সময়টা ২০২২ সালের মার্চ মাস। এক মাস আগে ভ্লাদিমির পুতিনের সেনারা ঝাঁপিয়ে পড়ে ইউক্রেনের ওপর। কীভাবে ছেলে আন্দ্রিকে সেনাবাহিনীতে যোগদান থেকে আটকে রেখেছিলেন, বসে বসে তা ভাবছেন মা লিউডমিলা বিকুস।
বিকুস বলেন, “আদ্রি আমাকে বলেছিল, ‘মা আমি না গেলে কে যাবে?’ সে দারুণ একজন মানুষ ছিল। অসাধারণ ছেলে, স্বামী, পিতা ও ভাই। সে তার দেশ ও পরিবারকে রক্ষা করতে চেয়েছিল।”
আন্দ্রিকে দ্রুত পূর্ব ফ্রন্টে পাঠানো হয়। তিন মাসেরও কম সময় পর তিনি মারা যান। ৬ জুন লিসিচানস্ক শহরের কাছে মারাত্মকভাবে আহত হন আন্দ্রি। একটি রুশ শেল তাদের অবস্থানের ওপর আঘাত হানে। হাসপাতালের অপারেশন টেবিলে রক্তক্ষরণেতার মৃত্যু হয়। ওই হামলার তার কোম্পানির ৮ জন নিহত হন।
সেপ্টেম্বরে আন্দ্রির স্ত্রী নাটালিয়া কিয়েভের একটি স্মৃতি উদ্যানে প্রয়াত স্বামীর নামসহ একটি নীল এবং হলুদ পতাকা লাগিয়েছিলেন। এতে লেখা ছিল, ‘অনন্ত স্মৃতি’। বেসরকারি এই জায়গাটি শহরের স্বাধীনতা চত্বর ময়দানে একটি ঘাসের ঢালে অবস্থিত। বৃহস্পতিবার বিকুস সেখানে গিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিল আন্দ্রির বোন অ্যালিওনা।
কিন্তু সেই পতাকা কই? শোকার্ত আত্মীয়দের রেখে যাওয়া শত শত নতুনের মাঝে এটি যেন হারিয়ে গেছে। রাশিয়ার হামলার নিহত সেনা, বেসামরিক ওস্বেচ্ছাসেবকদের নাম, স্থান, জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ লেখা রয়েছে এপিটাফে।
একটা এপিটাফে লেখা: ‘মারিউপোল থেকে আনিয়া’। আরেকটিতে লেখা: ‘রোমান স্টেটসিউরা, ৫৪ তম ব্রিগেড, বাখমুত’। এটির পাশে গাছের নিচে বসেএকটা কবুতর কী যেন খাচ্ছে।
বিকুস বলেন, ‘একটি পুরো তরুণ প্রজন্ম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। ছেলেরা ১৯-২০ বছর বয়সে মারা যাচ্ছে। তাদের কখনোই সন্তান বা নাতি-নাতনি থাকবে না।
আন্দ্রির বয়স ছিল ৩৪। কিয়েভের বারকোভেটস্কে কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়েছে। তার সাত বছর বয়সী ছেলে মিশা বাবার কফিনটি মাটিতে আলতোভাবে নামানোর সময় ছলছল চোখে তাকিয়ে ছিল।
বিকুস বলেন, ‘এখানে প্রতিদিন তিন থেকে চারটি শেষকৃত্য হয়।’
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোর ৪ টার দিকে বিস্ফোরণে কেঁপে উঠে ইউক্রেন। তখন অনেক পশ্চিমা রাজনীতিবিদের ধারণা ছিল, পুতিনের বাহিনী তিন দিনের মধ্যে ইউক্রেনের রাজধানী দখল করে ফেলবে।
আচমকা হামলার শিকার হলেও ঘাবড়ে যায়নি ইউক্রেনীয়রা। শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে তারা। আন্দ্রির মতো তরুণরা ধীরে ধীরে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে থাকে।
আসলে পুতিনের যুদ্ধ পরিকল্পনা কাজ করেনি। গত বসন্তে কিয়েভ অঞ্চল থেকে সেনাদের সরিয়ে নেন পুতিন। মাঝে অবশ্য বুচা শহরে যে বর্বরতা চালিয়ে রুশ সেনারা, তা ২১ শতকের অন্যতম জঘন্য অপরাধ হয়ে থাকবে ইতিহাসে।
শরতের শেষ দিকে খারকিভের উত্তর-পূর্ব অংশ এবং খেরসনের প্রশাসনিক রাজধানীসহ প্রাথমিকভাবে হারিয়ে যাওয়া অর্ধেক অঞ্চল পুনরুদ্ধার করে ইউক্রেনীয় বাহিনী। সেই থেকে যুদ্ধে রাশিয়া ধুঁকছে। বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত সেনা পাঠানো হচ্ছে ইউক্রেনে। আসলে পূর্ব ডনবাস অঞ্চলের পুরোটাই দখল করতে মরিয়া হয়ে আছেন পুতিন।
যুদ্ধের ভবিষ্যৎ এখনও অনিশ্চিত। বলা হচ্ছে, ১৯৪৫ সালের পর সবচেয়ে খারাপ পরিস্থির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ইউরোপ। দেশটির প্রসিকিউটরের মতে, গত বছর ৯ হাজার ৬৫৫ জন বেসামরিক মারা গেছে, যার মধ্যে ৪২১ জন ছিল শিশু। বাস্তুচ্যত হয়েছে ৪০ লাখ মানুষ।
এত ক্ষয়ক্ষতির পরও ঘাবড়ে যায়নি ইউক্রেনীয়রা। রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রায় পুরো জাতি বিজয় আশা করছে। সম্প্রতি এক জরিপে দেখা যায়, রাশিয়াকে হারানো সম্ভব বলছেন ৯৫ শতাংশ মানুষ। সেনাবাহিনীর প্রতি আস্থা রয়েছে দেশটির ৯৭ শতাংশের।
কিয়েভের বাসিন্দা আল্লা শস্তানা বলেন, ‘আমরা যে জিতব তা নিশ্চিত। কারণ আমরা জানি কেন যুদ্ধ করছি। রুশ সেনারা জানেই না তারা কেন যুদ্ধ করছে।’
১২ মাস আগে কিয়েভের ভেতরে অস্থিরতা আর আতঙ্ক ছিল। সময়ের সঙ্গে পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। অনেক বাসিন্দা রাজধানী ছেড়েছে, অন্যদিকে মারিউপোল এবং খারকিভ থেকে অনেকে কিয়েভে থিতু হচ্ছেন। রুশ বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত শহরে পরিণত হয়েছে মারিউপোল ও খারকিভ।
নিয়মিত হামলার পরও বিদ্যুৎ সরবরাহ কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতো অবস্থায় রয়েছে, ট্রেন নেটওয়ার্কও ঠিকঠাক আছে। কদিন আগেই কিয়েভ সফর করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
তারপরও ভয় কাটছে না। সময়ে সময়ে বিমান হামলার সাইরেন বেজে ওঠে। সোমবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন যখন কিয়েভের সেন্ট মাইকেলের সোনার গম্বুজযুক্ত ক্যাথেড্রালের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন তখনও বেজে ওঠেছিল সাইরেন।
কিয়েভে রাত ১১ টা থেকে কারফিউ থাকে। রাত সাড়ে ৯ টা নাগাদ ফাঁকা হয়ে যায় এক সময়ের ব্যস্ততম শহরটি।
কবে যুদ্ধ শেষ হবে, কেউ জানে না। একজন সাবেক সাংবাদিক এবং পার্লামেন্টের সেরহি লেশচেঙ্কো। এখন তিনি প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির চিফ অফ স্টাফ আন্দ্রি ইয়ারমাকের একজন উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইউক্রেন জিতেছে। আমরা একটি গণতান্ত্রিক সরকার নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকে আছি।’
লেশচেঙ্কো স্বীকার করে বলেন, এই জয়ের ধরন অনিশ্চিত। প্রশ্ন রয়েছে, জয়ের অর্থ কি ইউক্রেনের সীমানা পুনরুদ্ধার করা? নাকি ২০১৪ সালে রাশিয়ার দখল নেওয়া ক্রিমিয়াকেও ফিরে পাওয়া?
উভয় লক্ষ্য অর্জনে পৌঁছানোর ক্ষেত্রেই দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ অনিবার্য।
চলতি সপ্তাহে মস্কোতে পশ্চিমাদের আক্রমণ করে দেওয়া পুতিনের ভাষণের কথা উল্লেখ করে লেশচেঙ্কো বলেন, ‘আসলে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ হবে বলে মনে হচ্ছে। পুতিন বলেছিলেন, রাশিয়ার যুদ্ধ হলো নতুন বাস্তবতা। তিনি এতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তিনি বিরোধীদের দমন করতে, সেন্সরশিপ আরোপ করতে এবং ধনকুবেরদের ওপর নজরদারি চালাতে যুদ্ধকে ব্যবহার করতে পারেন। পুতিন মনে করছেন, ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমাদের সমর্থন ধীরে ধীরে কমে যাবে। এতে যুদ্ধে জয়ী হবে রাশিয়া।
এমনটি বাস্তবে ঘটবে কিনা তা সময় আসলে জানা যাবে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ থেকে যুদ্ধের ট্যাংক কিয়েভ আসার পথে রয়েছে। এগুলো আসার ইউক্রেনের সেনাবাহিনী পাল্টা আক্রমণ শুরু করতে পারে। সোমবার বাইডেন বর্ণনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ছাড়িয়ে যাওয়ার বিষয়ে ক্রেমলিনের বিশ্বাস ছিল ‘পুরোপুরি ভুল’। এক বছর আগে পুতিনও প্রত্যাশা করেছিলেন, আক্রমণকারী রুশ সেনাদের স্বাগত জানাবে ইউক্রেনীয়রা–প্রমাণ হয়েছে এটি ছিল একটি বিভ্রম।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান