হোলি ভারতে রঙিন উৎসব, এই উৎসবে লোকেরা নানা রকমের রঙের গুঁড়ো ছুঁড়ে, পানি ছিটিয়ে আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে বসন্তের আগমনকে উদযাপিত করে। হোলি ঐতিহ্যগতভাবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের হতে পারে, কিন্তু এই হোলির উৎসবে সবাই সমান। হোলির রঙের আড়ালে জাত, গোত্র, শ্রেণী, এবং বর্ণ প্রথা ঢাকা পরে, সকলেই রঙ মেখে আনন্দে মেতে ওঠে।
হোলির নাচ এবং রঙিন রঙের বিশৃঙ্খলার আড়ালে রয়েছে অনন্য সংস্কৃতি এবং প্রথাগত ঐতিহ্য। হোলি সম্পর্কে জানা অজানা মজার তথ্য জানতে পড়তে থাকুন।
১. মজা তাড়াতাড়ি শুরু হয়
রঙিন উৎসব হোলির একটি মাত্র অংশ হলো রঙ। হোলির আগের রাতে, হোলিকা দহনের সন্ধ্যায়, ভক্তরা অসুর হোলিকার মৃত্যুকে স্মরণ করার জন্য একটি প্রতীকী মূর্তি জ্বালিয়ে দেয়। উৎসবের দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন রাংওয়ালি হোলিতে লোকেরা নানা রঙের রঙিন গুড়া নিক্ষেপ করে। লোকেরা রঙের গুড়া ক্রয় করে অনেক আগেই তা প্রস্তুত করে রাখে এবং শিশুরা আগ্রহের সাথে বড়দের অনুসরণ করে। ভারতের ব্রজ অঞ্চলে, হোলি উদযাপন ১৬ দিন ধরে চলে।
২. মন্দের উপর ভালোর জয়
হোলি নামটি হিন্দু পুরাণে দুষ্ট রাজা হিরণ্যকশ্যপের দানব বোন হোলিকা থেকে এসেছে। হোলিকা অগ্নি প্রতিরোধী ছিলেন, অর্থাৎ তিনি আগুনে পুরতেন না। গল্পের মতো, খলনায়ক রাজা হিরণ্যকশ্যপ তার পুত্র প্রহ্লাদকে হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর পূজা করতে নিষেধ করেছিলেন, কিন্তু প্রহ্লাদ তার পিতার আদেশ অমান্য করে আপন ইচ্ছায় অটল ছিলেন। তাই রাজা হিরণ্যকশ্যপ তার পুত্র প্রহ্লাদ এবং হোলিকাকে একটি জলন্ত চিতার উপর বসতে আদেশ দেন। জলন্ত আগুনের চিতায় হোলিকা তার অগ্নি প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান, এবং অলৌকিকভাবে প্রহ্লাদ বিজয়ী হন কারণ তিনি ভগবান বিষ্ণুর সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। তাই হোলি উদযাপন মন্দের উপর ভালোর বিজয়ের একটি অনুস্মারক হিসাবে কাজ করে, হিন্দু ধর্মের বিশ্বাসকে প্রতিফলিত করে যে বিশ্বাস এবং ভক্তি পরিত্রাণের দিকে নিয়ে যায় যা বিশ্বাসী প্রত্যেকেই অর্জন করতে পারে।
৩. খাবার প্রস্তুত করা
ভারত জুড়ে হলি উপলক্ষ্যে পরিবারগুলি মমতার সাথে গুজিয়া তৈরি করে, একটি এক ধরণের মিষ্টান্ন তৈরী করে যা এলাচ, শুকনো ফল এবং বাদাম দিয়ে ভরা। এখাবার বৈচিত্রময়, তবে সাধারণ মিষ্টান্নের মধ্যে রয়েছে পেস্তা, কাজু, নারকেল এবং কিশমিশ, যা সবাই জ্বলন্ত হোলিকা দহনের সময় উপভোগ করে।
৪. গাঁজা দুধ
কেউ কেউ ভাং দিয়ে হোলি উদযাপন করে- হিমালয়ের উঁচুতে জন্মানো গাঁজার কুঁড়ি এবং পাতা পিষে তার সাথে দুধ মিশ্রিত করে তৈরী করে এক প্রকারের দুধের পানীয়। প্রায় ৩,০০০ বছর ধরে প্রচলিত এই গাঁজা মিল্কশেক। পৌরাণিক কাহিনীর বর্ণনায় এই পানীয় সেবন করলে দেবতা শিবের সাথে সংযোগ স্থাপন করা যায়। সরকার পরিচালিত দোকানে ভাং বিক্রি হয়।
৫. রঙ কেন?
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে একটি রাক্ষস দ্বারা নীল চামড়ার অভিশাপ প্রাপ্ত হওয়ার পর, কৃষ্ণ চিন্তিত হয়েছিলেন যে তার ফর্সা চামড়ার স্ত্রী রাধা তাকে আর ভালোবাসবে না। চিন্তিত কৃষ্ণ তার মা যশোদার কাছে আক্ষেপ করেছিলেন, তখন বিরক্ত হয়ে যশোদা উত্তর দিয়েছিলেন যে কৃষ্ণ যেন রাধার মুখে রঙ লেপন করে, তা যে রঙই হোক না কেন। যশোদার কথা অনুযায়ী কৃষ্ণ রাধার মুখে রঙ লেপন করেছিলেন। উড়ন্ত বহুমুখী কঙ, যাকে বলা হয় গুলাল, এই রঙ কৃষ্ণের গল্পের কথা মনে করিয়ে দেয়।
৬. প্রাকৃতিক শিকড়, আধুনিকীকৃত
আগের দিনে, গুলাল তৈরি করা হতো ফুল, মশলা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক উপকরণ যেমন উজ্জ্বল ভারতীয় কোরাল ট্রি এবং দ্য ফ্লেম অফ দ্য ফরেস্ট গাছপালা, যা ত্বকের জন্য ঔষধি গুণাবলী এবং উপকারিতা প্রদান করে। ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে সিন্থেটিক রং ব্যবহার সাধারণ হয়ে ওঠে। আজ, হোলির সময় ব্যবহৃত বেশিরভাগ গুলাল চীন থেকে আমদানী করা কৃত্রিম রঙ। ২০১২ সালে, প্রায় ২০০ জন মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল রঙের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে।
৭. অর্থপূর্ণ রং
একটি সুন্দর ছবি আঁকাতে রঙ বিশেষ তাত্পর্য রাখে। লাল রং প্রেম, উর্বরতা এবং বিবাহের প্রতীক। নীল কৃষ্ণের প্রতিনিধিত্ব করে, আর সবুজ মানে নতুন শুরু।
৮. পরিষ্কার করা
বিপর্যয় এড়াতে, হিন্দুদের চুল এবং ত্বককে ভালভাবে ময়শ্চারাইজ করার পরামর্শ দেওয়া হয় যাতে গুলাল থেকে দাগ পড়া এড়িয়ে যাওয়া যায়।
৯. উৎসবে যোগদান
হোলি ভারত উপ-মহাদেশের বাইরেও উদযাপিত হয়। হিন্দুরা বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানে উদযাপন করে, পাশাপাশি অন্যান্য দেশগুলিতে, যেমন সুরিনাম, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং মালয়েশিয়ায় উদযাপিত হয়, কারণ সেখানকার প্রবাসীদের একটি বড় অংশ ভারতীয়। যুক্তরাজ্য, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সারা দেশে নানা রকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, যার ফলে অনেকের পক্ষেই উৎসবে যোগদান করা সম্ভব হয়।