ইউক্রেনের সাথে শস্য চুক্তি থেকে রাশিয়া বেরিয়ে গেলে কী হবে?
রাশিয়া বলছে ১৮ মে-এর পরে কৃষ্ণসাগরীয় খাদ্যশস্য পরিবহনের চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর ‘খুব একটা সম্ভাবনা’ নেই। এই চুক্তির আওতায় রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধকালীন নিরাপদে ইউক্রেনীয় শস্য রফতানির সুযোগ তৈরি হয়েছে। জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় নিরাপদ করিডোর দিয়ে ইউক্রেনীয় খাদ্যশস্য বিভিন্ন দেশে রফতানি করা হচ্ছে।
জাতিসংঘ কর্মকর্তারা বলছে, এই চুক্তি বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট মোকাবিলায় সহযোগিতা করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের বৃহত্তম ও ভয়াবহ যুদ্ধের কারণে বিশ্বের খাদ্য সংকট আরও তীব্র রয়েছে।
গত বছর জুলাই মাসে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তির ফলে ইউক্রেনের তিনটি বন্দর থেকে খাদ্যশস্য ও তৈলবীজের রফতানি শুরুর জন্য একটি নিরাপদ সমুদ্র করিডোর তৈরি হয়েছে।
চুক্তি ঘিরে বেশ কিছু বিষয় রয়েছে। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এমন কয়েকটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছে:
কী কী পণ্য রফতানি করা হয়েছে?
একটি নিরাপদ নৌযান চ্যানেল তৈরির চুক্তির অধীনে ইউক্রেন প্রায় ২৭.৭ মিলিয়ন টন কৃষিপণ্য রফতানি করতে সক্ষম হয়েছে। এর মধ্যে ১৩.৯ মিলিয়ন ভুট্টা ও ৭.৫ মিলিয়ন টন গম রয়েছে। এটি ২০২২ ও ২৩ মৌসুমে ইউক্রেনের ভুট্টা রফতানির প্রায় ৬০ শতাংশ ও গম রফতানির ৫৬ শতাংশ।
ইউক্রেনের অপর রফতানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে রেপসিড, সূর্যমুখী তেল, সূর্যমুখী খাবার ও বার্লি। এসব পণ্যের বেশিরভাগ পৌঁছেছে চীন (৬.৩ মিলিয়ন টন), স্পেন (৪.৮ মিলিয়ন টন) এবং তুরস্ক (৩ মিলিয়ন টন)।
রাশিয়া কেন চুক্তির মেয়াদ বাড়াতে আগ্রহী নয়?
রাশিয়া বলে আসছে, পশ্চিমারা যদি রাশিয়ার কৃষি ব্যাংক-এর সুইফট পেমেন্ট সিস্টেমের সঙ্গে পুনঃসংযোগসহ রুশ শস্য ও সার রফতানির বাধা দূর না করে তাহলে কৃষ্ণ সাগরীয় খাদ্যশস্য রফতানি চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হবে না।
রাশিয়ার অপর দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে, কৃষি যন্ত্রপাতি এবং যন্ত্রাংশের সরবরাহ পুনরায় শুরু করা, বিমা এবং পুনর্বিমাকরণের ওপর বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া, টগলিয়াত্তি-ওডেসা অ্যামোনিয়া পাইপলাইন পুনরায় চালু করা এবং সম্পদের অবরোধ এবং খাদ্য ও সার রফতানির সঙ্গে জড়িত রুশ সংস্থাগুলোর অ্যাকাউন্টগুলো সচল করা। পশ্চিমাদের পক্ষে রাশিয়ার এসব দাবিতে রাজি হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।
রাশিয়াকে বাদ দিয়ে করিডোর পরিচালনা কী সম্ভব?
গত বছরের জুলাই মাসে চুক্তি হওয়ার আগে ইউক্রেনের বন্দরগুলো অবরুদ্ধ করে রেখেছিল রুশ সেনাবাহিনী। ফলে চুক্তি থেকে রাশিয়া বের হয়ে গেলে শস্য রফতানি সম্ভব হবে কিনা তা স্পষ্ট নয়।
বিমান হার উচ্চ থাকায় জাহাজের মালিকেরা চুক্তিতে রাশিয়া না থাকলে পণ্য পরিবহন করতে রাজি নাও হতে পারে। কারণ রাশিয়া সমুদ্রের ওই অঞ্চলে জাহাজ প্রবেশের অনুমতি না দিলে তাদেরকে বিপদে পড়তে হবে। সম্ভাব্য ঝুঁকির মধ্যে বিমাকারীদের বিবেচনা করতে কৃষ্ণ সাগরে এবং সমুদ্রের খনিগুলোর রুশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজের উপস্থিতি।
ইউক্রেনে ফসল উৎপাদন কম হলে কি করিডোর প্রয়োজন?
২০২৩-২৪ অর্থবছরে ইউক্রেনের শস্য রফতানি কমে যাওয়ার পূর্বাভাস রয়েছে। কারণ যুদ্ধের পর আগের তুলনায় ফসল উৎপাদন কম করছেন ইউক্রেনীয় কৃষকরা। ক্রমশ পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার কারণে উৎপাদন হ্রাসের পরিমাণ ধারণার চেয়ে কম হতে পারে।
ইন্টারন্যাশনাল গ্রেনস কাউন্সিল পূর্বাভাস দিয়েছে, ইউক্রেনের ভুট্টা উৎপাদন আগের মৌসুমের ২৭ মিলিয়ন টন থেকে কমে ২১ মিলিয়ন টন হবে, রফতানি ২০.৫ মিলিয়ন থেকে ১৫ মিলিয়ন টনে নেমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ইউক্রেনের গম উৎপাদন ২৫.২ মিলিয়ন থেকে ২০.২ মিলিয়ন টনে নেমে যাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে এবং রফতানি পূর্ববর্তী মৌসুমে ১৪.৫ মিলিয়নের তুলনায় ১১ মিলিয়ন টন হবে।
পূর্ব ইউরোপীয় ইউনিয়ন হয়ে এই পরিমাণ শস্য রফতানি করা যৌক্তিকভাবে কঠিন এবং ব্যয়বহুল হবে। বিশেষ করে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে উৎপাদিত ফসলের জন্য। এসব কেবল সীমান্তে পৌঁছানোর জন্য দীর্ঘ এবং কঠিন যাত্রার মুখোমুখি হয়।
ইউক্রেন কি স্থল রুটের মাধ্যমে আরও শস্য রফতানি করতে পারে?
সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে ইউক্রেন পূর্ব ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর মাধ্যমে যথেষ্ট পরিমাণে শস্য রফতানি করে আসছে। বিশেষ করে হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড এবং রোমানিয়া। তবে বিভিন্ন রেলগেজসহ অনেক লজিস্টিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
ইউক্রেনের রেলওয়ে নেটওয়ার্ক ১ হাজার ৫২০ মিমি গেজে সোভিয়েত-পরবর্তী অন্যান্য দেশের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। পূর্ব ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো ১ হাজার ৪৩৫ মিমি গেজ ব্যবহার করে। যার ফলে এক নেটওয়ার্ক থেকে অন্য নেটওয়ার্কে কোনও বাধা ছাড়াই ট্রেন চালানো অসম্ভব।
আরেকটি সমস্যা হলো, পূর্ব ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে ইউক্রেনের শস্যের প্রবাহ ইতোমধ্যে এই অঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। তারা বলছে, এর ফলে স্থানীয় সরবরাহ কমে গেছে। স্থানীয় মিলগুলো ইউক্রেনের ফসল কিনছে। এতে করে তারা ফসলের বাজার হারাচ্ছে।
পোল্যান্ড দামের ওপর প্রভাব কমাতে গত সপ্তাহে ইউক্রেনীয় শস্য আমদানি সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করেছে। যদিও পোল্যান্ড বলছে, ইউক্রেনীয় ফসলের জন্য ট্রানজিটের অনুমতি দেওয়া হতে পারে। রোমানিয়ার কৃষকরাও ট্রাক্টর এবং ট্রাক দিয়ে সড়ক এবং সীমান্ত ক্রসিং অবরোধ করেছে।
ইউক্রেনীয় পণ্যের কারণে অপর দেশের ফসল বিক্রিতে মুনাফা কমার দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন ইউক্রেনীয় কৃষকরা। তবে অপর দেশ দিয়ে ইউক্রেনকে আরও বেশি শস্য রফতানি করতে হয় তাহলে এমন দাবি আরও জোরালো হতে পারে।
করিডোর কি খাদ্য সংকট দূর করেছে?
বিশ্বের অন্যতম প্রধান রফতনিকারক ইউক্রেনের কাছ থেকে কম সরবরাহ বিশ্বব্যাপী খাদ্য মূল্য সংকটে ভূমিকা পালন করেছে। খাদ্য সংকটের অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে জলবায়ুর তীব্রতা এবং মহামারির পরবর্তী পরিস্থিতি।
যদি করিডোরটি বন্ধ করা হয়, তবে এর ফলে শস্যের বৈশ্বিক দামে অনেক বেড়ে যেতে পারে। ইতোমধ্যে অনেক দেশ খাদ্য ও জ্বালানি আমদানিতে অনেক বেশি ব্যয়ের কাল হিমশিম খাচ্ছে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বলেছে, এই মাসে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা নজিরবিহীন পর্যায়ে রয়েছে।