বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের ছয়টি উপজেলায় বজ্রপাতে একদিনে নয় জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছে আরও তিনজন। বজ্রপাতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বেশ কয়েকটি অঞ্চলকে শনাক্ত করেছেন আবহাওয়াবিদরা।
রোববার বজ্রপাতে নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনজন সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার, দুজন দোয়ারাবাজার ও একজন তাহিরপুর উপজেলার বাসিন্দা। বাকি তিন জনের মধ্যে দুজন মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা। অপরজন নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার বাসিন্দা।
ওই ছয় উপজেলার পুলিশ হতাহতের এই খবর নিশ্চিত করেছেন। রোববার সকাল ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে ওইসব এলাকায় আকাশে মেঘ করে ঝোড়ো হাওয়া ও বৃষ্টির সঙ্গে আকস্মিক বজ্রপাত শুরু হয়।
পুলিশ জানিয়েছে, হাওরে এখন বোরো ধান কাটার মৌসুম চলছে। এ কারণে বৃষ্টির আগেই ফসল তুলতে ধান কাটা ও মাড়াই শুরু করেছেন কৃষকরা।
তারা মূলত নিজ নিজ হাওর এলাকায় ধান কাটার সময় কিংবা গরু চরাতে গিয়ে বজ্রপাতে ঘটনাস্থলেই মারা যান। আহতরা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। তাদের অবস্থা শঙ্কামুক্ত বলে জানিয়েছে পুলিশ।
রোববার সকালে আবহাওয়া অধিদফতরের পক্ষ থেকে নদী বন্দরগুলোয় দুই নম্বর সতর্ক সংকেত দেয়া ছিল। সাধারণত মেঘ অনেক উঁচুতে অবস্থান করলে এবং ঝোড়ো হাওয়া বয়ে গেলে এই সতর্ক সংকেত দেয়া হয়। এ সময় বজ্রপাতের ঝুঁকিও থাকে।
বজ্রপাতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ সময় ও ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল
বাংলাদেশে এপ্রিল থেকে জুনের প্রথমভাগকে বজ্রপাতের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সময় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন আবহাওয়াবিদ এ কে এম নাজমুল। এর কারণ, বছরের এই সময়ে বাংলাদেশের আবহাওয়া সবচেয়ে বেশি উত্তপ্ত থাকে। অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে অনেক জলীয় বাষ্প তৈরি হয়।
এ জলীয় বাষ্পই বজ্রপাতের প্রধান শক্তি হিসেবে কাজ করে। জলীয় বাষ্প যতো বেশি হবে ততো বেশি বজ্র মেঘের সৃষ্টি হয় এবং ঘন ঘন বজ্রপাত দেখা দেয়।
অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে এই প্রাকৃতিক ঘটনার ওপর গবেষণা চালিয়েছে। তারা বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ৮৪ লাখ বজ্রপাত হয় যার ৭০ শতাংশই হয় এপ্রিল থেকে জুন মাসে।
আবহাওয়াবিদদের পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশে উত্তর, উত্তর পূর্ব এবং উত্তর পশ্চিমাঞ্চল সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত-প্রবণ। বজ্রপাতে হতাহতের ঘটনা বেশি ঘটে হাওর অঞ্চলে। কেননা এসব অঞ্চলে জলীয় বাষ্প বেশি থাকে।
সে হিসেবে নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট এবং সেইসাথে টাঙ্গাইল, জামালপুর, ময়মনসিংহকে বজ্রপাতের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদ এ কে এম নাজমুল।
তবে কোন অঞ্চলকেই বজ্রপাতের ঝুঁকির বাইরে বলা যাবে না বলে তিনি জানিয়েছেন। গবেষকদের মতে, তাপমাত্রা এক ডিগ্রি বাড়লে বজ্রপাতের সম্ভাবনা ১০ থেকে ১২ শতাংশ বেড়ে যায়।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর বজ্রপাতে ১৫০ থেকে ২০০ মানুষ মারা যায় যাদের বেশিরভাগই কৃষক। সেইসঙ্গে অনেক গবাদি পশুও মারা যায়।
বার্ষিক প্রাণহানির এই সংখ্যার বিচারে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। মৃত্যুর সংখ্যা বিচার করে সরকার ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে।
ভৌগলিক অবস্থানে বাংলাদেশ ঝুঁকিতে
এছাড়া ভৌগলিক অবস্থানের কারণেও বাংলাদেশ বজ্রপাতের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে মত আবহাওয়াবিদদের। বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর থেকে উষ্ণ ও আর্দ্র বাতাস আসে এবং উত্তরের হিমালয় থেকে আসে ঠাণ্ডা বাতাস। এই দুই বাতাসের সংমিশ্রণে বজ্র মেঘ তৈরি হয় এবং এসব মেঘের সাথে মেঘের ঘর্ষণে বজ্রপাত হয়।
এ ব্যাপারে মি. নাজমুল বলেন, “একদিকে অনেক গরম আবহাওয়া, অন্যদিকে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি থাকলে ভূপৃষ্ঠের গরম বাতাস ওই জলীয় বাষ্পকে উপরে ঠেলে দেয়। তখন এটি ওপরের শীতল বাতাসের সঙ্গে মিলে সঞ্চালিত মেঘমালা তৈরি করে। এই মেঘের ভেতরে অনেক চার্জ থাকে। সেখানেই আলোর ঝলকানি দিয়ে বজ্রপাত হয়।”
তিনি জানান, কোন কোন বজ্রপাত মেঘের ভেতরে কিংবা বায়ুমণ্ডলে সীমাবদ্ধ থাকে। আবার কোন কোনটি এক মেঘ থেকে আরেক মেঘে বিচরণ করে।
কিন্তু এই বজ্রপাত বা উচ্চ ভোল্টের বৈদ্যুতিক তরঙ্গ মেঘ থেকে সরাসরি ভূপৃষ্ঠে আছড়ে পড়লেই এ ধরণের হতাহতের ঘটনা ঘটে। বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগের ক্ষেত্রে কিছু প্রস্তুতি নেবার সুযোগ থাকলেও বজ্রপাতের বিষয়টি অনেকটা ভূমিকম্পের মতোই আকস্মিক।
কিন্তু আবহাওয়াবিদরা, রেডার ইমেজে মেঘের অবস্থান অনেক ওপরের দিকে দেখলে সেইসাথে বায়ুমণ্ডলে অস্থিতিশীল অবস্থা থাকলে দুই নম্বর সতর্ক সংকেত দিয়ে থাকেন।
এমন অবস্থায় আকাশে কালো মেঘ ও বিদ্যুৎ চমকাতে দেখলেই সবাইকে সাথে সাথে খোলা জায়গা ছেড়ে দ্রুত নিরাপদে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। বজ্রঝড় সাধারণত ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ মিনিট স্থায়ী হয়। এ সময়টুকু ঘরে অবস্থান করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
২০২১ সালের অগাস্ট মাসে বাংলাদেশে একসাথে ১৭ জনের বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। উত্তরাঞ্চলে চাঁপাইনবাবগঞ্জে জেলার শিবগঞ্জ ইউনিয়নে এ ঘটনা ঘটে।
পদ্মা নদীর ঘাটে হঠাৎ বজ্রসহ বৃষ্টি শুরু হলে ওই ১৭ জন নদীর ঘাটে টিনের দোচালা ঘরে আশ্রয় নেন। সেখানেই বজ্রপাত হলে একসাথে তাদের মৃত্যু হয়।
অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয় তাদের গবেষণা বলেছে, ২০১৩ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে বজ্রপাতে মারা গেছে ১৮৭৮ জন এবং তাদের ৭২ শতাংশই কৃষক।
সূত্র: বিবিসি বাংলা