার ইস্পাতের সম্মুখভাগের পিছনে
একটি ভালো করে ভরা অশ্রুর
মতো কুণ্ডলী ঝড় জলের
তা গভীরতম অন্ধতম ভয়ের মতো
তার ইস্পাত সম্মুখের পিছনে
ধোঁয়া এবং ঝলকানি দিয়ে মরা আলোর সাথে একটি আশা বাস করে যা মারা যায় এবং রাতে পরিণত হয়”
কারুণ্য, হতাশা, অন্ধকার যা সবই ভেতরের সংকটের সঙ্গে বাইরের সংকটকে মিলিয়ে দিয়েছে। বাইরে ইস্পাত মুখ যা কঠোর কঠিন হতে পারত, কিন্তু তা হয়নি। তার আড়ালে বিরাজ করেছে বিপন্ন অস্তিত্বের নির্বিকল্প অভিক্ষেপ। কবিতার স্তবক বিন্যাস থাকলেও প্রচলিত রীতির মতো কোনো স্থির লক্ষ্য নেই। প্রচলিত রীতি মেনে কবিতার ব্যাকরণও প্রয়োগ করা হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই বিমূর্ত কবিতার যে গঠন বৈশিষ্ট্য আঙ্গিকগত এবং ভাবগত দুই ক্ষেত্রেই সামঞ্জস্য বিধান ঘটেছে। ‘রাগী ভালোবাসা’ মুক্ত হতে চায় raging love longing to be free যে লিবিডোকেই মুক্তি দিতে চায় তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু অবশেষে রাতের মধ্যে রাত হয়ে যাওয়া বিমূর্ততার চূড়ান্ত পর্যায়েই পৌঁছে যাওয়া।
ইংরেজ কবি জিরাল্ড ম্যানলি হপকিনস ও ফরাসি কবি র্যাঁবো বিমূর্ত কবিতার ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছেন। বাংলাতেও বিমূর্ত কবিতা যথেষ্ট সমৃদ্ধ হয়ে চলেছে। ব্রহ্মবাদ এবং অধ্যাত্মবাদে যে মেটাফোরের প্রয়োগ ঘটে চলেছে কবিতার সেই ধারা বাদ দিলে, বিমূর্তবাদকেই লিবিডোর একটা শক্তি হিসেবে কবিরা প্রয়োগ করে চলেছেন। ভিন্ন ধরনের কবিতা মানেই বিমূর্ত কবিতা। #