সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক
মধ্যপ্রাচ্যের দুই বৈরি দেশ ইরান আর সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ২০১৬ সালের পর বৃহস্পতিবার প্রথমবারের মত সরকারি পর্যায়ে বৈঠক করেছেন।
একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, বেইজিংয়ে ইরানী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির-আবদোল্লাহিয়ান এবং সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান আল সউদকে করমর্দন করতে উৎসাহ দিচ্ছেন চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রী।
এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তারা আগামী দুই মাসের মধ্যে তাদের দূতাবাস পুনরায় চালু করা এবং বিমান চলাচল আবার শুরু করার বিষয়ে আলোচনা করেছেন।
গত মাসে চীনের দৌত্যে দুই দেশ তাদের মধ্যে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে রাজি হয়।
তাদের মধ্যে এই বৈঠককে দেখা হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের একটা ইঙ্গিত হিসাবে এবং মনে করা হচ্ছে এটা ওই এলাকায় আমেরিকার কর্তৃত্বের প্রতি একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
সৌদি আরব আর ইরানের সঙ্গে চীনের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক যোগাযোগ বেশ ঘনিষ্ঠ। অন্যদিকে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মার্কিন সৌদি সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। আর ইরানের সাথে গত চার দশক ধরে আমেরিকার কোন কূটনৈতিক সম্পর্কই নেই।
সৌদি রাষ্ট্রীয় টিভিতে দেখানো হয়েছে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রী বেইজিংএ ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী এবং সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে হাত মেলাতে উৎসাহিত করছেন
সৌদি রাষ্ট্রীয় টিভিতে দেখানো হয়েছে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেইজিংএ ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সৌদিপররাষ্ট্র মন্ত্রীকে হাত মেলাতে উৎসাহিত করছেন
মি. আমির-আবদোল্লাহিয়ান এবং প্রিন্স ফয়সাল তাদের মধ্যে হওয়া চুক্তিটি বাস্তবায়নের গুরুত্বের জোর দিয়েছেন এবং বলেছেন, তারা সম্পর্ক এমনভাবে পুনরুদ্ধারে আগ্রহী যাতে “তাদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা এবং সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো বিস্তৃত হয় এবং নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির পথ প্রশস্ত হয়।”
তারা আরও বলেছেন, দ্বিপাক্ষিক সফর আবার চালু করার বিষয়টি নিয়েও কথা বলেছেন। একজন ইরানী কর্মকর্তা এ মাসের আরও আগের দিকে বলেন যে, প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি সৌদি আরব সফরের জন্য বাদশা সালমান বিন আবদুলআজিজ আল সউদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন।
সাত বছর আগে তেহরানে জনতা সৌদি দূতাবাসের ওপর আকস্মিক হামলা চালানোর পর সৌদি আরব ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেছিল। সৌদি আরব একজন বিশিষ্ট শিয়া ধর্মীয় নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর জনতা তেহরানে সৌদি দূতাবাসের ওপর হামলা চালায়।
এরপর থেকে দুই দেশের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছিল।
বিবিসির নিরাপত্তা বিষয়ক সংবাদদাতা ফ্র্যাঙ্ক গার্ডনার বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যের এই দুই তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ ঘটনাবলীর মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে এবং একইসঙ্গে “এটা চীনের জন্য একটা কূটনৈতিক বিজয়”।
সৌদি যুবরাজ প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান যখন সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন, তখন তিনি কয়েকটি আরব রাষ্ট্রের সঙ্গে গোপনে জোট গঠন করে ইয়েমেনে ইরান-সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীদের গুঁড়িয়ে দেবার লক্ষ্যে বিশাল এক আক্রমণ চালান। আট বছর পর সেই যুদ্ধের বাস্তব প্রভাব রিয়াদে সৌদি কর্তৃপক্ষ অনুধাবন করতে শুরু করেছে বলে বলছেন মি. গার্ডনার।
তার মতে, সৌদি নেতৃত্ব দুটি অপ্রিয় সত্য না চাইলেও মানতে বাধ্য হয়েছেন।
প্রথমটি হল ইরান এখন সামরিক দিক দিয়ে শক্তিধর একটি রাষ্ট্র এবং তাদের হাতে রয়েছে বিশাল ক্ষেপণাস্ত্রের সম্ভার। এছাড়াও গোটা এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে প্রয়োজনে লড়াই করার জন্য তাদের সমর্থিত মিলিশিয়া বাহিনী। সৌদি আরব এবং তার মিত্র দেশগুলো এই মিলিশিয়া বাহিনীগুলোকে কখনও পরাজিত করতে পারবে এমন সম্ভাবনা নেই।
দ্বিতীয়ত, রিয়াদ এখন আর ওয়াশিংটনের ওপর ভরসা রাখতে পারছে না, যদিও দুই দেশের মধ্যে একটা নূন্যতম কৌশলগত জোট এখনও বিদ্যমান।
সৌদিরা পছন্দ করতেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট হবার পর মি. ট্রাম্প তার প্রথম বিদেশ সফরে গিয়েছিলেন রিয়াদে। কিন্তু ট্রাম্পের আগে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে তারা বিশ্বাস করেনি, বিশেষ করে তিনি ইরানের সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহ দেখানো এবং তার পররাষ্ট্র নীতিতে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকাকে বেশি গুরুত্ব দেবার ঘোষণা দেওয়ার পরে।
বর্তমানে জো বাইডেনের নেতৃত্বাধীন হোয়াইট হাউসের সঙ্গেও সৌদিদের সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। এর কারণ সৌদিরা তেল উৎপাদন কমিয়েছে এবং এ কারণে আমেরিকায় তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি সৌদিদের নজরে আনার পরেও সৌদি আরব তেলের উৎপাদন বাড়াতে কোনরকম উদ্যোগ নেয়নি।
ফ্র্যাঙ্ক গার্ডনার বলছেন, ফলে সৌদি-ইরান চুক্তি এখন রিয়াদের জন্য নতুন কূটনীতির পথ খুলে দেবে বলে সৌদি আরব মনে করছে। এমনকী যেসব দেশকে আমেরিকা তাদের জন্য কৌশলগত কারণে ঝুঁকি বলে মনে করে তাদের সাথে নতুন জোট গঠনেও তারা উৎসাহী হয়ে উঠছে।
সৌদি ইরান সংঘাত যেসব কারণে
সৌদি আরব নিজেকে মনে করে সুন্নি মুসলিম দুনিয়ার নেতৃত্বদানকারী শক্তি। আর ইরান হল শিয়া মুসলিমদের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্র। গত কয়েক দশক ধরে আঞ্চলিকভাবে প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ে দুটি দেশ পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে।
কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই দুই দেশ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধে মদত জোগানোর কারণে তাদের মধ্যে বৈরিতা আরও প্রকট হয়েছে।
সৌদি আরব ২০১৫ সাল থেকে হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইয়েমেনের সরকারি বাহিনীকে সমর্থন জুগিয়ে আসছে। ওদিকে হুথিরা সৌদি শহর এবং সৌদি তেল স্থাপনাগুলোর ওপর যেসব ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে তার জন্য ইরান হুথিদের গোপনে অস্ত্র সরবরাহ করেছে এমন অভিযোগ ইরান অস্বীকার করে এসেছে।
সৌদি আরব ইরানের বিরুদ্ধে লেবানন আর ইরাকে নাক গলানোরও অভিযোগ করেছে। সেখানে ইরান সমর্থিত শিয়া মিলিশিয়ারা বিপুলভাবে সামরিক ও রাজনৈতিক প্রভাব গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে; উপসাগরে মালবাহী এবং তেলবাহী জাহাজগুলোর ওপর তারা হামলা করেছে এবং ২০১৯ সালে বড় সৌদি তেল স্থাপনাগুলোর ওপর মিসাইল ও ড্রোন হামলার পেছনে এই মিলিশিয়াদের হাত আছে বলে সৌদিদের অভিযোগ।
তবে, জাহাজ ও তেল স্থাপনার ওপর হামলা চালানোর অভিযোগ ইরান অস্বীকার করেছে।
এছাড়াও ২০১৫ সালে ইরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে আপত্তি তুলেছিল সৌদি আরব এবং পাঁচ বছর আগে যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই চুক্তি খারিজ করে ইরানের ওপর আবার অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেন, তখন তাতে সমর্থন দিয়েছিল সৌদিরা।
সূত্র বিবিসি