অনিন্দিতা পাল ১৯৭৯ সালে ভারতের অসম রাজ্যের গুয়াহাটিতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন বাঙালি পরিবারে জন্ম নেন। তার পিতা অমল কান্তি পাল ফুড কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়ার চুক্তি ও নজরদারি বিভাগে কর্মরত ছিলেন এবং তার মা শ্যামলী পাল ছিলেন একজন সঙ্গীতপ্রেমী গৃহিণী।
সঙ্গীতের প্রতি আকর্ষণ ও শিক্ষা
শৈশব থেকেই সঙ্গীতের প্রতি অনিন্দিতার গভীর অনুরাগ ছিল। তার মা কলেজ জীবনে গান গাইতেন এবং তিনিই কন্যার সঙ্গীতচর্চার প্রথম অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠেন। তিনি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে বিশেষজ্ঞতা অর্জন করেন এবং লখনউয়ের ভাটখণ্ডে সঙ্গীত ইনস্টিটিউটের সাথে যুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ‘বিশারদ’ ডিগ্রি লাভ করেন। গুয়াহাটিতে দ্বীপেন রায়ের কাছে সঙ্গীতের প্রাথমিক পাঠ নেয়ার পর, তিনি কলকাতায় গিয়ে প্রখ্যাত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর কাছে তালিম নেন।
সঙ্গীতজীবনের সূচনা
অনিন্দিতা প্রথমে বিভিন্ন মঞ্চে গান গাওয়ার মাধ্যমে তার ক্যারিয়ার শুরু করেন। খুব শীঘ্রই তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিও গুয়াহাটির একজন গ্রেডেড শিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি পান। প্রথম দিকে তার পিতা গানের পেশাকে অনুপ্রাণিত না করলেও, কন্যার নিষ্ঠা দেখে তিনি পরে তাকে সম্পূর্ণ সমর্থন দেন।
প্রথম অ্যালবাম ও জনপ্রিয়তা
২০০০ সালে তার প্রথম অসমীয়া অ্যালবাম ‘বিলত তিৰে বিৰাই পদুমৰ পাহি’ প্রকাশিত হয়। এই অ্যালবামের গানের কথা লিখেছিলেন অসমীয়া কবি কমলানন্দ ভট্টাচার্য (বাউলী কবি)। অনিন্দিতা এই অ্যালবামের তিনটি গান গেয়েছিলেন, যার মধ্যে শিরোনাম গানটি বিশেষভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে।
বলিউড ও অন্যান্য ভাষার গান
২০০১ সালে অনিন্দিতা বলিউড সঙ্গীত জগতে পা রাখেন। তিনি জুবিন গার্গ এবং সাগরিকা মুখার্জীর সঙ্গে ‘কাইসা ধোঁয়া উঠ রহা হ্যায়’ গানটি গেয়েছিলেন, যা জুবিনের অ্যালবাম ‘নূপুর’-এ প্রকাশিত হয়েছিল।
একক অ্যালবাম ও আধুনিক গান
২০১০ সালে তিনি ‘তুমার প্রশংসত’ শীর্ষক তার একক অ্যালবাম প্রকাশ করেন, যার নামকরণ করেছিলেন প্রখ্যাত কবি হিরেন ভট্টাচার্য। এই অ্যালবামে মূলত আধুনিক অসমীয়া গান ছিল, যার মধ্যে কিছু গান ব্যালাড, আর অ্যান্ড বি ও পপ-রক ঘরানার সংমিশ্রণে তৈরি করা হয়েছিল।
চলচ্চিত্র জগতে গান
অসমীয়া চলচ্চিত্রের একজন প্রতিষ্ঠিত প্লেব্যাক গায়িকা হিসেবে তিনি বেশ কিছু জনপ্রিয় গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। ২০০২ সালে ‘প্রেম আৰু প্রেম’ চলচ্চিত্রে জুবিন গার্গের সুরে প্রথমবার প্লেব্যাক গান করেন। এরপর ‘দীনবন্ধু’ (২০০৪), ‘সেনাই মোর ঢুলীয়া’ (২০০৫), ‘অধিনায়ক’ (২০০৬), ‘জেতুকা পাতর দরে’ (২০১১), ‘রাগ’ (২০১৪), ‘গানে কি আনে’ (২০১৬)-সহ বহু সিনেমায় তিনি গান গেয়েছেন।
বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্র
বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রেও তার উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি রয়েছে। তিনি ‘কাছের আছো তুমি’ (২০১২) ও ‘মন নিয়ে’ (২০১০) নামক বাংলা চলচ্চিত্রে গান গেয়েছেন। তিনি হিন্দি চলচ্চিত্র ‘স্ট্রিংস’, দ্বিভাষিক (হিন্দি-অসমীয়া) সিনেমা ‘এখন নেদেখা নদীৰ সিপাৰে’, এবং কিংবদন্তি সঙ্গীত পরিচালক রবীন্দ্র জৈনের সুরারোপিত ‘কুমাওনের কন্যা’-তে কণ্ঠ দিয়েছেন।
বিজ্ঞাপন ও অন্যান্য মাধ্যম
অনিন্দিতা পল বিজ্ঞাপন জগতেও জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী। তিনি Fair & Lovely, Action Flotter, Nerolac Paints, Herbalife-এর মতো ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপনের জন্য জিঙ্গেল গেয়েছেন। পাকিস্তানের Care Honey Lotion বিজ্ঞাপনেও তার গান শোনা যায়।
পুরস্কার ও সম্মাননা
তার প্রতিভার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি বহু পুরস্কার অর্জন করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
- ২০০৪: ‘কোর একজাক স্বপ্ন যেন বরষুণ’ (দীনবন্ধু) গানের জন্য Jyotirupa Media Award শ্রেষ্ঠ মহিলা প্লেব্যাক গায়িকা বিভাগে
- ২০০৫: একই গানের জন্য Prag Cine Award শ্রেষ্ঠ মহিলা প্লেব্যাক গায়িকা বিভাগে
- ২০১০: ‘বিপল সোকুপানিরে’ (জেতুকা পাতর দরে) গানের জন্য Prag Cine Award
- ২০১৪: ‘রাগ’ চলচ্চিত্রের জন্য Prag Cine Award শ্রেষ্ঠ মহিলা প্লেব্যাক গায়িকা বিভাগে
- ২০১৫: ‘রাগ’ চলচ্চিত্রের জন্য Assam State Award শ্রেষ্ঠ মহিলা প্লেব্যাক গায়িকা বিভাগে
ব্যক্তিগত জীবন
অনিন্দিতা পলের স্বামী দিব্যজ্যোতি নাথ এবং তাদের একটি কন্যাসন্তান রয়েছে। তিনি বর্তমানে মুম্বাইয়ে বসবাস করছেন এবং সঙ্গীত চর্চার পাশাপাশি বিভিন্ন লাইভ পারফরম্যান্সে অংশ নিচ্ছেন।
অনিন্দিতা পাল অসমীয়া, বাংলা এবং হিন্দি সঙ্গীত জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার সুমধুর কণ্ঠ, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে পারদর্শিতা এবং বহুমুখী প্রতিভার মাধ্যমে তিনি সংগীতপ্রেমীদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। তার সংগীত জীবনের প্রতিটি অধ্যায় নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।