এম্পটিনেস্ থেকে নাথিংনেস্ আয়ু রচনার অনন্তপ্রজ্ঞা

তৈমুর খান
তৈমুর খান
13 মিনিটে পড়ুন
শরীরে, নীরক্ত, অভিনিবেশ, ইচ্ছা বসন্ত এবং ক্ষয়ী

সরল! সরল! ও সরল!

হ্যাঁ, আমি সরলকে ডাকছি। এই নির্জনে এসে বসেছি। চারিপাশে খড় জমা করা আছে। মাঝখানে ফাঁকা জায়গায় রোদ পড়েছে। খড়ের ওপর শরীর এলিয়ে দিয়েছি। হ্যাঁ মাঘ মাস। আর আজ মাঘের প্রথম দিন। আমার জন্ম হয়েছিল এই দিন সকাল এগারোটা নাগাদ। ধাই-মা নাড়ি কেটে আমাকে এই খড়ের ওপরেই শুইয়ে দিয়েছিল। আর সূর্যের রোদ এসে চুমু খাচ্ছিল। আমি কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

আমি একটু বড় হয়ে নিজেই নিজের নাম দিয়েছি ‘সরল’। কেউ জানে না এই নাম। নিজেকেই একদিন নিজেই জিজ্ঞেস করেছিলাম: কেন এমন নাম দিয়েছ? আরও তো বহু নাম ছিল!

উত্তর দিয়েছিলাম: আমি বরাবরই সরল। বৃষ্টিতে ভিজি তবু কারও ছাতার তলায় দাঁড়াই না। সবাই শর্টকাট রাস্তা খুঁজে দ্রুত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে। আমি কিন্তু সোজা রাস্তায় অনেক দেরি করে ফিরি। সবাই ট্যাড়া আঙুলে ঘি বের করে। আমি কিন্তু সোজা আঙুলেই চেষ্টা করি। ঘি না বের হলেও ঘি এর তোয়াক্কা করি না। সবাই ‘তৈমুর’ নামে আমাকে ডাকে, কিন্তু আমি সরল নামে ডাকি। আমার পদবী নেই। আমার সংসারও আলাদা। আমার উপলব্ধি, আমার প্রভু, আমার দুঃখ, আমার সুখ, আমার দেখার মধ্যেও একটি ভিন্নতা আছে—যা তৈমুরের নেই।

- বিজ্ঞাপন -

তাহলে তৈমুরের কী আছে?

তৈমুরের আছে একটি সামাজিক পরিচয়। একটি ধর্মীয় পরিচয়। দৈনন্দিন জীবন কাটানো যন্ত্রণার নানা প্রকাশ। নানা অভ্যাস। নানা কর্তব্য। সামাজিকতা থেকে ধর্মাবদ্ধতা এবং জৈব প্রবৃত্তির অনুজ্ঞা। এই তৈমুর ঘৃণার শিকার হয়। প্রতারণার শিকার হয়। শারীরিক নিগ্রহের শিকার হয়। তৈমুরের বার্ধক্যও নেমে আসতে থাকে। তৈমুর ঘুমায় আবার ঘুমহীন রাতও কাটায়। কখনও হাসপাতাল, কখনও ডাক্তারখানা যায়। আবার চিরুনিখানি হাতে নিয়ে কখনও আয়নার সামনে দাঁড়ায়। তৈমুর নিজেকেই দেখতে থাকে আর বলতে থাকে : কেমন জব্দ হচ্ছিস!

আকাটা দাড়ি, ঘর্মাক্ত মুখ, বিষণ্ন মুখের ভাষা নিয়ে নিজেকে দেখতে দেখতেই কেঁদে ফেলে তৈমুর।

—কিন্তু সরল?

সরল ওই যে খড়ের গাদার মাঝখানে একফালি সূর্যের রোদে নিজেকে মেলে দেয়। আজ তার জন্মদিন। না, কোনও জটিলের কাছে যাবে না। পার্থিব আসক্তির বিরামবিহীন হাতছানি ওকে ক্লান্ত করে দেয়। ওর কাছে শুধু নাথিংনেস্-ই সত্য। সরল ভাবে, ওর যখন জন্ম হয়নি তখন ও কোথায় ছিল? আবার ওর যখন মৃত্যু হবে তখন ও কোথায় যাবে? জন্ম এবং মৃত্যুর মাঝখানের পথটিই ওর কাছে এম্পটিনেস্। এই এম্পটিনেস্ খড়ের গাদার মাঝখানটা।

- বিজ্ঞাপন -

যদিও সূর্যের আলো আছে এখানে। মাথার ওপর একটুকরো আকাশ আছে। দূর থেকে কলকাকলিও শোনা যায়। তবু সরল দেখেছে : ওর হাতের মুঠোয় কিছুই ধরা যায় না। ডান হাতের মুঠো বারবার খুলে মেলে ধরেছে চোখের সামনে। কিছুই নেই। কতকগুলি হিজিবিজি দাগ। পাঁচটা আঙুল অসহায় হয়ে তাকিয়ে আছে। কাকে যেন ছুঁয়েছিল এই হাত! কী সুন্দর নরম সেই ছোঁয়া! কাকে যেন ডেকেছিল এই হাত! কী আকুতি আর আন্তরিক ছিল সেই ডাক! কিন্তু হাতও আজ তা অস্বীকার করে। কিছুই বোঝা যায় না। জন্ম নাথিংনেস্, মৃত্যুও নাথিংনেস্। মাঝখানের এই এম্পটিনেস্-এ অবস্থান করতে করতেই সরল কবিতা রচনা করে:

“নির্বাকের পরামর্শে কথা কই
হাঁটতে গিয়ে দেখি পা নেই
এত বৃষ্টি-বন্যায় মোক্ষম নদী-নালা
নির্ভেজা বসন খুলে ও নিরালা, শুরু হোক এই মগ্ন খেলা”
(তিনটুকরোর পাঠ: কোথায় পা রাখি)

নির্বাকের পরামর্শই সরলকে চালিত করে। বৃষ্টি-বন্যায় নির্ভেজা বসন খুলে তার চলতে থাকে নিরালার সঙ্গে মগ্ন খেলা।

- বিজ্ঞাপন -

কী এই মগ্ন খেলা?

যে খেলায় পার্থিবতার মধ্যে থেকেও অপার্থিবতার সান্নিধ্য পাওয়া যায়। যে খেলা এই জীবনকে মহাজীবনের অনন্তস্রোতের মহাসোপানে নিয়ে যায়। সীমার মাঝেই অসীমের চলাচল উপলব্ধি করতে পারে। মার্কিনী জ্যাজ শিল্পী পিয়ানিস্ট ব্যান্ডলিডার ও কম্পোজার হার্বার্ট জেফ্রি হার্বি হ্যানকক্ (জন্ম ১৯৪০) যা বলেছিলেন তা সরলও জানে:

Life is not about finding our limitations, it’s about finding our infinity.

অর্থাৎ জীবন আমাদের সীমাবদ্ধতা খোঁজার জন্য নয়, এটি আমাদের অসীমতা খোঁজার বিষয়। আর এই অসীমতা একটা প্রবাহ তা জন্ম-মৃত্যুর সীমানায় আবদ্ধ নয়। সমগ্র বিশ্ব জুড়ে অনন্তকাল ব্যাপী তা বয়ে চলেছে। ব্যক্তির সুখ-দুঃখ-জীবন সেখানে তুচ্ছ। বুদবুদ মাত্র। রবীন্দ্রনাথও তা জানতেন। আর তা জানতেন বলেই লিখেছিলেন:

আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়।
আমি তার লাগি পথ চেয়ে আছি পথে যে জন ভাসায়॥

এই ‘সর্বনাশ’ শুধু আত্মধ্বংস নয়, আত্মসঞ্চারও। নিজেকে অনন্তের সঙ্গে মেলানো। নিজেকে বহুর মধ্যে স্থাপন। নিজেকে শাশ্বতের কাছে সমর্পণও।

কবিতা তো তারই উচ্চারণ। কবিতা তো সেই অনন্তেরই ভাষা। সেখানেই এম্টিনেস্ বিরাজ করে। মার্কিন চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, অভিনেতা ও নাট্যকার এবং জ্যাজ সঙ্গীতজ্ঞ উডি অ্যালেন (জন্ম১৯৩৫) লিখেছেন:

The artist’s job is not to succumb to despair, but to find an antidote for the emptiness of existence.

Woody Allen, Midnight in Paris: The Shooting Script

অর্থাৎ শিল্পীর কাজ হতাশার কাছে নতিস্বীকার করা নয়, অস্তিত্বের শূন্যতার প্রতিষেধক খুঁজে বের করা। অর্থাৎ এই এম্পটিনেস্-এর কাছেই বিরাজ করার সাধনাই তো প্রকৃত শিল্পীর সাধনা। লেখক বা কবি থেকে যে কোনও শিল্পীই এই পথের পথিক। অস্তিত্বের শূন্যতায় আত্মঅন্বেষণের প্রজ্ঞায় তার যাত্রা অব্যাহত রাখা।

সুতরাং বাইরের সব পরিচয়ই পরিচয়হীন। মানুষের কোনও ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। যে পরিচয় আমরা জানি, যে পরিচয় আমাদের সম্মুখে দাঁড়ায় তা পরিচয়ের ছায়ামাত্র, তা মিথ্যা পরিচয়। আসল পরিচয় তো এম্পটিনেস্ যা নাথিংনেস্ থেকে আসছে। আবার তা নাথিংনেসেই সমর্পিত হবে। প্রবল যৌনাকাঙ্ক্ষা, বা প্রবল দৈহিকসংরাগ বা রক্তমাংসময় যে হিল্লোলের বাতাবরণ —তার সঙ্গে সহবাস করা যায়, তার ঘ্রাণ নেওয়া যায়। তার উত্তাপে জারিত হওয়াও চলে। কিন্তু তা অচিরেই মিলিয়ে যায়। শাশ্বতীর বিন্যাসে তাকে ধরে রাখা চলে না। তার আবেদন ক্ষণিকের বিন্দুর মতো। শুধু একটা সুচের ফুটোয় সুতো ভরে সেলাই করার আয়োজনের মতো। তা আর কতক্ষণ? টি এস এলিয়ট Four quartets 2: East coker-এর কবিতাটি এভাবেই শুরু করেছেন:

In my beginning is my end.
In succession Houses rise and fall, crumble, are extended, are removed, destroyed, restored, or in their place Is an open field, or a factory, or a by-pass.

অর্থাৎ আমার শুরুতেই আমার শেষ। ক্রমাগত বাড়িগুলির উত্থান এবং পতন, চূর্ণ-বিচূর্ণ, প্রসারিত, অপসারণ, ধ্বংস, পুনরুদ্ধার, বা তাদের জায়গায় একটি খোলা মাঠ, বা একটি কারখানা, বা একটি বাই-পাস রাস্তা।

এখানে ‘আমি’ ব্যক্তি সর্বনামের উত্থান-পতনের সঙ্গে সভ্যতার সাম্রাজ্যেরও উত্থান-পতন ও বিকাশ ঘটে চলেছে। বাড়ি, মাঠ, কারখানা, বাইপাস সব—সবকিছু। কিন্তু আমি= জন্ম+মৃত্যু। মাঝখানে সভ্যতার প্রসারণ। এটুকুই আয়ু রচনা। এই আয়ুরই গর্জন শুধু আর কিছু নয়। পার্থিব বাঁচার দায় থেকেই শিল্পী গর্জন করেন। তার গর্জন কখনও প্রসারিত হয়—গৃহ নির্মাণে এবং পুস্তক রচনায়। কবি শঙ্খ ঘোষ এই গর্জনকেই বলেছিলেন: ‘চুপ করো, শব্দহীন হও’— কবিতায় তা উল্লেখও করেছিলেন:

“এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো
শব্দহীন হও
শষ্পমূলে ঘিরে রাখো আদরের সম্পূর্ণ মর্মর

লেখো আয়ু লেখো আয়ু

ভেঙে পড়ে ঝাউ, বালির উত্থান, ওড়ে ঝড়
তোমার চোখের নিচে আমার চোখের চরাচর
ওঠে জেগে

স্রোতের ভিতরে ঘূর্ণি, ঘূর্ণির ভিতরে স্তব্ধ
আয়ু
লেখো আয়ু লেখো আয়ু
চুপ করো, শব্দহীন হও”

আমাদের বাঁচার ভেতর এত ঢেউ আছে, এত মর্মর গান আছে, এত আকাঙ্ক্ষার জানালা আছে—তা সবাই টের পাই। তাই এম্পটিনেস্-কে অস্বীকার করি। কিন্তু কালস্রোতকে তো অস্বীকার করা যায় না। তাকে কিছুতেই ঠেকানোও যায় না। তবু সেই স্রোতের ভিতরে ঘূর্ণি, ঘূর্ণির ভিতরে আমাদের স্তব্ধ-আয়ু আছে। এই ‘স্তব্ধ-আয়ু’ অনন্তেরই ইস্তাহার। তাকেই নিঃশব্দে রচনা করা যায়। সেখানে গর্জন করা চলে না। সভ্যতার প্রাচুর্যের ভেতর এই এম্পটিনেস্-ই আমাদের সম্মোহিত করেছে বারবার।

এই এম্পটিনেস্-এর কাছে ফিরে আসার জন্যই একাকী নিজের মুখোমুখি হতে হয়েছে। অস্তিত্বের শেকড় অনুসন্ধান করতে গিয়ে যেমন অনন্তে পৌঁছে গেছি, তেমনি এই ‘তৈমুর’ নামের আড়ালে সরলতাকে লালন করেছি। আমার সরলতার সঙ্গে বহু সরলতারও দেখা হয়ে যায়। ঝাঁক ঝাঁক শিল্পী-কবির মগ্ন উচ্চারণে গর্জন ভেদ করে সীমাহীন স্তব্ধতা জেগে ওঠে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘এসেছি দৈব পিকনিকে’ কাব্যের ‘একটি স্তব্ধতা চেয়েছিল’ কবিতায় লিখেছেন:

“একটি স্তব্ধতা চেয়েছিল আর এর এক নৈঃশব্দ্যকে ছুঁতে
তারা বিপরীত দিকে চলে গেল,
এ জীবনে দেখাই হলো না।
জীবন রইলো পড়ে বৃষ্টিতে রোদ্দুরে ভেজা ভূমি
তার কিছু দূরে নদী—”

এই নৈঃশব্দ্য সেই অনন্তপ্রকৃতি যাতে জীবন প্রবেশ করে। পার্থিবতা থেকে বিদায় নিয়ে অপার্থিব হয়ে যায়। তখন জীবন মহাজীবনের অদৃশ্যতায় হারিয়ে যায়। যে জীবন বৃষ্টি-রোদে ভূমি স্পর্শ করে—সে জীবন এম্পটিনেস মাত্র। আমেরিকান লেখক এবং শিল্পী হেনরি মিলার (১৮৯১-১৯৮০) বলেছেন:

I need to be alone. I need to ponder my shame and my despair in seclusion; I need the sunshine and the paving stones of the streets without companions, without conversation, face to face with myself, with only the music of my heart for company.

Henry Miller, Tropic of Cancer

অর্থাৎ আমাকে একা থাকতে হবে। আমি নির্জনে আমার লজ্জা এবং হতাশার চিন্তা করব। আমি সঙ্গী ছাড়া, কথোপকথন ছাড়া নিজের সাথে মুখোমুখি হব। কেবল আমার সংগীতের সাথে আমার হৃদয়ের সঙ্গীর জন্য।

এই নিজের কাছে কে এসে বসতে পারে সরল ছাড়া? সরলের সংসার নেই, ক্ষুণ্ণিবৃত্তি নেই, অভিমান নেই, না পাওয়ার কষ্টও নেই। তাহলে সরল কার জন্য কাঁদে? কিসের জন্য তার অপূর্ণতা? কার জন্য তার নির্জনতা? কার জন্য একান্ত একাকী হওয়া?

জীবনানন্দ দাশও এর উত্তর খুঁজেছেন। মানুষ কয়েক মুহূর্ত এই পৃথিবীতে সূর্যের আলোয় অন্তিম মূল্য পেতে চায় প্রেমে। ‘পৃথিবীর ভরাট বাজার ভরা লোকসান’ আর লোভ পচা-উদ্ভিদ কুষ্ঠ-মৃত-গলিত আমিষগন্ধ ঠেলে মরণশীল সময়ের সমুদ্রের চ্ছল চ্ছল শুনে খানিকটা ‘আলো উজ্জ্বলতা শান্তি চায়’। তাই জীবনের দিকে ফিরতে চেয়েই এই একাকী হওয়া। কবি বলেন:

পৃথিবীতে এই জন্মলাভ তবু ভালো;
ভূমিষ্ঠ হবার পরে যদিও ক্রমেই মনে হয়
কোনো এক অন্ধকার স্তব্ধ সৈকতের
বিন্দুর ভেতর থেকে কোনো
অন্য দূর স্থির বলয়ের
চিহ্ন লক্ষ্য ক’রে দুই শব্দহীন শেষ সাগরের
মাঝখানে কয়েক মুহূর্ত এই সূর্যের আলো।

পৃথিবীতে এই: জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা

পৃথিবীতে জন্মলাভের সার্থকতা কতটুকু সেই হিসেব থেকেই কবির নাথিংনেস্-এর উপলব্ধি এসেছে। নাথিংনেস্—’অন্ধকার স্তব্ধ সৈকতের বিন্দুর ভেতর’ থেকে আর এক নাথিংনেস্ ‘দুই শব্দহীন শেষ সাগরের মাঝখান’ যাকে জন্ম থেকে মৃত্যু beginning and end বলা যায়। এরই মাঝে জীবন ‘কয়েক মুহূর্ত সূর্যের আলো’। এই বোধ আমার মধ্যেও জেগে উঠল আমারই জন্মের মাসে। পার্থিব ‘তৈমুর’ থেকে অপার্থিবের ‘সরল’ হয়ে গেল। যে কবিতা আমার ক্ষুধাতুর উপলব্ধিকে জারিত করে, সে কবিতা অপার্থিব অনন্তেরও ধারক হয়ে ওঠে। পৃথিবীর ধুলোমাটির আসক্তি থেকে নিরাসক্তিরও জাগরণ ঘটায়। যে হাত আমাকে জাপটে ধরে, সে হাত বাঁশির মতোও বাজাতে পারে। তখন এক ভিন্নগ্রহে পৌঁছে যাই। সেখানে—

“প্রেম-ট্রেম সব ফালতু, মান অভিমান বলে কিছু নেই
আকাশ পোড়ানো গন্ধ, সারি সারি আলো
এরকম নরম সূর্যের দেশ—মানুষীর সাদা মুখ
সেখানে থাকে না
তবুও বিরামহীন সেখানেও আয়ু কাঁদে—
কেঁদে কেঁদে নিটোল বর্ষায় মস্তিষ্কের জীবকে ভাসায়—”
(মস্তিষ্কের জীব: খা শূন্য আমাকে খা)

মস্তিষ্ক প্রৌঢ় মানুষ, তার শুক্রাণু মহাশূন্য গোলবৃত্ত। এই বৃত্ত আসলেই ব্রহ্মজীবনের ক্রিয়ায় নিহিত অনন্ত জীবনের প্রজ্ঞা।

যৌবনের প্রথম উপলব্ধিতেই কবিতার এই বোধ আমাকে স্বতশ্চল করে। এম্পটিনেসে বসিয়ে দেয়। অস্তিত্ব অন্বেষণে ‘তৈমুর’কে ভেদ করতে থাকি। তৈমুরের অন্তরালে কী আছে, কে এত কথা বলে, কে স্তব্ধতার বিরামহীন পথে আত্মচারী স্পর্ধায় তীব্র হয়ে ওঠে— এসবের উত্তর পেতে চেষ্টা করি। আর সব উত্তরের পাশেই দেখি পৃথিবীর সমস্ত স্রষ্টারা একে একে উপস্থিত হন। সকলের মধ্যেই নিজেকে আবিষ্কার করতে থাকি তখন। নয়ের দশকেই উত্থান ঘটে আমার এই সরল বোধের পরিচয়টির। সরল তৈমুরের আড়ালেই আত্মপ্রকাশ করে। ‘আত্মনিবেদন’ নামে একটি কবিতায় তখন লিখি:

“অনেক তৈমুর এসে পৃথিবীতে বসবাস করে
আমিও তৈমুর হই নয়ের দশকে

আমার ভ্রমের পথে মানব কাঙাল
চাঁদ দ্যাখে, রাত দ্যাখে, আর্তনাদ ভরা তার কাল

অনেক জোনাক ওড়ে আশা-নিরাশার
ভাসমান অন্ধকারে অবিন্যস্ত হয় সংসার

অনেক প্রাচীর ঘেরা মানুষের গান
জাত-ধর্মে সম্পর্ক ভাঙা, রক্তের রাঙা প্রহর

তবুও অশোকবনে নিরালার ঘুম
সহিষ্ণু বিশ্বাস এসে স্বপ্নে ডেকে নেয়

আমি কি মাধবীর কাছে চেয়েছিলাম যেতে?
মধুবতী, মুগ্ধবতী তার লীলাচ্ছল ভেজায় আমাকে

আমি তো মানুষ তাই প্রবৃত্তির সম্মোহনে জাগি
আমি তো বিস্মিত হই দুঃখের সন্নিধি পেতে পেতে

সান্ত্বনা এসে রোজ কাঁদে
আমি শান্তশ্রী হয়ে বসি তার কাছে

আলো ফুরিয়ে যায়, আলো ফুরিয়ে যায়
নয়ের দশকের ম্লান অন্ধকারে খুঁজে পাই আমাকে।”

সামঞ্জস্যহীন পৃথিবীতে সীমাহীন অন্তরায়ের মধ্যেও আত্মস্ফুরণের ব্যত্যয় যে ঘটেনি তা কবিতা রচনার মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হয়ে চলেছে। এম্পটিনেসে উপস্থিত হয়ে নাথিংনেস্-এর ভেতর বিলীন হতে চেয়েই এই যাত্রা আয়ু রচনার স্তব্ধতায় কেবলই আত্মসমাহিত প্রজ্ঞায় উচ্চারণ করে চলেছে এই আত্মনিবেদন।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
তৈমুর খান জন্ম ২৮ জানুয়ারি ১৯৬৭, বীরভূম জেলার রামপুরহাট ব্লকের পানিসাইল গ্রামে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে মাস্টার ডিগ্রি এবং প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতা নিয়ে পি এইচ ডি প্রাপ্তি। পেশায় উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহ শিক্ষক। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: কোথায় পা রাখি (১৯৯৪), বৃষ্টিতরু (১৯৯৯), খা শূন্য আমাকে খা (২০০৩), আয়নার ভেতর তু যন্ত্রণা (২০০৪), বিষাদের লেখা কবিতা (২০০৪), একটা সাপ আর কুয়াশার সংলাপ (২০০৭), জ্বরের তাঁবুর নীচে বসন্তের ডাকঘর (২০০৮), প্রত্নচরিত (২০১১), নির্বাচিত কবিতা (২০১৬), জ্যোৎস্নায় সারারাত খেলে হিরণ্য মাছেরা (২০১৭) ইত্যাদি। কবিরুল ইসলাম স্মৃতি পুরস্কার ও দৌড় সাহিত্য সম্মান, নতুন গতি সাহিত্য পুরস্কার, আলোক সরকার স্মারক পুরস্কার সহ অনেক পুরুস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!