মধু চরণ চুমি
ঝলমলে সে নদীর মতো জ্বলজ্বলে এক ছেলে
সব ভুলে যায় এক নিমেষে ইংরেজি বই পেলে!
স্বপ্ন দেখে বিলেত যাবার, মস্ত কবি হতে
হারায়নি সে ইতিহাসের বদলে যাওয়া স্রোতে।
কপোতাক্ষ নদের বুকে জ্যোৎস্না গেছে ভেসে
পাড়ি দিলেন ইলেত-বিলেত, ইংরেজিময় দেশে
ধর্ম দিলেন জলাঞ্জলি বিশ্বনাগরিকে
সমকাল তো বুঝলো না সেই আলোর মানুষটিকে।
লিখতে থাকেন ইংরেজিতে গুচ্ছ গুচ্ছ লেখা
সাফল্য এক মরীচিকা, পেলেন না তার দেখা।
স্বীকৃতি নেই তেমন ভাবে, বাংলার মাটি ডাকে
মধুসূদন বাংলা ভাষার আঁচল ছুঁয়ে থাকে।
বিদ্যাসাগর ডাক দিয়েছেন, লিখতে মাতৃভাষা
নতুন করে বুকের তাপে ঘুরতে থাকে আশা।
একাগ্রতায় লিখতে থাকেন, জ্বলতে থাকে তারা
মধু কবির সিংহাসনে আর কাঁটা দেয় কারা?
মেঘনাদ থেকে শকুন্তলা, দ্রৌপদী বা জনা
সব লেখাতে আগুন ঝরে, যুক্তি তুলোধোনা।
বাংলা ভাষার মহাকবি, দেউলিয়া তাঁর সবই
আজও তিনি আগের মতো লম্বা চলচ্ছবি।
সময় যাচ্ছে জলের মতো, বছর যাচ্ছে সোজা
দুইশ বছর পাড়ি দেওয়া আলোর পাখি খোঁজা।
যশস্বী তো তাঁকেই বলে, ওজস্বী তাঁর ভাষা
আজও তিনি সারস্বত, শাশ্বত এক আশা।
কপোতাক্ষ নদের তীরে আজও বিকেল নামে
তাঁর জন্যে তীর্থভূমি সাগরদাঁড়ি গ্রামে।
কবির কবি মহাকবি মধুসূদন তিনি
আমরা তাঁকে সত্যি আজও সঠিক ভাবে চিনি?
চিনতে হলে পড়তে হবে, জানতে হবে তাঁকে
কেমন করে ফিরে পেলেন? পথ হারানো মাকে।
মা মানে তো বাংলা ভাষা, মা তো স্বদেশভূমি
জানুয়ারির পঁচিশ তারিখ মধু চরণ চুমি।
তেইশের কবিতা
ঝলসানো ইতিহাসে টগবগে ঘোড়া
বাঙালির কপালটা একেবারে পোড়া!
সব কাজে হাত দেয়, কাঁধ দেয় কাঁধে
মসনদে পাড়ি দিতে সব্বাই বাঁধে।
তেইশের ভোর এলে ঘোড়া ওঠে জেগে
ভারতের ইতিহাস ছোটে দ্রুত বেগে।
ইতিহাস ইতি হাঁস প্যাঁক প্যাঁক ডাকে
আদর্শ ধুলোমাখা পথে পড়ে থাকে।
তেইশের ভোর এলে ফুল তুলি আগে
সুভাষিত সুভাষের গৌরব জাগে।
সুবাসিত সুহাসিনী পূজনীয় নেতা
তাঁকে নিয়ে এ যে দেখি কী আদিখ্যেতা?
ইতিহাস চোখ মোছে, সুগভীর শোকে
তেইশের পিকনিকে যায় কত লোকে!
সাধ আর আহ্লাদ দেয় গড়াগড়ি
কেউ বলে দিঘা গিয়ে কালো ঘোড়া চড়ি।
তেইশ তো হলি ডে ভাত ঘুমে মজে
ইতিহাস পাতা খুলে কে বা তাঁকে খোঁজে।
ভোজবাজি হল্লাতে কেটে যায় ছুটি
নেতাজির ইতিহাস খায় লুটোপুটি।
ফুল, মালা, বক্তৃতা আয়োজন কত
তার চেয়ে বাড়াবাড়ি বিনোদন ব্রত।
দিনটা তো তবু আসে ঘোড়ার চাবুকে
স্বদেশমাতার মুখ লাগে টুকটুকে।
দেবী বন্দনা
বিদ্যাদেবী সরস্বতী আলপনা দিই টেনে
তুমি আসছো ঘরের দাওয়ায় আমরা গেছি জেনে।
ফুলের বাগান ঝলমলে আজ, হলুদ গাঁদা আলো
তোমার জন্যে গন্ধ ছড়ায় নতুন আতপ চাল’ও!
অল্প অল্প শীতের হাওয়া গল্প ঘোরে ফেরে
শীত বলছে, রোদের কাছে দাও না এবার ছেড়ে।
শ্রীপঞ্চমী শুভ সকাল বিদ্যাদেবী বসে
কে আর বলো,এমন দিনে কাটাবে আফসোসে?
সবার মতো অঞ্জলি দিই, প্রণাম করি মাকে
আকাশ বাতাস গাঁদা ফুলের গন্ধ লেগে থাকে।
অন্নভোগের সুবাস ছড়ায় গলির থেকে গলি
আরও কত গল্পগাছা কোনটা আগে বলি?
বিদ্যাদেবী সরস্বতী প্রদীপ রাখি জ্বেলে
তোমার আশীর্বাদে হবো সর্বজ্ঞানী ছেলে।
গঙ্গা জলে হাত ধুয়েছি, চোখ ধুয়েছে আলো
বিদ্যাদেবী দাও মনোযোগ, জ্ঞানের বৃষ্টি ঢালো।
সবাই কেমন শান্ত স্বভাব, তোমার সামনে এসে
সেই মেয়েটি ছাপা শাড়ি জড়ায় ভালবেসে।
সেই ছেলেটি পাঞ্জাবিতে ফুটফুটে তার হাসি
সবাই যেন এক হয়ে আজ দাঁড়ায় পাশাপাশি।
সবাই কেমন হাসিখুশি, সবাই তোমার কাছে
সবার মধ্যে তোমার প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা আছে।
পাড়ার পূজোয় গনগনিয়ে রবিঠাকুর বাজে
মন কেমনের ঝর্ণাধারা কারও বুকের মাঝে।
বিদ্যাদেবী কি আর বলি? প্রণাম তোমার পায়ে
ইচ্ছে তো হয় বাসা বাঁধি বিদ্যাধরী গাঁয়ে।
বিদ্যাদেবী বিদ্যা ধরি তোমার শুভাশিসে
তোমার জ্ঞানের অঝোর ধারায় থাকতে তো চায় মিশে।
বইমেলার কবিতা
বইমেলাতে বই শুধু নয়, নিত্য নতুন পসার
বইমেলাতে কিনতে এলাম দান্তে এবং চসার।
বইয়ের স্টলে ভিড় বেশি নেই, বিক্রি বাটা অল্প
বইমেলা আজ সই পাতানো বিনোদনের গল্প।
খাচ্ছি-দাচ্ছি সেল্ফি তুলছি, মস্তি হচ্ছে দেদার
কে আর বলো সময় দেবে মনন এবং মেধার
কফি শপে উড়ছে ধোঁয়া.কেউ খুশি কেউ গম্ভীর
সানগ্লাসে যার চোখ ঢেকে যায়,কে বলে সে কম বীর?
নতুন কবির বই এসেছে, লিটিল ম্যাগ তো চেল্লায়
প্রায় সকলেই ঘুরে বেড়ায়, বই সাজানো কেল্লায়।
সবই আছে বইমেলাতে, উড়ছে ধুলোবালি
বইয়ের স্টলে লোক দেখি না, বইমেলা রূপশালী।
আমরা ক’জন কয়েক ডজন সেল্ফি তুলে তৃপ্ত
বাচিকশিল্পী বীরেন বাবুর পংক্তিতে বেশ দৃপ্ত।
কেউ উদাসীন, কেউ চিন্তিত, কেউ দেখি বিস্মিত
কলেজ কন্যা সন্ধ্যার পরে ব্যান্ডের গানে প্রীত।
লোকসঙ্গীত গিটারের তারে, দর্শক আনমনা
বইমেলাতে আর যাইহোক, বই কেন কিনব না?
এমন প্রশ্ন পাক খায় মনে, উত্তর খোঁজে কেবা?
সবাই বেশি মনোযোগ দেয়, হইচই পরিষেবা!
বইমেলা মানে সইমেলা নয়, হইচই কেন তবে
বইমেলাতে এত কিছু? বই কেনা কী হবে?
বইমেলাতে এটা ওটা, আলোর-হৃদয় রুক্ষ
বইমেলাতে শেষটায় দেখি, বই কেনাটাই মুখ্য।
কে কার বোঝায়? সবাই বোদ্ধা, বই তো কাঁদে স্টলে
আয় বইমেলা বইটই পড়ি, আমরা বইয়ের দলে।
এইবার খুলি বইয়ের মলাট, এটা ওটা দিই ফেলে
বইমেলাতে আমরা ক’জন সত্যি সোনার ছেলে।
ছড়ার লোক
ছড়ার পাতায় রঙ ছড়ালাম, টুকটুকে সেই রঙ
পুজোর ছুটির ঘন্টা বাজে, চারদিকে ঢং ঢং।
ছড়ার পাতায় গাছগাছালি, পাখপাখালির ভিড়
মন কেমনের গল্প হয়ে ডাকছে নদীর তীর।
ছড়ার হাটে হরেক জিনিস, বিক্রি তো নেই মোটে
ছোট ছোট ইচ্ছেগুলো আলোর মতো ফোটে।
ছড়ার হাটে ছড়াছড়ি অজস্র সব ছড়া
ভালবাসা, আদর কিংবা স্বপ্ন দিয়ে গড়া।
ছড়ার গাঁয়ে নূপুর পায়ে সবাই আসে যায়
ছড়ার ভেতর ছন্নছাড়ার স্বপ্ন দেখতে পায়।
একটা ছড়া সবুজ রঙের একটা ছড়া লাল
ছড়ার জন্যে সবাই পাগল সত্যি চিরকাল।
ছড়া ছড়া ছড়াচ্ছড়ি, ছড়ার নামে বাড়ি
ছড়ার জন্যে ভাব জমে যায়, হয় না কোথাও আড়ি।
ছড়া ছড়া ছড়াচ্ছড়ি, দেয় তো গড়াগড়ি
সুয়োরানী, দুয়োরানী, রঙবেরঙের পরী।
ছড়ার পাতায় ছড়ায় আলো, মেঘের পাশে মেঘ
ছবির মধ্যে যায় না বোঝা হাওয়ার গতিবেগ।
শালুক ফোটা সোনাই দিঘি, শোনায় যেন গান
ছড়ার দেশে ঘুরতে থাকে ছড়ার কলতান।
ছড়ার পাতায় রাজকাহিনি, কাজ তো রাজার নেই
দেশজুড়ে আজ মহামারী, হারিয়ে গেছে খেই।
কোথায় পাব? সে দেশ আবার, ছড়ার পাতায় চোখ
গর্ব করে বলতে পারি, আমরা ছড়ার লোক।
ভাঙা বুকে বল পাই
আমাদের নদী নেই, যদি আছে শুরুতেই
সব কাজে অলিগলি জল খায় গুরুতেই।
আমাদের পথ নেই, মতামত ভুরি ভুরি
একা একা বসে থাকা, বোকা বোকা বাহাদুরি।
এটা পারি ওটা পারি, চলে যাব উনোকুটি
শেষমেষ দেখা যায়, ষোলআনা চুনোপুঁটি।
কে কি পারে? কে কি বলে? সবকিছু গোলমেলে
ভাত পাতে ভাজাভুজি কতটুকু ঝোল মেলে?
আঁকিবুকি খোকাখুকি দিনরাত ঠোকাঠুকি
ওরা গেছে হাওয়া খেতে খোলামেলা সোনামুখী।
আমাদের দাবি নেই, ভাঙা ঘরে চাবি নেই
ভবঘুরে সংসারে ছুটে চলে যাবি নেই।
নেই নেই গ্লানি নেই, জারিজুরি জলসায়
এদেশের মস্তানি পথেঘাটে ঝলসায়।
আমাদের কিছু নেই, আগাগোড়া ফড়ফড়
নেমে আসে ব্যর্থতা হাত ধরে পরপর।
নেমে আসে কালোমেঘ ছলছলে সন্ধ্যায়
দোকানের ঝাঁপ নামে ক্যাপিটাল মন্দায়।
ফুটফুটে ছেলেবেলা লাটকায় রাস্তায়
গানের তুফান তোলে চাউমিন-পাস্তায়।
নুন দিয়ে পান্তা খায়নি তো সান্তাই
এখনও নদীর কাছে চাষ হয় ধান তাই।
একমুঠো রোদ খেলে কাদামাটি জলপাই
দু-লাইন লিখে আজও ভাঙা বুকে বল পাই।