ইসরায়েল ও লেবাননের মধ্যে যেভাবে দশকের পর দশক সংঘাত চলছে
‘নাকবা’ আরবি শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘বিপর্যয়’। ফিলিস্তিনে ১৯৪৮ সালের ১৪ ই মে তারিখটিকে বলা হয় ‘নাকবা’ বা বিপর্যয়ের দিন। এই দিনে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।
ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মের পরপরই সেখান থেকে উচ্ছেদ হতে থাকে ফিলিস্তিনীরা। প্রায় সাড়ে সাত লাখ শরনার্থী আশ্রয় নিয়েছিল পূর্ব জেরুসালেম, পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা এবং আশপাশের দেশে।
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী সে সময় প্রায় লাখ ফিলিস্তিনী শরনার্থী লেবাননে আশ্রয় নিয়েছিল।
ইসরায়েল রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীনতা ঘোষণার পরদিনই দেশটিতে আক্রমণ করে মিশর, জর্ডান, ইরাক, সিরিয়া এবং লেবাননের বাহিনী।
সেই থেকে লেবাননের সাথে ইসরায়েলের শত্রুতার সম্পর্ক চিরস্থায়ী রূপ নিয়েছে। দশকের পর দশক ধরে লেবানন এবং ইসরায়েলের মধ্যে শত্রুতা বয়ে চলেছে।
ইসরায়েলের লেবানন আক্রমন
গত ৭৫ বছরে ইসরায়েল অন্তত তিনবার লেবানন আক্রমণ করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ধরণের হামলা হয়েছিল ১৯৮২ সালে।
তখন চল্লিশ হাজার ইসরায়েলি সৈন্য, শতশত ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান লেবাননের ভেতরে ঢুকে পড়ে। এছাড়া ইসরায়েলের নৌ এবং বিমান বাহিনীও এই আক্রমণে যোগ দেয়।
মূলত ফিলিস্তিনে আশ্রয় নেয়া শরনার্থী শিবির থেকে ইসরায়েলকে প্রতিহত করতে গড়ে ওঠা প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনসহ বেশ কিছু সশস্ত্র গেরিলা গোষ্ঠীর সঙ্গে ইসরায়েলি বাহিনীর আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণের জবাবে ইসরায়েল এই অভিযান চালায়।
তবে লেবাননে কিভাবে ফিলিস্তিনি গেরিলা গোষ্ঠী গড়ে উঠলো তা বুঝতে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে কিছুটা পেছনে।
১৯৬৭ সালে মিশর, সিরিয়া এবং জর্ডানের বিরুদ্ধে আগাম হামলা চালায় ইসরায়েল। মাত্র ছয়দিনের যুদ্ধে আরবরা পরাজিতহয়। ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম, সিরিয়ার গোলান মালভূমি এবং মিশরের সিনাই উপত্যকা দখল করে ইসরায়েল
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষক ড. সিন ফলে মিডল ইস্ট রিভিউ অফ ইন্টারন্যাশনাল এফেয়ার্স নামক জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধে দেখিয়েছেন কিভাবে এই ‘ছয় দিনের যুদ্ধ’ লেবাননে আশ্রয় নেয়া ফিলিস্তিনিদের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।
এই যুদ্ধের পরই ইসরায়েলিদের প্রতিহত করতে ফিলিস্তিনিরা সক্রিয় হবার সিদ্ধান্ত নেয় বলে মনে করেন এই বিশ্লেষক।
শরণার্থী শিবিরে ফিলিস্তিনি গেরিলা গোষ্ঠী
ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত বিশাল সংখ্যক শরণার্থীকে জায়গা দিতে গড়ে ওঠা শরণার্থী শিবির থেকেই দেশটিকে স্বাধীন করতে গড়ে ওঠে কিছু সশস্ত্র গেরিলা গোষ্ঠী। তারা লেবাননকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আক্রমণের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে।
এরমধ্যে সবচেয়ে পরিচিত ছিল প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও। লেবানন থেকে পিএলও বেশ কিছু গেরিলা হামলা ইসরায়েলে। এসব হামলার কারণে ১৯৮২ সালে ইসরায়েলের পূর্ণ শক্তি নিয়ে লেবাননে আক্রমণ করে।
ইসরায়েলের এই আক্রমণের উদ্দেশ্যেই ছিল বৈরুত কেন্দ্রিক প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনকে ধ্বংস করা।
বিশাল সৈন্যবাহিনী ও সাঁজোয়া যানে সজ্জিত ইসরায়েলিদের প্রতিহত করতে খুব বেশি সুবিধা করতে পারেনি ফিলিস্তিনি গেরিলা গোষ্ঠীগুলো।
লেবাননের রাজধানী বৈরুত পর্যন্ত দখলে নেয় ইসরায়েল। এসময় দেশটির ১৫ থেকে ২০ হাজার মানুষ মারা যায়, যাদের বেশিরভাগই ছিল বেসামরিক জনগণ।
১৯৪৮ এবং ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের কারণে যেসব ফিলিস্তিনিরা লেবাননে আশ্রয় নেয় তাদের সুরক্ষার শর্তে আক্রমণের প্রায় তিন মাস পর পিএলও লেবানন ত্যাগ করে তিউনিসিয়ায় চলে যায়।
বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের সুরক্ষিত রাখার শর্তে পিএলও লেবানন ছেড়ে যাবার দুই সপ্তাহ পর সাবরা ও শাতিলা নামের দুইটি শরণার্থী শিবির ঘেরাও করে গণহত্যা চালায় ডানপন্থী লেবানিজ মিলিশিয়া গোষ্ঠী ‘ফালাঞ্জ’। ইসরায়েলি সেনাদের উপস্থিতিতেই এঘটনা ঘটে।
এতে দুই থেকে সাড়ে তিন হাজার বেসামরিক মানুষ নিহত হয়। অনেক ফিলিস্তিনি লেবানন ছেড়ে চলে যায়।
লেবাননে গৃহযুদ্ধ চলাকালীন এই গণহত্যার সঙ্গে ইসরায়েলের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যারিয়েল শেরনের ‘ব্যক্তিগত দায়ের’ কথা জানানো হয় ঘটনার অনুসন্ধানে ইসরায়েল সরকারের গঠিত কাহান কমিশনের প্রতিবেদনে।
ইন্সটিটিউট ফর প্যালেস্টাইন স্টাডিজে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাশেদ খালিদী এবিষয়ে বিস্তারিত পর্যালোচনা করেন।
তিনি বলেন, “গণহত্যা চালানো লেবানিজ ফোর্স (এলএফ), ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণে থাকা ও সেখানে লেবানিজ ফোর্স ঢুকতে দেয়া ইসারায়েলি সেনাবাহিনী এবং ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকের সুরক্ষার শর্তে বৈরুত থেকে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনকে অঙ্গীকার করা মার্কিন সরকারের মধ্যকার যোগাযোগের সঠিক প্রকৃতিকে অনিশ্চিয়তা ঘিরে রেখেছে”।
লেবাননে ইসরায়েলের ‘নিরাপত্তা অঞ্চল’
ধর্মীয়ভাবে চরম বিভক্ত একটি দেশ লেবানন। ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর মধ্যকার তীব্র ব্যবধান এবং বৈষম্যমূলক কিছু ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৯৭৫ সালে লেবাননে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ইসরায়েল লেবাননের মধ্যকার এই বিভিক্তির সুযোগ নেবার চেষ্টা করে।
লেবাননে গৃহযুদ্ধ শুরু হবার পর ১৯৭৮ সালে লেবাননে প্রথম হামলা চালায় ইসরায়েল।
মিডল ইস্ট মনিটরে এক প্রবন্ধে মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতির গবেষক মুহাম্মাদ হুসেইন লিখেছেন,১৯৭৮ সালের ১৪ মার্চ রাতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ‘অপারেশন লিটানি’ নামে দক্ষিণ লেবাননে একটি বড় আক্রমণ শুরু করে।
দুই দিন আগে ইসরায়েলের উপকূলে এক হামলায় ৩৭জন ইসরায়েলি নিহত হওয়ার জের ধরে এই আক্রমণ চালানো হয়।
ইসরায়েলি হামলার উদ্দেশ্যই ছিল দক্ষিণ লেবানন থেকে সশস্ত্র গোষ্ঠী উৎখাত করে লেবাননের ভেতরে ছয় মাইল এলাকায় ‘নিরাপত্তা অঞ্চল’ তৈরি করা।
অভিযানের ফলে হাজারেরও বেশি লেবানিজ ও ফিলিস্তিনি বেসামরিক লোক মারা যায় এবং কয়েক লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়।
হেযবোল্লাহ’র উত্থান
লেবাননে গৃহযুদ্ধ চলার সময়ে দেশটিতে শিয়াদের সশস্ত্র গোষ্ঠি হেযবোল্লাহ’র উত্থান হয়। গৃহযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসে।
যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক স্বাধীন গবেষণা সংস্থা কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে ক্যালি রবিনসন লিখেছেন, ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব হবার পর দেশটির রেভ্যুলশনারি গার্ডের ছত্রছায়ায় গড়ে উঠে হেযবোল্লাহ।
হেযবোল্লাহ আসার পর লেবানন-ইসরায়েলের সমীকরণ অনেকটাই বদলে যায়। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে হেযবোল্লাহ।
তাদের ঘোষিত নীতিই ছিল ইহুদি রাষ্ট্র ধ্বংসের লক্ষ্যে দক্ষিণ লেবানন থেকে ইসরায়েলি বাহিনীকে তাড়ানো এবং জেরুজালেম মুক্ত করা।
লেবাননে গৃহযুদ্ধের অবসান এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আনার উদ্দেশ্যে ১৯৮৯ সালে তায়েফ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
এর ফলে কয়েক দশকের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে। এসময় সব গোষ্ঠী অস্ত্র ফেরত দিলেও হেযবোল্লাহ তা করেনি।
ব্যাপক বিতর্কের মধ্যেও হেযবোল্লাহ ১৯৯২ সালের নির্বাচনে অংশ নেয় এবং আটটি আসনে জয়লাভ করে। তাদের উত্থানে অনেকটাই চাপের মুখে পড়ে ইসরায়েল। ১৯৯৩ সালে ইসরায়েলি বাহিনী শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী হিযবুল্লাহকে টার্গেট করে পুনরায় দক্ষিণ লেবাননে আক্রমণ করে।
ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্সের তথ্য অনুযায়ী এই আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল হিযবুল্লাহসহ অন্যান্য গেরিলা গোষ্ঠীর ওপর হামলা এবং দক্ষিণ লেবাননকে ‘সন্ত্রাসীদের’ হাত থেকে মুক্ত করা। সাতদিনের এই যুদ্ধে ৫০ জন নিহত এবং ৪০ জন আহত হয়।
হেযবোল্লাহ – ইসরায়েল আরো সংঘাত
হেযবোল্লাহ’র ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে ২০০০ সালে দখলকৃত উত্তর লেবানন থেকে পুরোপুরি সরে যেতে বাধ্য হয় ইসরায়েল।
একইসঙ্গে প্রথমবারের মতো দেশটি থেকে ইসরায়েলিদের হঠাতে সক্ষম হওয়ায় লেবাননের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফোর্স হয়ে ওঠে হেযবোল্লাহ।
২০০৬ সালে ‘পয়েন্ট ১০৫’ নামের এই সীমান্ত থেকে দুই ইসরায়েলি সেনাকে বন্দি করে হেযবোল্লাহ। ফলে হেযবোল্লাহকে উৎখাতের উদ্দেশ্যে পুনরায় লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে অভিযান চালায় ইসরায়েল।
আকাশ ও সমুদ্রপথের এই আক্রমণে বেসামরিক জনগণ হতাহতের পাশাপাশি ব্যাপক বেসামরিক অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার আগেই বাস্তুচ্যুত হয় হাজার হাজার মানুষ। তবে আগেরবারের মতো এবার আর সুবিধা করতে পারেনি ইসরায়েল। হেযবোল্লাহ’র বিপুল প্রতিরোধের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয় তারা।
ইসরায়েলি সরকারের গঠিত উইনোগ্রাড কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদনে ২০০৬ সালের যুদ্ধকে ‘ব্যর্থ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
চলমান সংঘাতের অংশ হিসেবে বিভিন্ন সময়ে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করলেও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ২০২২ সালে এক ঐতিহাসিক সমুদ্রসীমা চুক্তিতে সই করে ইসরায়েল এবং লেবানন।
এর ফলে দু’দেশের জন্যই সমুদ্রের তলদেশের বিরোধপূর্ণ গ্যাস ক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস আহরণের সুযোগ তৈরি হয়।
সূত্র বিবিসি বাংলা