রিয়ালকে গুঁড়িয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে ম্যানচেস্টার সিটি
রেকর্ড চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে কী দুর্দান্ত ফুটবলই না খেলল ম্যানচেস্টার সিটি! আক্রমণের ঝড় তুলে প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করে প্রথমার্ধেই দুবার জালে বল পাঠালেন বের্নার্দো সিলভা। বিরতির পর রিয়াল মাদ্রিদ ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল বটে, কিন্তু পারল না ন্যূনতম ব্যবধান গড়তেও। স্মরণীয় জয়ে ইতিহাস রচনার বাসনায় চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে পা রাখল ম্যানচেস্টার সিটি।
ইতিহাদ স্টেডিয়ামে বুধবার রাতে সেমি-ফাইনালের ফিরতি লেগে ৪-০ গোলে জিতেছে পেপ গুয়ার্দিওলার দল। সিলভার জোড়া গোলের পর দ্বিতীয়ার্ধে আত্মঘাতী গোল করেন এদের মিলতাও। শেষ দিকে চতুর্থ গোলটি করেন হুলিয়ান আলভারেস।
প্রথম লেগ ১-১ ড্র হওয়ায় দুই লেগ মিলিয়ে ৫-১ অগ্রগামিতায় ফাইনালে উঠল সিটি।
তিন মৌসুমে মধ্যে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার ইউরোপ সেরা প্রতিযোগিতাটির ফাইনালে উঠল ইংলিশ চ্যাম্পিয়নরা।
স্কোরলাইনের মতো মাঠে দুই দলের পারফরম্যান্সেও এ দিন ছিল অনেক বড় ব্যবধান। সিটির শক্তিশালী আক্রমণভাগ সামলানোর জন্য রিয়ালের রক্ষণভাগকে যতটা দৃঢ় হতে হতো, তা যে তার ধারেকাছেও ছিল, সেটা স্কোরলাইনেই স্পষ্ট। তাদের মাঝমাঠও ছিল বিবর্ণ। আর আক্রমণভাগকে বলা যায় পুরোপুরি ব্যর্থ; মোক্ষম সময়ে ভুল পাস, বল ছেড়ে দেওয়া, যেন সবই ছিল সাদামাটা।
ম্যাচ শুরুর বাঁশি বাজতে শুরু হয় সিটির আক্রমণ। প্রবল চাপ সামলে রিয়াল নিজেদের সীমানা থেকে সেভাবে বের হতেই পারছিল না।
সপ্তম মিনিটে দারুণ একটি সুযোগও পায় স্বাগতিকরা। কিন্তু কেভিন ডে ব্রুইনের পাস পেয়ে বক্সে গোলরক্ষক থিবো কোর্তোয়াকে কাটিয়ে শট নেওয়ার জায়গা পাননি আর্লিং হলান্ড। পাস দেওয়ার মতো আশেপাশে কোনো সতীর্থও ছিল না তার।
মুহূর্ত বাদে বক্সের মধ্যে থেকে রদ্রির দূরের পোস্টে নেওয়া কোনাকুনি শট একটুর জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। ত্রয়োদশ মিনিটে যে সুবর্ণ সুযোগটি নষ্ট করেন হলান্ড, তা দেখে ডাগআউটে মাথায় হাত উঠে যায় গুয়ার্দিওলার। জ্যাক গ্রিলিশের ক্রস গোলমুখে পেয়ে গোলরক্ষক বরাবর হেড করেন তরুণ তারকা।
২১তম মিনিটে কোর্তোয়ার অসাধারণ ক্ষিপ্রতায় বেঁচে যায় রিয়াল। মানুয়েল আকাঞ্জির ক্রসে ছয় গজ বক্সের মধ্যে থেকে জোরাল হেড করেন হলান্ড, ঝাঁপিয়ে কর্নারের বিনিময়ে ঠেকান বেলজিয়ান গোলরক্ষক।
দুই মিনিট পর আর পারেননি কোর্তোয়া। ডান দিক থেকে শাণানো আক্রমণে ডে ব্রুইনের পাস বক্সে ফাঁকায় পেয়ে জোরাল শটে দলকে এগিয়ে নেন পর্তুগিজ মিডফিল্ডার সিলভা। এমন বিপজ্জনক জায়গায় তার মার্কিংয়ে কারোর না থাকাটা দৃষ্টিকটু।
৩০ মিনিট পর রিয়ালকে একটু গা ঝাড়া দিতে দেখা যায়। পরপর দুই মিনিটে ভিনিসিউস জুনিয়র ও করিম বেনজেমা দুটি প্রতি-আক্রমণের চেষ্টা করেন, যদিও গোলরক্ষকের পরীক্ষাও নিতে পারেননি তারা।
৩৫তম মিনিটে অনেক দূর থেকে বুলেট গতির শট নেন টনি ক্রুস। লাফিয়েও বলের নাগাল পাননি সিটি গোলরক্ষক এদেরসন। তবে ভাগ্যের ফেরে বল লাগে ক্রসবারে।
রিয়াল যখন জেগে উঠছিল, চেষ্টা করছিল ঘুরে দাঁড়ানোর, তখনই দ্বিতীয় আঘাত হানে সিটি। ৩৭তম মিনিটে ব্যবধান দ্বিগুণ করে তারা, স্তব্ধ হয়ে যায় সফরকারীরা। ইলকাই গিনদোয়ানের শট প্রতিপক্ষের পায়ে লেগে বল চলে যায় সিলভার কাছে, নিখুঁত হেডে জালে পাঠান তিনি।
পজেশন কিংবা আক্রমণ, প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রথমার্ধে একচেটিয়া আধিপত্য করে সিটি। ৭০ শতাংশের বেশি সময় বল দখলে রেখে গোলের উদ্দেশ্যে ১৩ শট নিয়ে পাঁচটি লক্ষ্যে রাখতে পারে তারা। বিপরীতে রিয়াল নিতে পারে ওই একটি শটই।
দ্বিতীয়ার্ধের পঞ্চম মিনিটে শেষ বাধা পেরিয়ে যাওয়ার সময় ফাউলের শিকার হন ভিনিসিউস। ম্যাচে প্রথম হলুদ কার্ড দেখেন সিটির ডিফেন্ডার রুবেন দিয়াস।
ওই ফ্রি কিকে গোল পেতে পারত রিয়াল; ডাভিড আলাবার শটে বল শেষ সময়ে নিচু হয়ে ক্রসবার ঘেঁষে জালে জড়াতে যাচ্ছিল, কোনোমতে কর্নারের বিনিময়ে ঠেকান এদেরসন।
৭২তম মিনিটে ম্যাচের ফলাফলে প্রায় নিষ্পত্তি হয়ে যেতে পারত। রক্ষণকে ফাঁকি দিয়ে বক্সে ঢুকে পড়েন হলান্ড, সামনে একমাত্র বাধা কোর্তোয়া। তবে প্রতিপক্ষের শট পা বাড়িয়ে রুখে দেন গোলরক্ষক।
তবে চার মিনিট পর নিজেদের ভুলেই ম্যাচ থেকে একরকম ছিটকে যায় রিয়াল। বাঁ দিক থেকে ডে ব্রুইনের ফ্রি কিকে বক্সে কেউই ছোঁয়া দিতে পারেনি, তবে ক্লিয়ার করতে গিয়ে নিজেই নিজেদের জালে বল পাঠান ডিফেন্ডার মিলিতাও।
৮৩তম মিনিটে অসাধারণ ডাবল সেভে জাল অক্ষত রাখেন এদেরসন। প্রথমে বেনজেমার শট ঠেকানোর পর দারুণ ক্ষীপ্রতায় দানি কারভাহালের প্রচেষ্টাও রুখে দেন ব্রাজিলিয়ান গোলরক্ষক।
এই গোলের পরপরই সিটির গ্যালারিতে শুরু হয়ে যায় জয়োৎসব। তবে রিয়ালের ভরাডুবির শেষ নয় সেখানেই।
তিন মিনিট যোগ করা সময়ের প্রথম মিনিটের খেলা চলে তখন; ৮৪তম মিনিটে বদলি নামা ফিল ফোডেনের নো লুক পাস বক্সে পেয়ে প্রথম ছোঁয়াতেই জালে পাঠান ৮৯তম মিনিটে বদলি নামা আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড আলভারেস।
গত আসরের সেমি-ফাইনালে এই রিয়ালের বিপক্ষেই ফিরতি লেগে অবিশ্বাস্য কয়েক মিনিটে পথ হারিয়ে হেরে বসেছিল সিটি। এবার আর কোনো ভুল হতে দেয়নি তারা। বলা যায়, ইউরোপের রেকর্ড ১৪ বারের চ্যাম্পিয়নদের কোনো পাত্তাই দেয়নি তারা।
লক্ষ্য এবার আরাধ্য ইউরোপ সেরার মুকুট মাথায় তোলার।
২০২০-২১ মৌসুমে প্রথমবার ফাইনালে উঠেছিল ম্যানচেস্টার সিটি। ফেভারিটের মর্যাদায় মাঠে নেমেও সেবার চেলসির বিপক্ষে হেরে বসেছিল তারা। এবার সেই হতাশা ভোলার পালা।
যে লক্ষ্যে তাদের প্রতিপক্ষ ইন্টার মিলান। আগামী ১০ জুন ইস্তানবুলে তিনবারের চ্যাম্পিয়নদের মুখোমুখি হবে গুয়ার্দিওলার সিটি।