বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় গুলিস্তান এলাকার কাছে সিদ্দিক বাজারে একটি বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৯ হয়েছে। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
মঙ্গলবার বিকাল পৌনে পাঁচটার দিকে ঢাকার নর্থ সাউথ রোডের সিদ্দিক বাজারে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে আরও দুটি বহুতল ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বহু আহত ব্যক্তিকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের ১১টি টিম উদ্ধার কাজ করেছে। ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে সেনাবাহিনী এবং পুলিশের সদস্যরাও কাজ করছে।
ধ্বংসস্তুপের নীচে আর আটকে পড়াদের খোঁজে গুরুত্ব দিয়ে তল্লাশি কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মোঃ মাইন উদ্দিন ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেছেন, ”ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। বেজমেন্ট এবং গ্রাউন্ড ফ্লোরটি অনেকটা ধসে গিয়েছে, কলামগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ”
বিস্ফোরণের কারণ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ”আমরা এখানকার মালিক সমিতির সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলেছেন, নীচে কোন গ্যাসের লাইন ছিল না। তবে পানির লাইন ও রিজার্ভার ছিল। এই কারণে আমরা এখনি বিস্ফোরণের কারণ বলতে পারছি না। পুলিশ, সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞরা কাজ করছে। তাদের সাথে মিলে তদন্ত করে আমরা সিদ্ধান্ত জানাবো, সেজন্য একটু সময় লাগবে।”
তিনি জানিয়েছেন, বিস্ফোরণের সময় মার্কেটটি চালু থাকায় ভেতরে আরও মানুষ আটকা পড়ে থাকতে পারে বলে তারা আশঙ্কা করছেন। কিন্তু কতজন থাকতে পারে, সেই ধারণা তারা করতে পারছেন না। ভবনটি স্থিতিশীল করে উদ্ধার অভিযান চালানো হবে।
বিস্ফোরণে সড়কের ওপরে থাকা একটি যাত্রীবাহী বাসের একপাশে আঘাত করলে জানালার সব কাঁচ ভেঙ্গে যায় এবং যাত্রীদের অনেকে আহত হন।
এছাড়া ভবনটির সামনে থাকা বেশ কয়েকটি ভ্যান ও রিকশার চালক ও যাত্রীসহ অনেক পথচারী আহত হয়েছে।
ভবনটির বেসমেন্ট, প্রথম ও দ্বিতীয় তলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে। ভবনের প্রথম ও দ্বিতীয় তলার ছাদ ধসে বেসমেন্টের ওপর পড়েছে। সেখানে এখনো মানুষজন আটকে থাকে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিকালে সেখানে ফ্লোরগুলো কেটে উদ্ধার অভিযান শুরু করেছিল ফায়ার সার্ভিস ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা। তবে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠায় রাতে ওপরের তলাগুলোয় উদ্ধার অভিযান চালানো হয়।
নর্থসাউথ রোডের ১৮০/১ ভবনটি ক্যাফে কুইন ভবন নামেও পরিচিত। কারণ এই ভবনের দোতলায় ক্যাফে কুইন নামে একটি রেস্তোরা আছে। নীচতলায় বেশিরভাগই স্যানিটারি আর গৃহস্থালী সামগ্রীর দোকান।
এছাড়া ভবনটির ওপরের তলাগুলোয় কয়েকটি অফিস এবং আবাসিক ফ্ল্যাট ছিল বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
বিস্ফোরণের সময় রাস্তার থাকা একটি যাত্রীবাহী বাসের একাংশের কাঁচের জানালা উড়ে গেছে। এছাড়া রাস্তার পাশে বেশ কিছু ভ্যান অপেক্ষা করছিল। বিস্ফোরণের ফলে অনেক ভ্যান চালকও আহত হয়েছে ।
এই বিস্ফোরণের পর সেখানে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছে। যে ভবনটিতে বিস্ফোরণ হয়েছে সেখানে একটি টাইলস ও স্যানিটারি দোকান ছিল। এছাড়া আশেপাশে একটি ব্যাংকসহ আরো বেশ কিছু টাইলস ও স্যানেটারি দোকান রয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেছেন, এখনো কারণ জানা না গেলেও এই বিস্ফোরণের সঙ্গে তারা ২০২১ সালের জুন মাসে মগবাজারের বিস্ফোরণের মিল দেখতে পাচ্ছেন।
বিস্ফোরণের ঘটনার পর থেকে পুরনো ঢাকার সিদ্দিক বাজার, নয়াবাজার, নর্থসাউথ রোড এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়। আশেপাশের বেশ কয়েকটি সড়কে ব্যাপক যানজটের তৈরি হয়।
ঢাকা মেডিকলে কলেজ হাসপাতালের হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ নাজমুল হক বলেছেন, ” আমাদের হাসপাতালে অন্তত ১২০ জনকে এখন পর্যন্ত চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। এখনো অনেক আহত মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসছেন।”
হাসপাতালের সকল চিকিৎসককে জরুরি তলব করা হয়েছে। তিনি আশঙ্কা করছেন, মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
কেন কীভাবে বিস্ফোরণ হয়েছে, তা তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে পারেননি ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। উদ্ধার কাজের পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের টিম ঘটনাস্থলে তদন্ত করছে।
প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা
বিস্ফোরণের একজন প্রত্যক্ষদর্শী একজন ব্যক্তি সাংবাদিকদের বলেছেন, ”আমি পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দ শুনে বিল্ডিংয়ের সামনে এসে দেখি, বিল্ডিং থেকে প্রচণ্ড ধোয়া উড়ছে।”
”সেখানকার ইট, কাঠ ছিটকে এসে সামনে যারা ছিল, তাদের গায়ে পড়েছে, কেউ কেউ চাপা পড়েছে। বিল্ডিংয়ের সামনে কয়েকটা ভ্যান ছিল, সেগুলোর কয়েকজন চালক দেয়ালের নীচে চাপা পড়েছে। সামনের রাস্তায় একটা বাস জ্যামে দাঁড়িয়েছিল, সেই বাসটির এই পাশের সবগুলো কাঁচ ভেঙ্গে পড়েছে। বাসে যারা ছিল, তাদেরও অনেকে আহত হয়েছে।”
”আমি দেখি, বিল্ডিংয়ের সামনে অনেকে আহত হয়ে পড়ে আছে, তাদের রক্ত পড়ছে। এমনকি বিল্ডিংয়ের নীচের একটা কলাপসিবল গেটও উড়ে সামনের লোকজনের গায়ে পড়েছে। সেটার আঘাতেও অনেকে আহত হয়েছে।”
গত রবিবার ঢাকার সায়েন্স ল্যাব এলাকায় এরকম একটি বিস্ফোরণে তিনজন নিহত আর অন্তত ১৪ জন আহত হয়েছিল। শনিবার চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে একটি অক্সিজেন কারখানায় বিস্ফোরণে অন্তত ছয়জন নিহত হয়েছিল।
বাংলাদেশে গত এক মাসের মধ্যে ঢাকা ও বিভিন্ন জায়গায় একাধিক বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার বাইরেও বিগত কয়েক বছরে বড় ধরণের বিস্ফোরণের খবর গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। তবে সবকটি বিস্ফোরণের ক্ষেত্রে ‘জমে থাকা গ্যাসের’ বিষয়টিকে দায়ী করা হচ্ছে।
এর মধ্যে কয়েকটির দুর্ঘটনার তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। যে কটির তদন্ত প্রতিবেদন সামনে এসেছে সেখানে বিস্ফোরণের পেছনে মূলত দায়ী করা হয়েছে ভবন বা প্রতিষ্ঠানের মালিককে।
ঘটনার তদন্তে কর্তৃপক্ষের অবহেলা প্রকাশ্যে এলেও তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। বেশিরভাগ সময় দায় চাপিয়ে দেয়া হয় ভবন মালিকের উপর।
ফায়ার সার্ভিসের বলছে, জনগণের অসচেতনতার কারণেই বার বার এ ধরণের ঘটনা ঘটছে। দুর্ঘটনার আগে প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
সিদ্দিক বাজারের এই ঘটনার সঙ্গে ২০২১ সালের ২৭শে জুন মগবাজারে বিস্ফোরণের সাথে মিল রয়েছে।
ওই ঘটনায় ভবনের নীচতলায় কোনও গ্যাস সংযোগ পাওয়া যায়নি, গ্যাস সিলিন্ডারও অক্ষত ছিল৷ সেসময় বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, তারা সেখানে মিথেন গ্যাসের গন্ধ পেয়েছেন যা পয়ঃনিষ্কাশন লাইন থেকে লিক হতে পারে।