তীব্র বিরোধিতা মুখে বিচার বিভাগ সংস্কারের উদ্যোগ পিছিয়ে দিলেন নেতানিয়াহু
ইসরায়েলে বিচারবিভাগে সংস্কারের এক বিতর্কিত পরিকল্পনা তীব্র বিরোধিতা ও বিক্ষোভের মুখে পড়ার পর প্রধানমন্ত্রী বিনিয়ামিন নেতানিয়াহু এখন তা থেকে পিছিয়ে এসেছেন।
মি. নেতানিয়াহু জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া এক ভাষণে বলেন, সংস্কারের উদ্যোগটি পার্লামেন্টের আগামী অধিবেশন পর্যন্ত পিছিয়ে দেয়া হবে – যাতে এ ব্যাপারে ব্যাপকভিত্তিক ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়। তিনি আরো বলেন, তার সরকার দেশে গৃহযুদ্ধ চায় না।
এর আগে সরকারের একজন উগ্র-ডানপন্থী সদস্য এবং জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গভির বলেন, প্রধানমন্ত্রী এই পরিবর্তনের উদ্যোগের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ পিছিয়ে দিতে রাজি হয়েছেন। এ উদ্যোগের বিরুদ্ধে দেশটিতে প্রায় সর্বস্তরের হাজার হাজার মানুষ দীর্ঘদিন ধরে বিক্ষোভ করছেন।
সোমবার সারা দেশ জুড়ে ডাকা ধর্মঘটের কারণে বিমান ও সমুদ্র বন্দর অচল হয়ে পড়ে, ব্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয় ও দোকানপাটও বন্ধ হয়ে যায়। ডাক্তার ও স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারাও ধর্মঘটে যোগ দেন।
এর আগে সংস্কারের উদ্যোগ বন্ধ করার ডাক দিয়ে বরখাস্ত হন সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী, দেশটির শক্তিশালী সামরিক বাহিনীও এর বিরোধিতা করছে, এমনকি ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন এই পরিকল্পনা পরিত্যাগ করার জন্য।
বিরোধিতাকারীরা বলছেন, বিচার বিভাগে যেসব পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে – তা ইসরায়েলের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেবে।ইসরায়েল রাষ্ট্রের ইতিহাসে এমন বিক্ষোভ নজিরবিহীন।
মন্ত্রীদের পদত্যাগের হুমকি
এর আগের রিপোর্টে বলা হয়, তীব্র বিক্ষোভের মুখে মি. নেতানিয়াহু শিগগীরই এ পরিকল্পনা “কয়েক সপ্তাহের জন্য” স্থগিত করার করার কথা ঘোষণা করতে যাচ্ছেন । তবে এরকম কিছু করতে গেলে বিচারমন্ত্রী ইয়ারিভ লেভিন এবং জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভির পদত্যাগ করবেন বলে হুমকি দিয়েছেন – এমন কথাও খবরে বলা হয়।
বিবিসির ডেভিড গ্রিটেন জানান, সোমবার দুপুরের দিকে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে সরকারি কোয়ালিশন ভেঙে পড়ার ঝুঁকির মুখে মি. নেতানিয়াহু তার পিছিয়ে আসার ঘোষণা বিলম্বিত করতে যাচ্ছেন।
মি. বেন-গভির এর আগে “অরাজকতার কাছে নতি স্বীকার না করে” প্রস্তাবিত আইন সংস্কারের উদ্যোগ অব্যাহত রাখতে মি. নেতানিয়াহুর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।
“এটা এখন মি. নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক জীবন রক্ষার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে,” – বিবিসিকে বলেছেন একজন ইসরায়েলি বিশ্লেষক অধ্যাপক ইউভাল শানি – “তার সামনে এই সংস্কার পরিকল্পনা স্থগিত করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।”
‘দায়িত্বশীল’ হবার ডাক
সোমবার সকালের দিকে, এক টুইটারে এক বার্তা পোস্ট করে মি, নেতানিয়াহু সকল পক্ষের প্রতিবাদকারীদের “দায়িত্বশীল আচরণ করা এবং সহিংসতা থেকে বিরত থাকার” ডাক দেন।
এমন এক সময় তার এই আহ্বানের কথা জানা যায় – যখন ইসরায়েলি দৈনিক হারেৎজ উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে রিপোর্ট করে যে খুব শিগগীরই উত্তেজনা আরো বৃদ্ধি পাবার আশংকা আছে।
নেতানিয়াহুর বিতর্কিত পরিকল্পনায় কী আছে?
এই সংস্কার পরিকল্পনার মধ্যে সরকারকে বিচারক নিয়োগকারী কমিটির উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দেয়ার কথা বলা হয়েছে।
এছাড়া আইনপ্রণেতাদের কেউ দায়িত্ব পালনের জন্য অযোগ্য হলে, তাকে অপসারণ করাটা আদালতের জন্য আগের চাইতে কঠিন করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ হয়েছে।
তারা মনে করে এ বিধানটি ক্ষমতাসীন নেতা মি. নেতানিয়াহুর স্বার্থ বিবেচনা করে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। মি. নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে এই মূহুর্তে দুর্নীতির একটি মামলা চলমান রয়েছে। মি. নেতানিয়াহু বলেছেন, সংস্কারের প্রস্তাব এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে তা আদালতের ক্ষমতার অতিরিক্ত ব্যবহার বন্ধ করতে পারে।
এতে ইসরায়েলের হাইকোর্টের ক্ষমতা কমানো হবে এবং পার্লামেন্টের সদস্যরা এমন সব আইন পাস করতে পারবেন – যা আদালত এর আগে খারিজ করে দিয়েছে বা কার্যত অসাংবিধানিক বলে মত দিয়েছে।
বিচারমন্ত্রী ইয়ারিভ লেভিন বলেন, নতুন পরিকল্পনায় ইসরায়েলের ১২০ আসনের পার্লামেন্ট বা কেনেসেটের ক্ষমতা এমনভাবে বাড়বে যে তারা সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্থাৎ ৬১ জন এমপির সমর্থন পেলেই – সুপ্রিম কোর্টের যে কোন সিদ্ধান্ত উল্টে দিতে পারবেন।
পরিকল্পনায় আরো বলা হয়, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগে রাজনীতিবিদদের ভূমিকা আরো গুরুত্বপূর্ণ করা হবে। মন্ত্রীরা তাদের নিজস্ব আইন উপদেষ্টা নিয়োগ করতে পারবেন ।
নেতানিয়াহুর পেছনে উগ্র ডানপন্থী দল
বিনিয়ামিন নেতানিয়াহু এর আগে ২০২১ সাল পর্যন্ত টানা ১২ বছর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তবে এবার তিনি যে সরকার গড়েছেন – তাকে বলা হচ্ছে ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে উগ্র ডানপন্থী সরকার। তার কোয়ালিশনে অংশীদার দলগুলোর মধ্যে আছে অতি উগ্র ডানপন্থী, কট্টর জাতীয়তাবাদী এবং অত্যন্ত গোঁড়া ইহুদি রাজনৈতিক দলগুলো।
ক্ষমতায় এসেই এ সরকার ঘোষণা করে যে অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি নির্মাণ সম্প্রসারণ হচ্ছে তাদের এক নম্বর অগ্রাধিকার।
ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনি পরিবার ভিটেমাটি ছাড়া হয়েছিলেন, আর ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল জর্ডান নদীর পশ্চিম তীর, গাজা এবং পূর্ব জেরুসালেম দখল করে নেয়।
আন্তর্জাতিক আইনে এখানে ইহুদি বসতি নির্মাণ অবৈধ হলেও ইসরায়েল এ পর্যন্ত ৫০০,০০০ ইহুদির জন্য বসতি নির্মাণ করেছে।
শুধু তাই নয়, আল-জাজিরার এক রিপোর্টে বলা হচ্ছে যে মি. নেতানিয়াহু কোয়ালিশন গঠনের জন্য একটি কট্টরপন্থী দলকে এমন অঙ্গীকারও করেছেন যে তিনি অধিকৃত পশ্চিম তীরকে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলের অংশে পরিণত করবেন। অধিকৃত পশ্চিম তীরে বাস করেন প্রায় আড়াই লক্ষ ফিলিস্তিনি।