আমুদে মানুষ হিসেবে আলি মিয়ার খুব সুখ্যাতি এলাকায়। তিনি পাড়ার তালপুকুরের ঘাটলার বেঞ্চিতে ব’সে মজার-মজার গল্প বলতেন, আর পাড়া-প্রতিবেশীরা সাগ্রহে তা নিয়মিত ভীড় জমিয়ে শুনতো। আলি মিয়ার প্রথম সন্তান পুত্র, নাম নূরুল। নূরুলের পরে একে-একে তার ছয়টি কন্যার জন্ম হয়। সন্তানের সংখ্যা দাঁড়ায় সাত-এ। পৈত্রিক জমিজিরেত বেশ ভালোই ছিল। আলি মিয়াও তার পিতামাতার একমাত্র পুত্র ছিলেন। তাই পিতামাতার বড় আহ্লাদে বড় হয়েছিলেন। এজন্য নিজের ঘর-সংসার হবার পর তিনি অর্থোপার্জনের নিমিত্তে কোনো কঠিন বা কষ্টের কাজের দিকে না গিয়ে পৈত্রিক জমি একটু-একটু বিক্রি ক’রে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন।
জমি কমতে-কমতে একসময় বিক্রি করার মতো জমি আলি মিয়ার আর অবশিষ্ট রইলো না। পরিবারে নয়জন মানুষ। অথচ তাদের মুখে অন্ন তুলে দেবার, পরনে বস্ত্র দেবার তেমন কোনো উপায় নাই তার। কী করবেন আলি মিয়া? ছেলেমেয়েদের নিয়ে কি অবশেষে না খেয়ে মারা যাবেন? হঠাৎ একটা বুদ্ধি এলো তার মাথায়! কিছু যৌতুক নিয়ে পুত্র নূরুলের বিয়ে দিয়ে সে-টাকায় নূরুলকে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো একটি দেশে উপার্জনের জন্য পাঠিয়ে দিলেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায় এক নিমেষেই! তার স্ত্রীকে এমন সুবুদ্ধিটির কথা জানাতেই তিনি আনন্দের সঙ্গে বললেন, বাঃ! অতি উত্তম চিন্তা এসেছে তো তোমার মাথায়!
এমন উত্তম চিন্তার বাস্তব রূপ দিতে নূরুলের জন্য মেয়ে খোঁজা শুরু হয়ে গেলো। নূরুলের বয়স তখন সতের। শ্যামল গায়ের রঙ। লিকলিকে লম্বা। মিষ্টি চেহারা। স্বভাবে ভদ্র। অল্পদিনের মধ্যে একটি উপযুক্ত মেয়ের সন্ধান পাওয়া গেলো। ভালো অঙ্কের যৌতুক দেবে ওরা। শাড়ি-গয়না দিয়ে বিয়ের দিন মেয়েকে সাজিয়ে দেবে। বরযাত্রীও খাওয়াবে কয়েকশ। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা ব’লে কথা! মেয়েটি বয়সে নূরুলের বছর দু’য়েক বড়। কিন্তু তা কোনো ব্যাপার না। এতোগুলো টাকা দেবে যৌতুক। গয়না দেবে, বরযাত্রী খাওয়াবে। বয়স একটু বেশি হ’লে অসুবিধা কী? বিয়ের দিন ধার্য হলো। নির্ধারিত দিনে নূরুলকে পায়জামা-পাঞ্জাবী পরিয়ে বর সাজানো হলো। মুখে রুমাল চেপে ঠোঁটের কোণের লাজুক হাসি গোপন ক’রে সতের বছরের কিশোর নূরুল দুইশ বরযাত্রী সহযোগে বিবাহ করবার উদ্দেশ্যে ভাবী শ্বশুরবাড়ির দিকে যাত্রা করলো।
বিয়ের অনুষ্ঠানাদি ভালোভাবেই নিষ্পন্ন হলো। নূরুল বৌ নিয়ে বীরের মতো বাড়ি ফেরে এলো। খুব আনন্দে বৌয়ের সঙ্গে নূরুলের দিন কাটতে লাগলো। সম্বন্ধ ক’রে ওদের বিয়ে হয়েছে। বিয়ের আগে প্রেম, এমনকি পরিচয়ও ছিল না। তবুও বিয়ের দিন থেকেই ওদের দু’জনার মনে হয়, ওদের যেন জন্ম-জন্মান্তরের প্রেম ও চেনাশোনা। কয়েক মাস পরে সৌদি আরবের ভিসা হয় নূরুলের। নূরুল সৌদি আরবে চ’লে যায়। বিদায়ের সময় বৌ ও নূরুলের বুকভাঙা কান্না। দূরে যেতে নাহি চায় একজনারও মন। কিন্তু উপায় কী? জীবনের নিয়ম বড় নিষ্ঠুর। প্রাণের মানুষ ফেলে দূরে চ’লে যেতে হয় জীবন ও জীবিকার জন্য। ফোঁপাতে-ফোঁপাতে, নাক-চোখের একাকার জল রুমালে মুছতে-মুছতে নূরুল বাড়ি থেকে বিদায় নেয়। স্যুটকেসের ভেতরে ভ’রে সঙ্গে নিয়ে যায় বৌয়ের চুল মোছার একটি গামছা, ব্যবহৃত দুটি ব্লাউজ; ওর কথা মনে হ’লে যেনো ছুঁয়ে দেখতে পারে। আর মাথায় ক’রে নিয়ে যায় বাবা-মা, ছয়টি বোন, একটি বৌ–মোট নয়জনের অন্ন-বস্ত্রের সংস্থানের দায়িত্ব।
যতক্ষণ নূরুলের রিকশা দেখা যায়, বৌ ছুটে যেতে চায় বারবার। কয়েকজন মিলে ধ’রে রাখে ওকে। রিকশা অদৃশ্য হয়ে গেলে উঠোনে লুটিয়ে পড়ে। বুক চাপড়াতে থাকে, ধূলায় গড়াগড়ি খেতে-খেতে বিলাপ করতে থাকে, আমারে ফালাইয়া যাইয়ো না, আমারে ফালাইয়া যাইয়ো না। হাসিখুশি বৌটি ক্রন্দসী হয়ে যায়। ভাত রান্না করার সময় কাঁদে, গোসল করতে গিয়ে কাঁদে, ঘর ঝাঁট দিতে-দিতে কাঁদে। কান্নাই ওর জীবনের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায়। নূরুলের রেখে-যাওয়া ব্যবহৃত কিছু লুঙ্গি গেঞ্জি ও শার্ট বুকে জড়িয়ে ধ’রে কাঁদে। ঘুমানোর সময় নূরুলের কাপড়-চোপর বুকে নিয়ে ঘুমায়। দাদি নানি সম্পর্কের কাউকে পেলে নূরুলের লুঙ্গি গেঞ্জি শার্ট এনে দেখিয়ে বলে, দাদি গো, নানি গো, দেখেন, এইগুলান থেকে আপনার নাতির গায়ের ঘেরান আসে। নূরুলের চিঠি এলে বৌ চিঠি বুকে নিয়ে কাঁদে। বলে, তোমার চিঠি আইছে, তুমি ক্যান আইলা না?
আলি মিয়া ও তার স্ত্রী বলেন, এমন লজ্জাহীন বৌ তো আমরা জীবনে দেখি নি। জামাই গেছে বিদেশে উপার্জন করতে। এতে এতো কান্নার কী আছে? লাজ-শরম ব’লে কি কিছু নাই? বৌয়ের তো লজ্জা নাই, মাঝখান থেকে আমাদেরই মান-সম্মান যাচ্ছে। লোকে বলবে কী? সমাজে আমাদের ইজ্জত ব’লে আর কিছু কি থাকবে? কতো মেয়ের বরই তো বিদেশে উপার্জন করতে যায়। আর কেউ কি এমন করে? পাড়া-প্রতিবেশীদের কেউ-কেউ বলে, কী বেশরম বৌ রে, বাবা! আর কেউ-কেউ বলে, বরকে বড্ড ভালোবাসে বেচারি, তাই অমন আকুল হয়ে কাঁদে।
দিনে-দিনে আরো কিছু ভয়াবহ দোষের কথা শোনা যায় বৌয়ের। বৌ ভাত বেশি খায়। চুরি ক’রে খাবার খায়। কোনো পিঠা বানানো হলে কয়েকটা লুকিয়ে রাখে, পরে বের ক’রে খায়। একদিন ভোর রাতে রান্নাঘরের দরজার আওয়াজ পেয়ে আলি মিয়া ও তার স্ত্রী চুপিসারে উঠে গিয়ে দেখে, বৌ তার ভাইকে নিয়ে ঘরে ঢুকছে। আলি মিয়া অগ্নিশর্মা হয়ে বলেন, হারামজাদী, তুই রাতের বেলায় কোথায় কী কুকাম করতে গিয়েছিলি? বৌ ভয়ে কাঁদে। বলে, আব্বা, আমার মায়ের খুব অসুখ। আপনাদের কাছে অনুমতি চেয়েছিলাম, মাকে দেখতে যেতে। আপনারা যেতে দেন নি। মাঝরাতে আপনাদের অজান্তে আমার ভাই আসে আমায় মাকে দেখতে নিয়ে যেতে।
মাকে দেখে ভোর হবার আগে আমি ফিরে এসেছি যাতে আপনারা টের না পান। আলি মিয়ার রাগ সব শুনে আরো বেড়ে যায়। স্বামী-স্ত্রী দু’জনে মিলে দ্বৈতকণ্ঠে বৌকে গালি দিতে থাকেন। বৌ ক্রুদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ি দু’জনের পায়ে ধরে। বলে, মাফ ক’রে দেন, আব্বা; মাফ ক’রে দেন, আম্মা। এমন অন্যায় আর কোনোদিন করবো না। বৌয়ের অপরাধী ভাইও তালুই মাউইয়ের পায়ে ধ’রে মাফ চায়। তাতে আলি মিয়া ও তার স্ত্রীর ক্রোধ আরো বাড়তে থাকে। তারা তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধানের কথা ঘোষণা করেন– এই চুরি ক’রে খাবার খাওয়া চোর বৌ, ভাত বেশি খাওয়া রাক্ষস বৌ, জামাইর জন্য কান্না করা লজ্জাহীন বৌ আমরা আর রাখবো না। একে তালাক দিয়ে তাড়িয়ে দেবো।
দিনের আলো ফোটে। পড়াপ্রতিবেশীরা সব জানতে পায়। কেউ-কেউ বলে, বৌ কেন ভাত বেশি খাবে? সবার খাওয়া শেষ হলে যদি উচ্ছিষ্ট কিছু কপালে জোটে তো খাবে, নইলে নাই। পিঠা লুকিয়ে রেখে পরে খায়? ছি ছি! চোরের জন্ম নাকি? রাতের আঁধারে ভাইয়ের সঙ্গে বাপের বাড়ি গেছে! ছি ছি! কী দুশ্চরিত্র! আবার কেউ-কেউ বলে, বৌটা সারাদিন এতো কাজ করে। খিদা লাগে না ওর? ভাত একটু বেশি খেলে অসুবিধা কী? বৌয়ের বাপের বাড়ির টাকাতেই তো ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়েছ! বৌয়ের ভাত খাওয়াটাও এখন সহ্য করতে পারছ না? বৌকে ভাইয়ের সঙ্গে রাতের আঁধারে গোপনে কেন বাপের বাড়ি যেতে হলো তার অসুস্থ মাকে দেখতে? ওর মা অসুস্থ শুনেও তোমরা কেন ওকে যেতে দিলে না? মা অসুস্থ না হলেও বাপের বাড়িতে কি বেড়াতে যেতে পারে না? বেচারি সারাদিন জামাইর জন্য কাঁদে, মনমরা হয়ে থাকে। বাপের বাড়ি থেকে কয়েকদিন বেড়িয়ে এলে মনটা একটু ভাল হতো। তোমরা যেতে দিলে না কেন?
যে যা বলুক। আলি মিয়া ও তার স্ত্রী তাদের সিদ্ধান্তে অটল। এই বৌকে তালাক দেবেনই দেবেন। প্রতিবেশীরা বলে, কিন্তু নূরুল কি তালাক দেবে বৌকে? ও যে বৌকে অনেক ভালোবাসে! আলি মিয়া বলেন, বাপের কথা ওপরে, নাকি ছেলের কথা ওপরে? বাপ বড়, নাকি ছেলে বড়? ছেলে আমার কথায় তালাক না দিলে ওকে আমি ত্যাজ্যপুত্র করবো। তখন সবাই একবাক্যে বললো, বাপ বড় এবং বাপের কথাই ওপরে। নূরুলের কাছে বিস্তারিত জানিয়ে চিঠি লিখলেন আলি মিয়া।
সৌদি আরব থেকে পত্রপাঠ তালাক পাঠাতে আদেশ দিলেন। চিঠি পেয়ে নূরুল যেন সামনে কেয়ামত দেখতে পেলো। কী করবে? এমন প্রিয় মানুষটিকে কীভাবে তালাক দেবে? আবার যার বাপের টাকায় সে বিদেশে এসেছে, ভালো টাকা উপার্জন ক’রে দেশে বাবা-মা ও বোনদের মুখে অন্ন যোগাচ্ছে, তার সঙ্গে এমন বিশ্বাসঘাতকতা সে কীভাবে করবে? সৌদি আরবে কয়েকজন বাঙালি সহকর্মীকে জানালো ওর বিপদের কথা। ওরা বললো, বৌ গেলে বৌ পাবে, কিন্তু বাপ-মা গেলে আর পাবে না।
নূরুল বললো, তথাস্তু তবে। ও তালাকনামা পাঠিয়ে দিলো বিমানযোগে। তালাকের কাগজ বৌয়ের হাতে দিয়ে আলি মিয়া বললেন, দূর হ, হারামজাদী। বৌ হাউহাউ করে কাঁদে আর বলে, আব্বা, আপনাদের বাড়িতে আমি দাসী হয়ে থাকবো। আমি আর জীবনে কোনোদিন বাপের বাড়ি যাবো না। আর কোনোদিন ভাত খাবো না। আর কোনোদিন পিঠা খাবো না। আমাকে তাড়িয়ে দিয়েন না। আলি মিয়া বলেন, বের হ, নইলে লাথি দিয়ে ছাতি ভেঙে বের করবো। অনেক স্বপ্ন, অনেক আশা, অনেক ভালোবাসা নিয়ে এসেছিল ও ঘর করতে। আজ ভগ্ন হৃদয় ভগ্ন স্বপ্ন আর অপমান নিয়ে ফিরে গেলো।
এলাকার লোকজনের দেন-দরবারে দেনমোহরের কিছু টাকা বৌকে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন আলি মিয়া। পরবর্তীতে আলি মিয়া পুকুরের ঘাটলায় ব’সে রসিয়-রসিয়ে তার ছেলের তালাকের গল্প বলতেন। বয়ান করতেন, পিতা হিসেবে তিনি কতোটা সার্থক ও ভাগ্যবান, এবং পুত্র তার কতোটা বাধ্য, সেই বীরত্বগাথাও। বাপের এক কথায় যদি ছেলে তার বৌ তালাক না দেয়, তাহলে কীসের ছেলে? কীসের বাপ? শ্রোতারা সবাই মজা ক’রে শুনতো। সফলভাবে বৌ তালাক দেওয়াতে পারার জন্য আলি মিয়া যতোটা গর্বিতবোধ করতেন, তারচেয়ে বেশি বেদনাবোধ করতেন, দেনমোহরের টাকাটার জন্য। ইস রে, এতোগুলি পাঁচশ টাকার কচকচে নোট গুনে দিয়ে দিলাম! কলিজাটা ছিঁড়ে গেল আর কি!
একবছর পর নূরুল বাড়ি আসে। কেমন নির্জীব হয়ে গেছে যেন। মুখে কোনো হাসি নেই। সারাদিন উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক-ওদিক হাঁটাহাঁটি করে। কাউকে-কাউকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা, কাকি; আচ্ছা, দাদি, মানুষের অভিশাপ কি লাগে? কোথাও কোনো শান্তি নাই কেন? আমার ওপরে কি ওর অভিশাপ লেগেছে?
✍️এই নিবন্ধটি সাময়িকীর সুন্দর এবং সহজ জমা ফর্ম ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। আপনার লেখা জমাদিন!