এরদোয়ানের জয় বা পরাজয় নিয়ে কেন বাইডেনের মাথাব্যথা?

সাময়িকী ডেস্ক
সাময়িকী ডেস্ক
7 মিনিটে পড়ুন

এরদোয়ানের জয় বা পরাজয় নিয়ে কেন বাইডেনের মাথাব্যথা?

তুরস্কের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইপ এরদোয়ানের জয় বা পরাজয় শুধু তুর্কি জনগণের জন্য নয়, যুক্তরাষ্ট্র এবং এর প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মাথাব্যথারও কারণ।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেন দায়িত্ব নেওয়ার সময় বিশ্বের যে কয়েকজন রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান নিজ দেশের রাজনীতিতে ‘একনায়ক’ হিসেবে চিত্রিত করতে পেরেছেন, এরদোয়ান তাদের একজন।

দু্ই দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা এরদোয়ান আরেকবার নির্বাচিত হওয়ার পথে প্রথম দফা ভোটে এগিয়ে আছেন। তবে ৫০ শতাংশ ভোট না পাওয়ায় আবার ভোটে যেতে হচ্ছে তাকে।

প্রথম দফা ভোটের ফল দেখে সোমবার সিএনএনের এক প্রতিবেদনে এরদোয়ান এবং তার ভোট ভাগ্যের সঙ্গে বাইডেনের জড়িত থাকা নিয়ে একটি বিশ্লেষণী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

- বিজ্ঞাপন -

যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ মাধ্যমটির ভাষ্যে, বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্র ও বাইডেন প্রশাসনের ‘গণতন্ত্রের তরণী’র গতিপথকে যারা বারবার চ্যালেঞ্জ করে চলেছেন, তাদের মধ্যে এরদোয়ান অবশ্যই বিশেষভাবে চিহ্নিত হবেন।

একাধারে ইউরোপের সবচেয়ে বড় মিত্র ও শত্রু, যুক্তরাষ্ট্রের পর নেটোর সামরিক শক্তির সবচেয়ে বড় স্তম্ভ তুরস্ক তাদের বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের নেতৃত্বে বলকান, ভূমধ্যসাগর, উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে এক অনন্য নীতি নিয়ে এগিয়েছে, যা বাইডেন প্রশাসনের নীতিকে বার বারই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।

এরদোয়ানের জয় বা পরাজয় নিয়ে কেন বাইডেনের মাথাব্যথা?
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে নেটোভুক্ত তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইপ এরদোয়ানের সখ্য যুক্তরাষ্ট্রকে চাপে রাখছে |ছবি: রয়টার্স

এরদোয়ান যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট নেটোর অন্যতম নেতা হলেও তিনি এই জোটের মূল শত্রু রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সখ্য বজায় রাখছেন। আবার যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক পররাষ্ট্র নীতিতে চিহ্নিত সবচেয়ে বড় ‘সংকট’ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গেও রয়েছে তার মাখামাখি।

মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় মিত্র ইসরায়েলের সঙ্গে চাপান-উতোর সম্পর্ক রাখার পাশাপাশি ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে চিহ্নিত ইরানের সঙ্গেও এরদোয়ানের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে।

সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক নীতি বদলানোর বিষয়েও চাপ দিয়ে যাচ্ছেন তুরস্কে দুই দশক ধরে ক্ষমতাসীন এরদোয়ান। সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র হিসেবে পরিচিত কুর্দিদের উপর সামরিক অভিযান চালাচ্ছেন, আবার প্রতিবেশী আর্মেনিয়া-আজারবাইজান সংকটেও মধ্যস্ততা করছেন, যেখানে মস্কোর প্রভাবও রয়েছে।

- বিজ্ঞাপন -

সবমিলিয়ে বাইডেনের পররাষ্ট্র নীতিতে বড় এক ধাঁধাঁর নাম তাইপ এরদোয়ান।

রোববারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শেষে এরদোয়ান এগিয়ে থাকলেও সরাসরি নির্বাচিত হওয়ার মতো যথেষ্ট ভোট না পাওয়ায় তাকে ‘রানঅফ’ ভোটে যেতে হচ্ছে বিরোধীদলীয় নেতা কেমাল কিরিচতারোলুর সঙ্গে। ২৮ মে সেই ভোট হতে পারে।

এই ভোটে জিততে এরদোয়ানকে হয়ত ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার বা বড় ছাড় দিয়ে ভোটে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে সমঝোতা করতে হতে পারে; যদিও তার বিশ্বাস, চূড়ান্ত ভোট গণনায় তিনি ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে সম্ভাব্য রানঅফ ভোট এড়াতে পারবেন।

- বিজ্ঞাপন -
এরদোয়ানের জয় বা পরাজয় নিয়ে কেন বাইডেনের মাথাব্যথা?
টানা দুই দশক তুরস্কের প্রেসিডেন্ট পদে রয়েছেন রিসেপ তাইপ এরদোয়ান |ছবি: রয়টার্স

সিএনএন লিখেছে, জো বাইডেনের যুগ শুরুই হয়েছে দেশ ও দেশের বাইরে একনায়কতন্ত্র, গণতন্ত্রের উপর হামলা এবং উদীয়মান স্বৈরশাসকদের ছায়ায়।

তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভের পরপরই ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটলে হামলা করে পরাজিত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকরা, যা যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত।

এই পটভূমিতে ক্ষমতা নেওয়ার পর এখন বাইডেন ইউক্রেইনের গণতন্ত্র রক্ষার যুদ্ধে নেমেছেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে। এই যুদ্ধে তার ঘরের শত্রু ডনাল্ড ট্রাম্প ও তার রিপাবলিকান সমর্থকেরা। যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে কিইভকে কোটি কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে বাইডেন প্রশাসন, যা নিয়ে এরইমধ্যে অসন্তোষ প্রকাশ করতে শুরু করেছেন বেশ কিছু রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা, যারা ট্রাম্পের সমর্থক।

দেশের ভেতরের এমন পটভূমিতে বিদেশে বাইডেনের পররাষ্ট্র নীতি বাস্তয়নে বাধা হয়ে উঠছেন এরদোয়ানের মতো কর্তৃত্বপরায়ণ রাষ্ট্রনেতারা। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র ইসরায়েলেও নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার সংবিধান বদলে সেদেশের গণতন্ত্রকে সঙ্কুচিত করার পথ ধরেছে।

গণতন্ত্র রক্ষার যে নীতি-অজুহাত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির মূল স্তম্ভ, তা টিকিয়ে রাখতে এরদোয়ানের মতো নেতার পরাজয় যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলেই মতামত তুলে ধরা হয়েছে সিএনএনের বিশ্লেষণে।

এরদোয়ানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, দুই দশকের শাসনামলে তিনি তুরস্কের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো, যেমন বিচারবিভাগ ও গণমাধ্যম এবং গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করেছেন।

সিএনএন বলছে, আবারও নির্বাচিত হলে তিনি তুরস্কের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আরও সংকুচিত করার পাশাপাশি পশ্চিমের নেতৃত্বকে আরও সংকটের মুখেই ফেলবেন। যার অন্যতম উদাহরণ নেটোতে সুইডেনের যোগদানে বাধা দেওয়া।

এরআগে তুরস্কবিরোধী কুর্দি নেতাদের আশ্রয় দেওয়া নিয়ে ফিনল্যান্ডের বিষয়ে আপত্তি তুললেও পরে সমঝোতার মাধ্যমে এর সুরাহা হয়, কিন্তু সুইডেনকে ছাড় দেননি এরদোয়ান।

তুরস্কের নির্বাচন নিয়ে রোববার সাংবাদিকরা ডেলাওয়ারে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “ বিশ্বের ওই অংশে যথেষ্ট সমস্যা রয়ে গেছে।”

এরদোয়ানের জয় বা পরাজয় নিয়ে কেন বাইডেনের মাথাব্যথা?
চীনের প্রভাব বৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথার কারণ, আর দেশটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে রিসেপ তাইপ এরদোয়ানের |ছবি: রয়টার্স

বিশ্বজুড়ে বাইডেনের গণতন্ত্র রক্ষার নীতি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির ধ্রুপদী সংকটের আরেকটি উদাহরণ হিসেবেই চিহ্নিত হচ্ছে, সংকটটি হল- ‘কী করা উচিৎ যখন কোনো দেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে কৌশলগত স্বার্থের সংঘাত হয়’।

স্বার্থ ও নীতির এই দ্বন্দ্ব সবচেয়ে স্পষ্ট হয়েছিল ২০১৮ সালে তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুলে সৌদি আরব দূতাবাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক জামাল খাশুগজিকে খুনের ঘটনায়।

ওই হত্যার ঘটনায় সরাসরি সৌদি আরবের জড়িত থাকার বিষয়ে প্রমাণ মিললেও যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সৌদি সরকারের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে রাজি হয়নি। এ বিষয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারে সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানের বিরুদ্ধে কড়া বক্তব্য দিলেও ক্ষমতা নেওয়ার পর জো বাইডেনও চুপ হয়ে যান; বরং রিয়াদ সফরে সালমানের সঙ্গে ‘ফিস্ট বাম্প’ করে নিজের সমর্থকের মুখে অনেকটাই কালি দেন তিনি।

ওয়াশিংটনের একই ধরনের ‘নীতি সংকট’ দেখা যাচ্ছে থাইল্যান্ডের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও। গত কয়েক বছর ধরে সামরিক জান্তার শাসনাধীন থাইল্যান্ডেও রোববার ভোট হয়েছে। ভোটে উদারপন্থি, গণতন্ত্রমনা দলগুলো জয়ী হতে যাচ্ছে বলে ধারণা পাওয়া গেছে, যারা সেদেশে আবারও পূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের অঙ্গীকার করেছে।

বাইডেনের প্রশাসনের নীতি অনুযায়ী এই দলগুলোর প্রতি ওয়াশিংটনের জোর সমর্থন জানানোর কথা থাকলেও হোয়াইট হাউজের পক্ষ থেকে খুব একটা উচ্ছ্বাস দেখানো হচ্ছে না।

থাইল্যান্ডে সামরিক জান্তার সমর্থনপুষ্ট ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী এই নির্বাচনে গণতন্ত্রপন্থিদের এই বিজয়কে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করলে যুক্তরাষ্ট্রের উপর চাপ বাড়বে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার। কিন্তু ওয়াশিংটন হয়ত তা করতে চাইবে না, কারণ এই মুহূর্তে থাইল্যান্ডের জেনারেলদের ক্ষেপিয়ে দিতে বাইডেনের প্রশাসনের আগ্রহ কম। থাইল্যান্ড বিগড়ে গিয়ে যদি চীনের শিবিরে হেলে পড়ে, তাহলে বিশ্বের ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনীতিক স্বার্থ হুমকিতে পড়বে।

প্রতিবেদনে সিএনএন উপসংহার টেনেছে, এ ধরনের যোগ-বিয়োগের রাজনীতিতে গণতন্ত্রকে সমর্থন জানান হয়ত সবসময় বাস্তবসম্মত হয় না, যা আমেরিকার ‘ডিএনএ’তেই রয়েছে। আর ভূরাজনীতির এই সমীকরণই বলে দিচ্ছে যে কেন যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তির পক্ষে এরদোয়ানের মতো আঞ্চলিক নেতাদের প্রভাব অস্বীকার করা অসম্ভব।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!