আমি এক শূন্যের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি
কেউ যদি কবিতা না পড়ে, কোনো সম্পাদক যদি কবিতা না ছাপে, কোনো প্রকাশক যদি কাব্যসংকলন না বের করে—তবুও আমি কবিতা লিখবো। মৃত্যুদূত এসে যদি আমার আত্মাকে নিয়ে যায়—সেখানেও সুযোগ থাকলে তাকে আমি কবিতা শোনাবো।
পৃথিবীকে যখন তিল তিল করে অনুভব করতে শিখেছিলাম—তখনও আমার মধ্যে কবিতার জন্ম হয়েছিল। আদমের দৃষ্টিতে হবাকে যখন প্রথম দেখেছিলাম—তখনও আমার মধ্যে কবিতা ছিল। যখন প্রথম গন্দম খেয়েছিলাম—তখনও আমার মধ্যে কবিতা ছিল। যখন প্রথম স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে নির্বাসিত হয়েছিলাম—তখনও আমার মধ্যে কবিতা ছিল। যখন প্রথম আমাদের সঙ্গম হয়েছিল—তখনও আমার মধ্যে কবিতা ছিল।
তখনও, তখনও আমার মধ্যে কবিতা ছিল।—যখন প্রথম ঘর বেঁধে ছিলাম।—যখন প্রথম শিকার করেছিলাম।—যখন প্রথম ফসল ফলিয়েছিলাম।—যখন প্রথম আগুন জ্বালিয়ে ছিলাম।
তখনও, তখনও আমার মধ্যে কবিতা ছিল। যখন কাছের বন্ধুজন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরা আমাকে কষ্ট দেওয়ার কৌশল করেছিল।
তখনও আমার মধ্যে কবিতার জন্ম হয়েছিল।—দুঃখ-দারিদ্রের চাপে অনাহারে-অর্ধাহারে যখন দিনপাত করেছিলাম।
তখনও আমার মধ্যে কবিতার জন্ম হয়েছিল।—অপমানিত হয়ে যখন ঘরে এসে একাকী অশ্রু বিসর্জন দিয়েছিলাম।
কবিতা কারো লেখা দেখে আমি অনুসরণ করে, অনুকরণ করে লিখতে শিখিনি। কবিতা আমার কাছে নিজেকে বোঝানোর একটা আড়াল। একটা ভাষা। একটা সাঁকো। কবিতা আমার কাছে অস্থির ও অসামঞ্জস্য পরিস্থিতিতে একটা আশ্রয়। কবিতা আমার কাছে আত্মক্ষরণের স্বগতোক্তি। কবিতা আমার কাছে আমারই বহু সত্তার মুখোমুখি হওয়া। কবিতা আমার কাছে একটা শাব্দিক অস্ত্র নির্মাণ। কবিতা আমার কাছে একটা আধ্যাত্মিক এবং দার্শনিক চেতনা। কবিতা আমার কাছে একটা বৌদ্ধিক সংসার। কবিতা আমার কাছে একটা নৈঃশাব্দ্যিক সাধনক্ষেত্র।
আমার ধর্ম, প্রেম, যাতনা, উপলব্ধি, পুনর্জন্ম, মৃত্যু, কান্না, হতাশা, অযোগ্যতা এবং উত্তরণ এই কবিতার মধ্যেই রূপান্তরিত হয়ে ফিরে আসে। তাই কবিতাকে আমি আত্মিকশিল্প এবং জীবনশিল্প হিসেবে জানতে শিখেছি। পার্থিব সবকিছুর মধ্যেই নশ্বরতা যেমন বিরাজমান, তেমনি আমার কবিতার মধ্যেও চিরশূন্যতা বা এম্পটিনেস বিরাজমান। বাতাস যেমন আমাদের চারিপাশ ঘিরে আছে, হৃদয় যেমন আমাদের উপলব্ধির ক্ষরণকে ধারণ করে আছে, আত্মা যেমন আমাদের জীবন মহিমাকে প্রকাশ করে চলেছে—তেমনি কবিতাও এগুলির সঙ্গে সঙ্গে প্রবহমান হয়ে চলেছে।
কিন্তু এতকিছু পেয়েও আমরা আমাদের পার্থিবতার কোনো বাঁধনে বেঁধে রাখতে পারি না। হাতের মুঠিতে ধরে রাখতেও পারি না। কোনো কৌশলেই আকর্ষণ করতে পারি না। সর্বদা তা নাথিংনেস্ হয়ে যায়। এত কিছু আছে তবু কিছুই নেই। আমি যখন ছিলাম না অর্থাৎ জন্ম গ্রহণ করিনি, তখনও সব ছিল; আমি যখন থাকবো না, তখনও সব থাকবে। তাহলে আমার আয়ুষ্কাল জুড়ে এত ফুল ফুটলো! এত ভ্রমর উড়লো! এত মৌচাক হলো! আমি মধু পান করলাম। মৌমাছির হুল বিদ্ধ হলাম।—এ সবই মিথ্যা? এসবই স্বপ্ন মাত্র?
আমার বিবাহ হলো। কত বাজনা বাজলো। বাসর হলো। তারপর? তারপর?
সেসব অনেক কথা! কাপড় পরা, কাপড় খোলা;আলো জ্বালা, আলো নেভানো সবই চলতে থাকলো। চলতে চলতে আমাদের সব চুল সাদা হতে লাগলো। চোখ ঝাপসা হতে লাগলো। হাড় ক্ষয় হতে লাগলো। ঘুম ভেঙে যেতে লাগলো। আমরা নাথিংনেসের দিকে পৌঁছাতে লাগলাম। একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব। সব ঢেউ মিলিয়ে যাবে। যে শূন্য থেকে জীবনের উত্থান, সেই শূন্যে গিয়েই আবার মিলিয়ে যাওয়া।
সুতরাং নাথিংনেসকেই জীবনদর্শনের মূল ভিত্তি হিসেবে কবেই খুঁজে পেয়েছি। তাই কবিতাকে তার শূন্য ভূমিতে শব্দের অস্থায়ী ক্যাম্প নির্মাণ করে রেখেদিয়েছি। যুগপ্রবাহে তা ভাসমান। আমি সেখানে আশ্রিত। বারবার মুখ বের করে চাঁদ ও জ্যোৎস্না, রাত্রি ও নক্ষত্র, গোধূলি ও সন্ধ্যা দেখে নিচ্ছি। আমার নাথিংনেসের দরজা দিয়েই মিছিল যাচ্ছে। কলরব যাচ্ছে। আমার নাথিংনেসের দরজা দিয়েই চন্দ্রিকারা জল তুলতে যাচ্ছে। তারা পিপাসা নিবারণ করবে। আমার নাথিংনেসের দরজা দিয়েই কৃষকের ট্রাক্টর যাচ্ছে। তারা ক্ষুধা নিবারণ করবে। আমার নাথিংনেসের দরজা দিয়েই ফিসফাস যাচ্ছে। তারা প্রেম উদযাপন করবে। জীবন প্রবাহের কত বিচিত্র গতি, কত বিচিত্র অণুভাবনা, কত বিচিত্র উদ্যোগ ও অসঙ্গতি— দেখতে দেখতে রাত্রি পার হয়ে যাচ্ছে। আমার কবিতাও উপসংহারের দিকে চলে যাবে। যেতে যেতে কয়েকটি কথা বলতে চাইছি।
কবিতা লিখি আমি আমার প্রয়োজনে। যেমন আমি আমার প্রয়োজনে খাই। আমার প্রয়োজনে ঘুমাই। আমার প্রয়োজনে রাস্তা হাঁটি। কখনও কখনও এই প্রয়োজনটিও অন্যের উপকারে লাগে। যখন অন্যের কোনো ক্ষতি করে না, তখন তা করতে আমার বাধা কোথায়?
কবিতা লেখার মতো একটা নিরীহ কাজ করে আনন্দ পাই। সবই যখন নাথিংনেস্, তখন যতই বৈষয়িক ভাবনা মাথায় চেপে বসুক—তাতে যে সর্বসুখ এ কথা কে বলতে পারে? যারা কবিতা লিখলো না, প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে মেলালো না, যারা অভিমানে একাকী কাঁদলো না, যারা দুঃখ ও মৃত্যুর স্বাদ পেতে চাইলো না— যারা শুধু অর্থ, ভোগ, ক্ষমতা লাভ, দর্প, আস্ফালন, হত্যা, গ্রাস, কাম ইত্যাদি নিয়ে জীবনের মোক্ষম প্রাচুর্য ঘোষণা করতে চাইলো—তারাই কি তবে সার্থক মানুষ? তারাই কি তবে অমরত্ব প্রাপ্তির সূচকে উত্তীর্ণ? কেউ কখনও এদের সাক্ষাৎকার নিয়ে দেখুন এরা কতটুকু সুখী। এরা কতখানি পূর্ণ। আমি কবিতা লিখি বলেই ‘এই জীবন এম্পটিনেস’ ঘোষণা করে গেলাম।
সুতরাং মৃত্যু, যন্ত্রণা, না পাওয়া, অর্থহীন হওয়া, নীরবতা আমার কাছে এক কৌতূহলোদ্দীপক অভ্যাস। আমি কবিতা লিখি বলেই যশ খ্যাতি অর্থ সম্পদ কিছুই চাইলাম না। আমি কবিতা লিখি বলেই এইভাবে নির্বাসিত হতে চাইলাম। আমি কবিতা লিখি বলেই আমার আনন্দ ওদের থেকে আলাদা।
আমার প্রাপ্তির মধ্যে হাহাকার নেই। আমার শব্দ কখনও মারণাস্ত্র তৈরি করে না।
আমার শব্দ যাপন লেখে। আমার শব্দ শূন্যতা লেখে। আমার শব্দ নীরবতা লেখে। আমার শব্দ স্মৃতি লেখে। আমার শব্দ আত্মদহন লেখে। আমার শব্দ স্বপ্ন লেখে। আমার শব্দ মানুষের উচ্ছেদ লেখে না। আমার শব্দ প্রেম লেখে। আমার শব্দ ভালোবাসা লেখে। আমার শব্দ অভিমান লেখে। আমার শব্দ এলোমেলো লেখে। আমার শব্দ কাটাকুটি লেখে। আমার শব্দ অর্থহীন লেখে। আমার শব্দ অর্থও লেখে। আমার শব্দ অন্ধকারে আলোও খুঁজতে জানে। আমার শব্দ সঞ্চারিত হয় অনন্তকালের নিরিখে। আমার শব্দ আমাদের হয়ে যায়।
কেউ কেউ তাস খেলে জীবন কাটায়। কেউ কেউ মানুষ খুন করতে ভালোবাসে। কেউ কেউ মঞ্চে উঠে রাজনৈতিক বক্তৃতা করে। কেউ কেউ মিথ্যে ভাষণ দিতে পারে সুচারুভাবে। কেউ কেউ নিছক পার্টির লোক। কেউ কেউ ধান্দাবাজ সর্বদা মুখোশ পরে থাকে। কেউ কেউ শোষক সাম্রাজ্যবাদীর তাঁবেদারী করে।
অমানবিক যুগসংকটকারী কূটকৌশলী বিভ্রান্তকারী অসহিষ্ণু বিভাজনকারী চক্রান্তকারী মানুষের অভাব নেই। এরা মানুষের মাহাত্ম্য বোঝে না। সৌন্দর্যের কদর করতে জানে না। জীবনের আদর করতে জানে না। এরা কী পেতে চায় পৃথিবীর কাছে? এরা কী স্বাক্ষর রাখতে চায় পৃথিবীর মাটিতে? না, আমি তো এদের মতো নই। আমি না কবিতা লিখি। আমি জীবনকে ভালবাসি। আমি মানুষকে ভালোবাসি। আমি মানবতাবাদকে আমার ধর্মের অন্তর্ভুক্ত করি। আমি এম্পটিনেসের কাছে আমার সব উপার্জন গচ্ছিত রাখি। আমি নির্দ্বিধায় হাঃহাঃহাঃ হেসে উঠতে পারি। আমি তথাকথিত বৈষয়িক সম্পদ তাচ্ছিল্য করতে পারি। আমি অমরত্ব কাঙ্ক্ষিত মনে করি না। আমি কবিতা লিখি শুধু আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য। আমার ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলার জন্য। আমার প্রেমের সঙ্গে আদান-প্রদানের জন্য।
আমি কথা বলতে বলতে থেমে যাই। আমি কথা বলতে বলতে অন্য কথা বলে ফেলি। আমি কথা বলতে বলতে কিছুটা শূন্যতা রেখে দিই। আমি কথা বলতে বলতে অনেক কথা বলে ফেলি।
তাইতো আমি স্বচ্ছন্দ বোধ করি কবিতায়। তাইতো আমি মনের মতো সাজাতে পারি আমার কথাগুলি। তাইতো আমি বিশৃঙ্খলাকেও প্রশ্রয় দিয়ে ফেলি। তাইতো আমি ভিন্নধারা খুঁজি। তাইতো আমি অনুকার হতে পারি না। তাইতো আমি কারো পছন্দের পাত্র হয়ে ওঠার অপেক্ষা করি না। আমাকে কেউ ‘ভালো কবি’ না বলুক তাতে আমার ক্ষতি নেই। আমাকে কেউ ‘মন্দ কবি’ বলুক তাতেও আমার লাভ নেই। আমি আমার মতো। আমি আর কারো মতো নই। আমি এক শূন্যের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। আর আমার অদৃশ্য চেতনার ডালপালাগুলি চারিদিকে মেলে দিচ্ছি।