বাংলা আধুনিক গানের জগতে বহু প্রতিভাবান সুরকার ও গীতিকার এসেছেন, কিন্তু কিছু নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে তাঁদের সৃষ্টি ও অবদানের কারণে। অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় এমনই এক সুরকার, যিনি বাংলা গানের ঐতিহ্যে এক স্বতন্ত্র অধ্যায় রচনা করেছেন। তাঁর সুরের মধ্যে ছিল এক অনন্য মাধুর্য, যা শ্রোতাদের মনে গভীর ছাপ ফেলে। বাংলা আধুনিক গান থেকে চলচ্চিত্র সঙ্গীত—সব ক্ষেত্রেই তিনি রেখে গেছেন অমূল্য অবদান।
প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষা
১৯৩১ সালের ২৪ জুলাই কলকাতার এক ব্রাহ্ম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও তাঁর জন্ম উত্তর কলকাতায়, শৈশব ও বাল্যকাল কেটেছে দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়ায়। তাঁর পিতা নিরাময় বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন একজন সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ, যিনি ছোট থেকেই ছেলেকে সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহী করে তোলেন।
তাঁর পরিবারের পরিবেশ ছিল সঙ্গীতমুখর। তাঁর মাতা লাবণ্য বন্দ্যোপাধ্যায় হারমোনিয়াম বাজাতেন, এবং মেজো জ্যাঠা নিরুপম বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন একজন ধ্রুপদী সঙ্গীতশিল্পী। তাই ছোট থেকেই অভিজিৎ সঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি প্রথম তালিম নেন তাঁর অগ্রজ অরিন্দম বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে, যিনি নিজেও ছিলেন একাধারে গীতিকার ও সুরকার।
স্কুলজীবনে পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি সঙ্গীতের প্রতি গভীর অনুরাগী হয়ে ওঠেন। তিনি রামচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন এবং ১৯৪৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে সঙ্গীতই ছিল তাঁর প্রধান আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।
সঙ্গীত জগতে প্রবেশ
অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গীতজগতে প্রবেশ ঘটে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের (আইপিটিএ) মাধ্যমে। এটি ছিল স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের এক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক আন্দোলন, যেখানে অনেক প্রতিভাবান সুরকার, গীতিকার ও শিল্পী নিজেদের প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়েছিলেন।
তিনি আইপিটিএ-তে কাজ করার সময় সলিল চৌধুরীর সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। সলিল চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে তিনি সঙ্গীতের সূক্ষ্ম দিকগুলি রপ্ত করেন। সেই সময়ে তাঁকে “স্যাটেলাইট” বলা হতো, কারণ তিনি অনল চট্টোপাধ্যায় ও প্রবীর মজুমদারের সাথে একত্রে সলিল চৌধুরীর ছায়ায় কাজ করতেন।
এই সময়েই তিনি উষারঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নেন এবং বিখ্যাত পিয়ানোবাদক ভি বালসারার কাছে পিয়ানো শেখেন।
প্রথম সুরারোপ ও জনপ্রিয়তা
অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম সুরারোপিত গান ছিল কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা “দূরের পাল্লা”, যা কিংবদন্তি শিল্পী শ্যামল মিত্রের কণ্ঠে জনপ্রিয়তা লাভ করে। এটি বাংলা আধুনিক গানের জগতে তাঁকে প্রতিষ্ঠা এনে দেয়।
তবে তাঁর অন্যতম আলোড়ন সৃষ্টিকারী গান ছিল “কোথায় সোনার ধান”, যা অনল চট্টোপাধ্যায়ের কথায় ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত হয়। গানটি প্রকাশের পরই শ্রোতাদের মন কেড়ে নেয় এবং বাংলা গানের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।
এরপর তিনি একের পর এক জনপ্রিয় গান সৃষ্টি করতে থাকেন। তাঁর সুরে গেয়েছেন বাংলা গানের স্বর্ণযুগের শিল্পীরা—
- হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
- সনৎ সিংহ
- সতীনাথ মুখোপাধ্যায়
- মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়
- সুবীর সেন
- কিশোর কুমার
- লতা মঙ্গেশকর
- আশা ভোঁসলে
চলচ্চিত্রে অবদান
অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় চলচ্চিত্র সঙ্গীতেও তাঁর প্রতিভার ছাপ রেখে গেছেন। যদিও আধুনিক বাংলা গানের তুলনায় চলচ্চিত্রে তাঁর কাজের সংখ্যা কম, তবুও তাঁর সৃষ্টি কিছু গান আজও বাংলা ছবির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।
তিনি প্রথম সঙ্গীত পরিচালনা করেন ১৯৬৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলা ছবি “অশ্রু দিয়ে লেখা”-তে। এরপর একাধিক চলচ্চিত্রে তিনি সঙ্গীত পরিচালনা করেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—
- “মৌনমুখর” (১৯৮২)
- “নদীর নাম জানি না”
- “ঋণমুক্তি” (২০০০)
বিশেষ করে “মৌনমুখর” ছবিতে তাঁর সুরারোপিত “সেই তানপুরা আছে, ছিঁড়ে গেছে তার” (কিশোর কুমার) ও “শিলঙের পাইন বনে বনে” (কিশোর কুমার ও অনুরাধা পাড়োওয়াল) গান দুটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
সাহিত্য ও অন্যান্য কাজ
শুধু গান রচনা নয়, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা গানের ইতিহাস নিয়েও লেখালেখি করেছেন। তাঁর কিছু উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম হল—
- “কিছু ভাবনা কিছু কথা” – তাঁর লেখা গানের ব্যাখ্যা ও সৃষ্টির প্রেক্ষাপট নিয়ে লেখা।
- “ঝড়ের রাতের পাখি” – তাঁর একমাত্র কাব্যগ্রন্থ।
- “বাংলা গানের পথ চলা” – বাংলা গানের ইতিহাস ও বিবর্তন নিয়ে লেখা।
- “অকিঞ্চনের কড়চা” – বাংলা গানের সাহিত্য ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা বই।
শেষ জীবন ও মৃত্যুবরণ
জীবনের শেষভাগে বার্ধক্যজনিত নানা অসুখে ভুগছিলেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০২২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সকালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তাঁর মৃত্যুর পরও তাঁর সৃষ্টি আজও বেঁচে আছে এবং শ্রোতাদের মনে অমর হয়ে আছে। তাঁর দুই পুত্র অমিত ও অভিষেক এবং এক কন্যা মহাশ্বেতা সকলেই সঙ্গীতের সাথে যুক্ত রয়েছেন। তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র অগ্নিভ বন্দ্যোপাধ্যায়ও একজন প্রতিভাবান সঙ্গীতশিল্পী।
অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা গানের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর সুরের মাধুর্য, গানের গাঁথুনি এবং সঙ্গীতের প্রতি তাঁর নিষ্ঠা বাংলা গানের জগতে এক বিশাল অবদান রেখে গেছে। তাঁর সৃষ্টি আজও শ্রোতাদের হৃদয়ে অমলিন।
“সেই তানপুরা আছে, ছিঁড়ে গেছে তার”—এই গানের লাইনটি যেন তাঁর সঙ্গীতজীবনেরই এক প্রতিচ্ছবি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, তাঁর তানপুরার তার ছিঁড়ে যায়নি; বরং বাংলা গানের মাটিতে তাঁর সৃষ্টি আজও অনুরণিত হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে।