রাতের পর রাত, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি উদ্দীপক ভিডিও বার্তা দিচ্ছেন, আক্রমণকারী রুশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিজ দেশের সেনাদের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছেন এবং চেষ্টা করছেন তার দেশের দুর্ভোগের প্রতি বিশ্বের মনোযোগ ধরে রাখতে।
পশ্চিমাদের কাছে অস্ত্রের জন্য লবিংয়ে সফল হয়েছেন, এই প্রক্রিয়ায় একের পর এক বাধা অপসারণ করেছেন তিনি। শুরুতে পশ্চিমারা প্রতিরোধের অস্ত্র দিয়েছে এবং খুব সম্প্রতি পশ্চিমারা যুদ্ধের ট্যাংক সরবরাহ করতে শুরু করেছে। যা ইউক্রেনকে পাল্টা আক্রমণ চালাতে সহযোগিতা করবে।
৪৫ বছর বয়সের জেলেনস্কি ২০১৯ সাল থেকে ক্ষমতায় রয়েছেন। কিন্তু যুদ্ধের প্রায় এক বছর হতে চললেও হার মানার কোনও ইঙ্গিত তিনি দিচ্ছেন না।
এমন কোনও ইঙ্গিত দিচ্ছেন না রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও। যিনি ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে তার ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরুর নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই পুতিন এখন একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
রুশ সেনারা যেদিন ইউক্রেনে হামলে পড়েছিল খুব কম মানুষই জেলেনস্কির এমন পরিবর্তন আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। ব্যাপক দুর্নীতি, আর্থিক অনিয়ম ও খারাপ শাসন ব্যবস্থার মধ্যে জনগণের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন সাবেক এই কৌতুক অভিনেতা।
রাশিয়া যখন সীমান্তে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল জেলেনস্কি বিদেশি দূতাবাস ও কোম্পানির সমালোচনা করেছেন তারা ইউক্রেন ছেড়ে যাওয়ার কারণে। তিনি বলেছেন, এতে অর্থনীতি এবং দেশটির জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রকাশ্যে তিনি রাশিয়ার বড় ধরনের আক্রমণের আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছিলেন।
কিন্তু এখন তিনি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পরিচিত একটি নাম, ইউক্রেনীয় প্রতিরোধের মুখ। ইউক্রেনে তার জনপ্রিয়তা প্রায় তিনগুণ বেড়েছে এবং অস্বাভাবিক হলেও স্থিতিশীল।
কঠোর সুরক্ষা ব্যবস্থার দুর্গে আগতদের সঙ্গে সহজ ও স্বাভাবিক বৈঠক, রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে বৈঠক কিংবা রণক্ষেত্রে সেনাদের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় সামরিক খাকি পোশাক পরে হাজির হওয়া জেলেনস্কি নিজেকে অটলতা ও অবিচলতার প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছেন।
এখনও তাকে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। রুশ সেনাদের ইউক্রেন থেকে পুরোপুরি বিতাড়িত করতে হলে এখনও তার প্রয়োজন অত্যাধুনিক পশ্চিমা যুদ্ধবিমান। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দ্রুত সদস্য হওয়া। পশ্চিমাদের সামরিক জোট ন্যাটোতে ইউক্রেনের যোগদান এখনও অনেক দূরের পথ মনে হচ্ছে।
অনেক সময় গোমড়া মুখ, চোখের নিচে কালি থাকলেও তিনি যে মনোবল হারিয়ে ফেলেছেন এমন কোনও ইঙ্গিত চোখে পড়েনি। গত মাসেই দুর্নীতি কেলেঙ্কারির ঘটনায় জনগণের ক্ষোভের মুখে সরকারে রদবদল এনেছেন।
কিয়েভভিত্তিক বিশ্লেষক ভলোদিমির ফেসেঙ্কো বলেন, অনেক মানুষকে অবাক করেছেন জেলেনস্কি… তারা তার নেতৃত্বের যোগ্যতাকে খাটো করে দেখেছিল। পুতিনও জেলেনস্কিকে সঠিকভাবে চিনতে পারেননি।
ফেসেঙ্কো বলেন, পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ নয়, পুতিন একটি সামরিক বিশেষ সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কারণ তিনি মনে করেছিলেন জেলেনস্কি ও ইউক্রেনীয় সেনবাহিনী দুর্বল এবং তারা দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে না। এটি একটি ভুল ছিল বলে প্রমাণিত হয়েছে।
রাশিয়ার আক্রমণের শুরুতে ইউক্রেনের ভাগ্য সূতোয় ঝুলছিল। একটি মোবাইল ফোনে ভিডিও রেকর্ড করে জেলেনস্কি ঘোষণা দেন, তিনি ও তার দেশ লড়াই করবে।
তিনি বলেছিলেন, ‘ইয়া তুত’। যার অর্থ, ‘আমি আছি’।
এটির মাধ্যমে সোশাল মিডিয়ায় যে ঝড় তিনি শুরু করেছিলেন তা যুদ্ধের পুরো সময় জারি ছিল। তার এই ঝড়ের একটি মূল বার্তা হলো, ‘আমরা জিতব’।
রয়টার্সের প্রতিনিধিরা দেখেছেন রণক্ষেত্রে জেলেনস্কির ইংরেজি নতুন বছরের বার্তা দেখে কীভাবে ইউক্রেনীয় সেনারা কেঁদেছেন।
জেলেনস্কি বলেছিলেন, এটি হলো সেই বছর যখন ইউক্রেন বিশ্বকে পাল্টে দিয়েছে। এবং বিশ্ব ইউক্রেনকে চিনেছে। আমাদেরকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু আমরা পাল্টা হামলার পথ বেছে নিয়েছি!
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের চিত্র বিপরীত। পুতিনকে অনেক সময় হতাশ বা নীরব এবং বিচ্ছিন্ন দেখাচ্ছে, পশ্চিমা বা ইউক্রেনের প্রতি হুমকি দিচ্ছেন ক্রেমলিনে বসে। মাঝে মধ্যে যেসব প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে হাজির হচ্ছেন সেগুলোও রাষ্ট্রীয় আয়োজনে আয়োজিত।
রুশ আক্রমণের পর থেকেই নিয়মিত বিদেশি নেতা, প্রতিনিধি ও সেলিব্রেটিরা দীর্ঘ ট্রেন ভ্রমণ শেষে কিয়েভ পৌঁছে জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এসেছে কোটি ডলার বিদেশি সহযোগিতা।
সহকারীরা বলেছেন, ইউক্রেনে রাশিয়া আক্রমণের পর থেকে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র প্রধান ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে ৩৭৭ বার ফোনে কথা বলেছেন জেলেনস্কি। বিভিন্ন দেশের পার্লামেন্ট ও বিদেশিদের আয়োজিত অনুষ্ঠানে ৪১ বার ভাষণ দিয়েছেন এবং ১৫২টি বৈঠকে অংশ নিয়েছেন তিনি।
রুশ ভাষাভাষী ইউক্রেনীয় ইহুদি পরিবারে জন্ম নেওয়া জেলেনস্কির ক্যারিয়ার শুরু হয় একজন অভিনেতা হিসেবে। ‘সার্ভেন্ট অব দ্য পিপল’ নামের টেলিভিশন অনুষ্ঠানে প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করে তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। দুর্নীতিবিরোধী অনুষ্ঠান হওয়ার কারণে তা ইউক্রেনীয়দের মধ্যে জনপ্রিয়তা পায়।
এই অনুষ্ঠানে জেলেনস্কি একজন সৎ স্কুল শিক্ষকের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। শ্রেণিকক্ষের একটি দুর্নীতি অনলাইনে ভাইরাল হওয়ার মধ্য দিয়ে যিনি জনপ্রিয়তা পান। পরে তিনি দুর্নীতিবাজ আইনপ্রণেতা ও ব্যবসায়ীদের পেছনে ফেলে প্রেসিডেন্ট হন।
২০১৯ সালে অভিনয় যেন বাস্তবতায় রূপ নেয়। এক প্রচারসভায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতিশ্রুতি সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার পর তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। যুদ্ধের সময় মানুষের কাছে পৌঁছাতেও তিনি এই শক্তিশালী অস্ত্র ব্যবহার করছেন।
রাশিয়ার আক্রমণ শুরুর পর রেকর্ড করা এক বক্তব্যে গোয়েন্দা তথ্য উল্লেখ করে জেলেনস্কি দাবি করেছিলেন, মস্কো তাকে এক নম্বর টার্গেট এবং তার স্ত্রী ও দুই সন্তানকে দুই নম্বর টার্গেট হিসেবে ঘোষণা করেছে।
কিয়েভ ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব সোসিওলজির উপ-পরিচালক আন্তন গ্রুশেতস্কির মতে, জেলেনস্কির প্রতি জনগণের আস্থার হার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ।
তিনি বলেন, আস্থার স্থিতিশীলতার এমন মাত্রা ইউক্রেনের ইতিহাসে নজিরবিহীন।
জেলেনস্কির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মোটাদাগে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ার মধ্যেই নেই। অনেক বিদেশি কূটনীতিক একান্ত আলোচনায় বলছেন, জেলেনস্কি ও তার টিমের হাতে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার কারণে তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন না।
দেশে রাজনৈতিক সমঝোতা বিরাজ করছে এবং জেলেনস্কি সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে পারছেন। এদের মধ্যে তার ক্ষমতার বলয়ের কাছাকাছি থাকা কয়েকজনও রয়েছেন।
২০১৯ সালের নির্বাচনে জেলেনস্কির কাছে পরাজিত সাবেক প্রেসিডেন্ট পেট্রো পরোশেঙ্কো বলছেন, সংঘাত চলমান থাকা অবস্থান জেলেনস্কির যুদ্ধকালীন দক্ষতা নিয়ে মূল্যায়ন উপযুক্ত হবে না।
তিনি বলেন, ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে আমি বিরোধী দলীয় নেতা নই, কারণ জেলেনস্কি ও পরোশেঙ্কো উভয়েই যোদ্ধা। এবং সব ইউক্রেনীয়দের ব্যক্তিত্ব নয়, ইউক্রেনকে ঘিরে ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, আমাদের জয় অর্জিত হওয়ার পর জনগণ জেলেনস্কি ও পরোশেঙ্কোর কাজের মূল্যায়ন করবেন।
আপাতত জনগণের সমর্থন রয়েছে জেলেনস্কির প্রতি।
পূর্ব ইউক্রেনে মোতায়েনরত একটি ইউনিটের কমান্ডার আন্তন ফেডোরেঙ্কো, তার কোড নেম মাজদা। তিনি বলেন, জেলেনস্কি পালাননি, তিনি আতঙ্কিত হননি। তাৎক্ষণিকভাবে একাধিক পদক্ষেপ নেন। তিনি মানুষের মনোযোগে ইউক্রেনকে নিয়ে আসেন, যা ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বিশ্বের কাছে সমস্যাটি তুলে ধরেছেন।
রয়টার্স অবলম্বনে।