কবিতা যখন নিজের সঙ্গে নিজেরই সংলাপ, তখন নিজেকে দেখার এর থেকে বড় আয়না আর আমাদের সামনে নেই। আয়নার সঙ্গে নিজেকে দেখার পার্থক্য হল, আয়না শুধু বাহিরের অবয়বটি দেখাতে পারে, কিন্তু কবিতা ভেতরের রূপটি তুলে আনতে পারে। আর এই ভেতরের রূপটিই আসল রূপ। এখানে ছলনা সাজে না। মিথ্যা আরোপ থাকে না। ভাঙনের নৈঃশাব্দ্যিক ক্রিয়া ও কান্না একইসঙ্গে উঠে আসে। মনে রাখা দরকার, পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই এক আত্মগত যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকে। পৃথিবীতে এমন কোনো বস্তু বা সুখ নেই যা তাকে সুখী করবে। আনন্দে রাখবে। যে আনন্দ যে সুখ সে পেতে চেয়েছে তা খুবই অপ্রতুল। যা পেয়েছে তাতে সন্তুষ্ট হতে পারে না।
কবিতা এক ধরনের শূন্যতা থেকেই উদ্গত হয়। কবিতা কখনো পূর্ণের হতে পারে না। সিলভিয়া প্লাথ নিজের দ্বৈত সত্তাকেই উপলব্ধি করে ‘In Plaster’ কবিতায় লিখেছিলেন:
“I shall never get out of this! There are two of me now:
This new absolutely white person and the old yellow one,
And the white person is certainly the superior one.
She doesn’t need food, she is one of the real saints.
At the beginning I hated her, she had no personality —
She lay in bed with me like a dead body
And I was scared, because she was shaped just the way I was”
অর্থাৎ
আমি কখনোই এর থেকে বের হতে পারব না! আমি এখন দু’জন আছি:
এই নতুন একেবারে সাদা মানুষ এবং পুরানো হলুদ এক,
এবং সাদা ব্যক্তি অবশ্যই উচ্চতর এক।
তার খাবারের দরকার নেই, সে প্রকৃত সাধুদের একজন।
শুরুতে আমি তাকে ঘৃণা করতাম, তার কোনো ব্যক্তিত্ব ছিল না—
সে আমার সাথে বিছানায় লাশের মতো শুয়ে আছে
এবং আমি ভয় পেয়েছিলাম, কারণ সে আমার মতোই আকৃতির ছিল
নিজেকে দেখা, নিজের ভেতরের শূন্যতাকে দেখা এবং তাকে উপলব্ধি করা যে কবিতারই স্বর তা বলাই বাহুল্য। সিলভিয়া প্লাথ যে চরম শূন্যতার ভিতর দিয়েই যাত্রা করেছিল এবং ধ্বংসের মধ্যে প্রবেশ করেছিল তা তাঁর জীবনের পরিণতি হতেই বোঝা যায়। নিজের সঙ্গেই তাঁর গভীর সংলাপের কাহিনি প্রায় সমস্ত কবিতাতেই প্রতিফলিত হয়েছিল।
এই কবিতার শেষে তাই লিখেছিলেন:
“আমি আমার শক্তি সংগ্রহ করছি; একদিন আমি তাকে ছাড়াই পরিচালনা করব,
এবং সে তখন শূন্যতার সাথে ধ্বংস হয়ে যাবে এবং আমাকে মিস করতে শুরু করবে।”
এক সত্তাকে ধ্বংস করলে আর এক সত্তা বেঁচে থাকতে পারবে না। প্রতিনিয়ত সংঘাতের মধ্য দিয়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে অগ্রসর হওয়া এই আত্মযাপনের ঘোর থেকেই তিনি মৃত্যুতেই প্রবেশ করতে চেয়েছেন। তাই সেই অবধারিত শূন্যতা জেগে উঠেছে। রাইনার মারিয়া রিলকে ‘The First Elegy’-তে লিখেছেন:
“Voices.
Voices.
Listen my heart as only
Saints have listened: until the gigantic call lifted them
off the ground; yet they kept on impossibly
kneeling and didn’t notice at all:
so complete was their listening.
Not that you could endure
God’s voice-far from it.
But listen to the voice of the wind
and the ceaseless message that forms itself out of silence.”
অর্থাৎ
কণ্ঠস্বর।
কণ্ঠস্বর।
শুধু আমার হৃদয় শোন
সাধুরা শুনেছেন: যতক্ষণ না বিশাল ডাক তাদের তুলে নেয়
ভূমি বন্ধ; তবুও তারা অসম্ভবভাবে চালিয়ে গেল
হাঁটু গেড়ে বসে ছিল এবং মোটেও লক্ষ করেনি:
তাই তাদের শ্রবণ সম্পূর্ণ ছিল।
এমন নয় যে আপনি সহ্য করতে পারেন
ঈশ্বরের কণ্ঠস্বর থেকে দূরে।
তবে বাতাসের আওয়াজ শুনুন
এবং অবিরাম বার্তা যা নীরবতা থেকে নিজেকে তৈরি করে।
শূন্যতা, নীরবতা এবং সাধু প্রসঙ্গ কবিতাংশগুলিতে আত্মস্ফুরণের নির্বিকল্প এক পর্যটন অনুধাবন করা যায়; যেখানে আত্মবোধের বিস্তারই বড় হয়ে উঠেছে। নিজেকে নিজেই বিশ্লেষণ করার প্রয়াস। মূলত এই ভাবনা থেকেই বাংলা ভাষায় কাব্য চেতনার গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করা যায়। টি এস এলিয়ট ফোর কোয়ার্টেটস্ কাব্যের ইস্ট কোকারে লিখেছিলেন:
“And you see behind every face the mental emptiness deepen”
অর্থাৎ আর আপনি দেখতে পাচ্ছেন প্রতিটি মুখের পিছনে মানসিক শূন্যতা গভীর।
এই মানসিক শূন্যতা সৃষ্টির মৌলিক প্রজ্ঞা থেকেই ধাবিত হয়ে আসছে। এর থেকে কিছুতেই বেরিয়ে আসা যায় না।
কিন্তু নীরবতার মধ্যেও কথা আছে, শূন্যের মধ্যেও ঢেউ আছে সে কথা শঙ্খ ঘোষও লিখে গেছেন
“বলিনি কখনো?
আমি তো ভেবেছি বলা হয়ে গেছে কবে।
এভাবে নিথর এসে দাঁড়ানো তোমার সামনে
সেই এক বলা
কেননা নীরব এই শরীরের চেয়ে আরো বড়ো
কোনো ভাষা নেই
কেননা শরীর তার দেহহীন উত্থানে জেগে
যতদূর মুছে নিতে জানে
দীর্ঘ চরাচর
তার চেয়ে আর কোনো দীর্ঘতর যবনিকা নেই।
কেননা পড়ন্ত ফুল, চিতার রুপালি ছাই, ধাবমান শেষ ট্রাম
সকলেই চেয়েছে আশ্রয়
সেকথা বলিনি? তবে কী ভাবে তাকাল এতদিন
জলের কিনারে নিচু জবা?
শূন্যতাই জানো শুধু? শূন্যের ভিতরে এত ঢেউ আছে
সেকথা জানো না?”
প্রতিটি নীরবতা, শূন্যতা থেকেই আমাদের জীবনযাত্রার মর্মর ধ্বনি উত্থিত হয়। এই ভাষা একমাত্র কবিতাই জানে। সাম্প্রতিক কবিতায় বর্ণনা সেই কারণে অনেকটাই কমে এসেছে। একমুখী চেতনা নিয়ে বিষয়ভিত্তিক কবিতাও খুব কম লেখা হয়। জীবনের নৈরাশ্য ও দহন, বিস্ময় ও আশ্রয়, কম্পন ও কার্যকারণ আজকের কবিতায় সব সময় খুঁজে পাওয়া যায় না।
তবু এক শূন্যতার স্পেস আমাদের জীবন রচনাকে ছায়াগ্রস্ত করে আছে। আমরা ভাতের জন্য লড়াই করেছি, অধিকারের জন্য লড়াই করেছি, সাম্য ও সহাবস্থানের জন্য লড়াই করেছি। মানবিকতাবাদের প্রতিষ্ঠাও চেয়েছি। দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা আমাদের কাম্য ছিল না। আমরা যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি। তারপর নিসর্গ-আকাশ, নক্ষত্র, চাঁদ-সূর্য, মিছিল ও মেহনত নিয়ে আন্দোলন করেছি।কবিতায় শব্দকে তরবারি করে তুলেছি। বোধকে শানিত করেছি। রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতা করে লিখতে চেয়েছি কবিতা। আর সেই সময়ের কবিতার নাম দিয়েছি ‘আধুনিক কবিতা’।
কিন্তু বর্তমানে আধুনিক শব্দটিও পরিবর্তিত হয়ে গেছে। তার বদলে আমরা কেউ কেউ পুনরাধুনিক অথবা উত্তর-আধুনিক শব্দ ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। কবিতাও পথ পরিবর্তন করে শূন্য ও নীরবতার কাছে আত্মস্থিত ধ্বনিপ্রজ্ঞাকে অন্বেষণ করেছে। ব্যক্তিহৃদয়ের চাপ ও তাপ থেকেই নিবেদিত শব্দগুচ্ছ বহুমুখী হয়ে উঠেছে। বিষয়ের বাইরে, অথবা বিষয়ের ভিতর থেকেও এক শৈল্পিক মুক্তির কারবারি হয়ে উঠেছে।
গোলাম রসুল ‘শূন্যের চেয়ে শূন্য’ নামে একটি কবিতায় লিখেছেন:
“শূন্যের চেয়েও আমি শূন্য হয়ে যাই
আলো পার হয়ে দেখি আমার হৃদয়
যে অনুসরণে তৈরি করে নিয়েছি ভালোবাসা আর স্নেহ
শরীরের ভেতর কেঁপে ওঠে পৃথিবী
প্রতিটি হিংসা ধারালো হতে হতে আত্মহত্যা করে
দৃষ্টি অসংখ্য রেখাপাত
যেমন আমাদের আকাশ আর নক্ষত্র
মানুষ কখনো নিখুঁত নয়
অনুশীলন করে মেঘ
বৃষ্টি পড়ে”
শূন্যের অস্তিত্ব থাকলেও কবির অস্তিত্ব nothingness, যেখানে সমগ্র পৃথিবীই নাথিংনেসেরই অন্তর্গত। ভালোবাসা ও স্নেহের প্রবৃত্তি থেকেই সম্পর্ক তৈরি হলেও তা অদৃশ্য। হিংসাদের আত্মহত্যা ধ্বংসেরই নামান্তর। মেঘের অনুশীলনে বৃষ্টিপাত প্রাকৃতিক চৈতন্যের বিস্তার থেকেই সম্ভব। মানুষ যে নিখুঁত নয় তা সবাই জানে। এই শূন্যতার ব্যাপ্তি বর্তমান প্রজন্মের মধ্যেই সঞ্চারিত হয়ে চলেছে। বিষয়কে গুরুত্ব না দিয়ে, বিষয়ের অন্তর্গত শূন্যতার ধারাপাতকেই নিবিড়ভাবে ধারণ করেছেন কবিও।
জালাল আল্-দীন রুমি কবেই লিখেছিলেন:
“The World Which Is Made of Our Love for Emptiness”
অর্থাৎ “এই পৃথিবী যা শূন্যতার জন্য আমাদের ভালোবাসা দিয়ে তৈরি”
আরও বিস্তৃত করে তিনি লিখেছেন:
“শূন্যতার প্রশংসা যা অস্তিত্বকে ফাঁকা করে দেয়।
অস্তিত্ব:
আমাদের সেই শূন্যতার প্রতি ভালোবাসা থেকে তৈরি এই জায়গা!
তবু কোনো না কোনোভাবে আসে শূন্যতা,
চলে যায় এই অস্তিত্ব।”
সুতরাং শূন্যতাই আমাদের অস্তিত্ব, আবার অস্তিত্বই শূন্যতার নামান্তর। গোলাম রসুল যাকে ভালোবাসা ও স্নেহ বলেছেন, রুমি তাকেই অস্তিত্ব বলেছেন। যতই আয়োজন হোক, যতই আড়ম্বর থাকুক, এই শূন্যতার গ্রাসই আমাদের জীবনকে দোলাতে থাকে। তাই চিরন্তন সৌন্দর্য বলে কিছু নেই, চিরন্তন জীবন বলেও কিছু নেই, যা কিছু চিরন্তন তা শুধু শূন্যতা আর শূন্যতার অস্তিত্ব।
আমেরিকান চলচ্চিত্র নির্মাতা, অভিনেতা এবং কৌতুক অভিনেতা, লেখক হেইউড বা উডি অ্যালেন (১৯৩৫) বলেছেন:
“The artist’s job is not to succumb to despair but to find an antidote for the emptiness of existence.”
(Woody Allen, Midnight in Paris: The Shooting Script)
অর্থাৎ
শিল্পীর কাজ হতাশার কাছে নতিস্বীকার করা নয়, অস্তিত্বের শূন্যতার প্রতিষেধক খুঁজে বের করা।
একথা সত্য যে পৃথিবীতে যত শিল্পীই এসেছেন, তাঁরা সকলেই অস্তিত্বের শূন্যতার প্রতিষেধক খুঁজে চলেছেন। কবিতা এই শিল্পেরই অন্যতম। সুতরাং যা আছে—কবিতা তা নয়; যা আমরা দেখছি—তাকে লেখাও কবিতার উদ্দেশ্য নয়। কবিতা শুধু আনন্দের বর্ণনা নয়, দুঃখের অশ্রু নয়, মিছিলের স্লোগান নয়, প্রতিবাদের বাণী নয়— কবিতা অস্তিত্বের, কবিতা ব্যক্তির শূন্যতার, কবিতা নাথিংনেসের। কবিতা যে অন্য কিছু—তা একজন প্রকৃত কবি জানেন। বিশেষ করে সাম্প্রতিক কালের কবিতা চর্চার ক্ষেত্রে একথা স্মরণে রাখা দরকার।
জার্মানভাষী সুইস লেখক রবার্ট ওয়ালসার (১৮৮৭-১৯৫৬) যাকে হেনরিখ ফন ক্লিস্ট এবং ফ্রাঞ্জ কাফকার মধ্যে অনুপস্থিত লিঙ্ক বলে মনে করা হয়। তিনি একটি কবিতায় লিখেছেন :
“How small life is here
and how big nothingness.
The sky, tired of light,
has given everything to the snow.
The two trees bow
their heads to each other.
Clouds cross the world’s
silence in a circle dance”
(Robert Walser, Oppressive Light: Selected Poems by Robert Walser)
অর্থাৎ
এখানে জীবন কত ছোট
আর কত বড় শূন্যতা।
আলোয় ক্লান্ত আকাশ,
তুষারকে সব দিয়েছে।
দুটি গাছ
একে অপরের কাছে মাথা নত করে।
বৃত্তাকার নেচে মেঘ
পৃথিবীর নীরবতা অতিক্রম করে”
শূন্যতা গ্রস্ত জীবন শূন্যতাতেই বিলীন হয়ে যায়। বৃত্তাকার মেঘের মধ্যে নাচ তো সেই শূন্যতারই। গাছের মাথাও নত হয়ে যায়। পৃথিবীর নীরবতার মধ্যেই সব পরিব্যাপ্ত। কবিতাকে তখন আর বাহির দরজায় খুঁজতে যাই না, তা ভেতর থেকেই বেরিয়ে আসে। বাইরের দৃশ্য কার্যত ভেতরেরই বিপন্নতার বিস্ময়। এই সময়ের কবি মাসুদার রহমান ‘পাতকুয়া ও নতুন চাঁদ’ নামক একটি কবিতায়
তাঁর অস্তিত্বের সন্ধান করতে গিয়ে ঐতিহাসিক মিথের আশ্রয় নিয়েছেন, তার মধ্য দিয়েই উপলব্ধির স্বচ্ছতা, ব্যাপ্ততা, গৌরবময়তা প্রকাশ করতে চেয়েছেন। কবিতাংশটি হল:
“শূন্যস্থান পূরণ করতে করতে যতো বার উদয়-আসি কিংবা অস্ত যাই
দেখি
টেবিলের উপরে গোল কাচজোড়া
চশমাটি কে রেখে গিয়েছে? আমি সেই চশমাটি
মহাত্মা গান্ধির চোখে পরিয়ে দিয়েছি
লম্বা কলার পাতা আনত ঘোমটার আদল
আমি তার নিচে একখানি মুখ আঁকি মনে মনে
হেসে ওঠে সবুজ ঘোমটা পরা মা তোমার মুখ”
তার অস্তিত্বের কথা তখনই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যখন গান্ধিজির চশমার সঙ্গে মায়ের মুখের আদলটিও কবির মনে পড়েছে। কাচের গোল শূন্যতাই তো পৃথিবী, এখানেই নাথিংনেস সমস্ত প্রজ্ঞার বিপণন আদান-প্রদান করে চলেছে।
শুধু শূন্যস্থান পূরণ করার পরীক্ষা দিতে দিতেই কবিদের অবস্থান এভাবেই বিজ্ঞাপিত হয়ে চলেছে।
আরেকজন এই সময়ের উল্লেখযোগ্য কবি মুজিব মেহদী ‘একাগাছ’ নামে একটি কবিতায় লিখেছেন:
“শালজঙ্গলের কোনো জেরক্স হয় না
পোড়োবাড়ির কোনো সারাই হয় না
আমাকে আগলে রেখে উড়ে গেলে তুমি
পোড়োবাড়ির ধারণা পড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে
বাতাসে বাতাসে ভাঙনের সুর বেজে ওঠে
মাঠের ভিতর থাকা একাগাছ যত দেখি
শূন্যতার তত বেশি পড়ে যাই প্রেমে
গোড়ার জল কী দারুণ আগলে রাখে
থমথমে কালো ছায়া
একদিন সবকিছু ছেড়েছুড়ে
ধুধুপথে হাঁটা দেব শূন্য অভিলাষে
তুমি জেনে রেখো”
কবি এখানে প্রেমের কাছেই তাঁর অস্তিত্বের অন্বেষণ করেছেন। শালজঙ্গল অরণ্য সভ্যতার তাৎপর্য নিয়ে পৃথিবীতে নিজের উপস্থিতি ঘোষণা করেছে। তাই তার জেরক্স হবে না, অর্থাৎ বিকল্প হবে না। পোড়োবাড়ির সারাই করাও সম্ভব নয়, কেননা তা ধ্বংসমুখী। এখানে অস্তিত্বের আশ্রয় বোঝাতে চান কবি। কিন্তু সব অস্তিত্বই একা, অন্তহীন একা। আর এই একাকিত্বই শূন্যতা আহরণ করে। তাকে বাঁচিয়ে রাখলেও কালো ছায়ার বিপন্নতা ঘিরে থাকে। তখন ধুধুপথ, শূন্যতার অভিলাষ নিয়েই বিলীন হয়ে যেতে হয়। অস্তিত্বের কষ্টের কথা কবিতায় লিপিবদ্ধ হল তাই একান্ত অন্তর্গত আত্মার স্বর।
এই আত্মার স্বর কখনো spiritual voice কখনো self-anguish voice হয়ে কাব্যে ফিরে আসে। ‘তুমি’ সর্বনামটি কখনো নিজেকে, কখনো নিজের ঈশ্বরীকে, কখনো স্বয়ংক্রিয় সত্তাকেই তুলে ধরে। নিজের মধ্যে যে পৃথিবী আছে, এই পৃথিবীর একাকিত্বও আছে, ধ্বংসও আছে। দাহ ও দহনও আছে। এই এই আত্ম-অন্তর্গত বিপন্নতার বর্ণনা সব সময় কবিরা দিতে পারেন না। তখন একটা শূন্যতার স্পেস, একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ, একটা নীরবতার প্রলম্বিত ছায়া লগ্ন হয়ে থাকে। যাকে শুধু উপলব্ধি করা যায়, অথবা নাও যেতে পারে।
এ কথা ভেবেই আমেরিকান সাংবাদিক, ভাষ্যকার এবং দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের অপ-এড কলামিস্ট এবং MSNBC– এর বর্তমান রাজনৈতিক বিশ্লেষক চার্লস ম্যাকরে ব্লো (১৯৭০) বলেছেন:
অর্থাৎ
বিশ্ব বিধ্বস্ত হওয়ার শব্দকে কীভাবে বর্ণনা করব জানি না। হয়তো কোনো শব্দ নেই, শুধু একটা বড় শূন্যতা, একটা আচ্ছন্ন দুঃখ, একটা লতানো শূন্যতা যা একটা শক্ত তারের মতো আপনার চারপাশে কুণ্ডলী বিস্তার করে।
এই শূন্যতার মধ্যেই ঘুরপাক খেয়ে চলেছেন সাম্প্রতিক কালের কবিগণ। যে শূন্যতা লেখার ভাষা নেই, যে বোধের তীব্রতাকে শব্দে বন্দি করা যায় না, কবিতাতে তাকেই ইঙ্গিতে, না বলাতে, স্পেসে, বিচ্ছিন্নতায়, প্রসঙ্গহীনতায়, ক্লান্তি ও কুয়াশার বাতাবরণে কবিরা রেখে দিচ্ছেন। এখানেই পোস্টমডার্ন ভাবনার উদয় হচ্ছে। এসময়ের আরেক উল্লেখযোগ্য কবি প্রদীপ চক্রবর্তী ‘খেলার দৃশ্যাবলী’ নামক একটি কবিতায় লিখলেন:
“এবং জড়তা এক স্থির এই আসল কথাটা আর কিছুতেই বলা যায় না।
হয়তো বলা যেতো তিনকোনা ছাদের কোণে দাঁড়িয়ে।
অনুভবগুলো সমান
ব্যবধান রেখে বলা যেতো কিছু সময়ের অপেক্ষায় জল ভেঙে নোনা জলে
কিন্তু ধ্বনিত শূন্যতা মুখর হয়ে উঠলো মুখের আদিম রূপ পেরিয়ে
এই ভিতর জীবাশ্মের মধ্যে থেকে তোমার,
বলি নি …”
এই ধ্বনিত শূন্যতার মুখর হয়ে ওঠার মধ্যেই নির্বাপিত অনুভবগুলি আদিম রূপ পেরিয়ে ভিতর জীবাশ্মের যন্ত্রণা হয়ে রইল। তিনকোণা ছাদ ভৌগোলিক সীমানার অবয়বে জ্যামিতিক ধারণায় উঠে এলেও তা কার্যকরী হয়ে উঠল না অনুভবের কাছে। জল ভেঙে নোনা জলে সামুদ্রিক ধারণায় তার বিস্তার ঘটল। কিন্তু নীরবতায় সমস্ত প্রাচুর্যের উর্ধ্বে এক নিয়ন্ত্রিত অনুজ্ঞা হয়ে সবকিছু সামাল দিল। সময় ও সৃষ্টির মধ্যেকার এই রসায়নকেই অনুভব করেছিলেন Conscious Collective, LLC-এর প্রতিষ্ঠাতা, মানবতাকে অজ্ঞতা থেকে জাগ্রত করা এবং মানবীয় চেতনার বিবর্তনে অংশগ্রহণের জন্য নিবেদিত ব্যক্তি জোসেফ পি. কফম্যান। তিনি একটি প্রবন্ধে লিখেছেন:
অর্থাৎ
আপনি এই দেহে, এই মনের মধ্যে বা এই বাস্তবতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নন—আপনি অসীম সম্ভাবনায় আচ্ছন্ন চেতনার সীমাহীন সমুদ্র। আপনি নিজেই অস্তিত্ব।
এই অস্তিত্বের মধ্যেই যেমন পৃথিবী আছে, তেমনি ব্যক্তি আছে, ব্যক্তির সমাজ-সংস্কার-বিশ্বাস, মৃত্যু-জন্ম এবং বিবর্তনও আছে। সব নিয়েই অস্তিত্ব এক জাদুঘর। এই অস্তিত্বেরই রূপ দর্শন, উন্মোচন, বাজনা, আদিমতা, অস্বচ্ছতা, জটিলতা, সরলতা, নান্দনিকতা, অস্বাভাবিকতা কবিতায় নেমে আসে। তাই কবিতা বিন্দু থেকে মহাবিন্দুর দিকে ধাবিত হয়। বোধের সীমানাও অতিক্রম করে যেতে পারে।