কালের নিয়মে আর বয়সের ভারে ছাপাতুল্লা এখন বৃদ্ধ; নানান জটিল রোগে সে জর্জরিত; বেড়ানোর সমস্ত শক্তি তার চলে গেছে। সে এখন বাড়িতেই থাকে। কখনো শুয়ে কখনো বসে। পেচ্ছাপ লাগলে মাটির ভাড়ে পেচ্ছাপ করে। দুপুরে ঘাটে চান করতে যাওয়ার সময় বউমা ফেলে দিয়ে আসে এবং তার গা ধুয়ে দেয়।
কিন্তু পায়খানা সে মাটির ভাড়ে করে না। পায়খানা বাড়ির বাইরে করে। তার পায়খানার চেষ্টা হলে বউমাকে বলে। বউমা তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে বাইরে বসিয়ে দেয়। তার পায়খানা করার জন্য বাইরে একটা জায়গা খুঁড়ে রাখা আছে এবং তা পাট কাঠি দিয়ে বেড়া করে ঘিরে রাখা আছে। যাকে বলে মেটে পায়খানা।
এভাবেই চলছে ছাপাতুল্লার কয়েক বছর।
জোয়ান কালে ছাপাতুল্লার রাত বেড়ানো নেশা ছিল। খুব রাত বেড়াতো। রাতে বিছানায় শুয়ে ঘুম আসত না বলে রাত বেড়াতো।
একটা সময় সে খুব রাত জেগেছিল। তার ওই রাত জাগা থেকেই রাতের ঘুম চলে গিয়েছিল।
ছাপাতুল্লার বাপ নেছার আলি তখন বেঁচে ছিল। কিন্তু বাড়িতে জায়গা জমি কম ছিল বলে গরু, ছাগল ও হাঁস, মুরগি পোষা নিয়ে বাড়িতে ঝগড়া ঝামেলা লেগেই থাকত।
একদিন ছাপাতুল্লার একটা ছাগল তার ছোট ভাই আলি মহম্মদের ঘরে ঢুকে ভাত খেয়ে নিয়েছিল।
আলি মহম্মদ ছাপাতুল্লার সামনে ছাগলটাকে ধরে খুব মেরেছিল। ছাগলটা ভ্যা ভ্যা চিৎকার করেছিল।
ছাপাতুল্লা আলি মহম্মদের হাত থেকে ছাগলটা ছাড়িয়ে নিয়ে তখন বলেছিল, ‘অবোলা জীবকে অমন ভাবে মারিস ক্যানে! তোকে যতি কেহু মারে তোর ক্যামন লাগবে!’
‘ঘরে ঢুকে ভাত খালো ক্যানে!’
‘তাই বুলে তুই এই ভাবে মারবি!’
‘হ্যাঁ, মারবো।’
‘তো মার এবার দেখি!’ ছাপাতুল্লা রুখে দাঁড়িয়েছিল।
‘মারলে তুই কী করবি?’
‘মার তারপর দেখে লিবি!’ দুই ভাই তর্কাতর্কি শুরু করেছিল।
নেছার আলি তখন ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দু’জনের গালে ঠাস ঠাস করে চড় মেরে বলেছিল, ‘…আমার বাড়ি থাক্যা সব বার হয়ে যা! ফারোগে যাইয়্যা বাড়ি কর গা!’
তারপরই ছাপাতুল্লা এখানে চলে এসে বাড়ি করে।
জায়গাটার নাম পাহাড় ডাঙা। পাহাড়ের মতো উঁচু না হলেও বেশ উঁচু; কোন কালে একবার বিরাট একটা বান হয়েছিল। গোটা গ্রাম বানে ডুবে গেলেও এই জায়গাটা ডুবেছিল না। গ্রামের সব মানুষ এখানে আশ্রয় নিয়ে বেঁচেছিল। সেই থেকে জায়গাটার নাম পাহাড় ডাঙা।
ছাপাতুল্লা বাড়ি করার আগে এখানে কোন বাড়ি ছিল না। আকাট জঙ্গল ছিল। ফলে পাড়ার সবাই তাকে ভয় দেখিয়েছিল,’বাড়ি তো করছো, বাস করতে পারবা!’
‘দেখি!’
ছাপাতুল্লা বাড়ি করে বাস করতে শুরু করেছিল।
বাড়ি বলতে বিরাট দালান বাড়ি নয়; না পোড়া ছালট ইঁটের তৈরি উপরে টালি দেওয়া একটা ঘর।তখন যে বেশি ঘরের তার দরকার ছিল না। কারণ, এখনকার মতো তখন তার এত ছেলেমেয়ে ছিল না। এখন তার দশ ছেলে তিন মেয়ে। মোট তেরো সন্তান। কিন্তু তখন তার একটা মাত্র ছেলে ছিল। তা-ও আবার বয়সে কাঁচা। দুধ খাওয়া ছেলে। ওই ছেলের বউই তার এখন হাগা-মুত পরিষ্কার করে দেয়; ওই ছেলের কাছেই সে খায় এবং থাকে ; ওই ছেলেই তার সমস্ত দেখভাল করে; নাম কাদির।
ছাপাতুল্লা এত ছেলে নেওয়ার পিছনেও বিশেষ কারণ ছিল। বাড়িতে বেশি ছেলে থাকলে বাড়ি জেগে থাকে; চোর আসতে ভয় পায়। তখন যে গাঁয়ে খুবই চুরি হতো। কিন্তু ছাপাতুল্লার বাড়ি কোন দিন চুরি হয়নি।
ছাপাতুল্লা কোন রাতে ঘুমাত না। যা ঘুমানোর দিনের বেলায় ঘুমিয়ে নিয়ে রাতের বেলায় জেগে থাকত। বসে বসে লম্ফর আলোয় বিত্তি বুনত। বিত্তি সে খুব সুন্দর বুনতে পারত। তার বোনানো বিত্তির বেশ চাহিদা ছিল। বিত্তি বুনেই সে সংসার চালাত।
মাছ পচা ও খয়রামারী বিলে তখন প্রচুর মাছ হতো। দেশি সব ধরনের মাছ। ট্যাংরা, গুচি, জিওল, কই, মাগুর ও আরও কত রকমের মাছ। ওসব মাছ এখন আর পাওয়া যায়না। পাওয়া গেলেও দাম খুব বেশি। সব মানুষের পক্ষে কিনে খাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তখন এত মাছ হতো যে সব মানুষ ধরে খেতে পারত। কারণ, ওই দুই বিলে তখন সারা বছর মাছ হতো। বিল কখনো শুকাত না। কেবল ইলিশ মাছ বাদে সব ধরনের মাছ হতো। এখন সেই বিলও নেই সেই মাছও নেই। বৃষ্টির জলে উপরের মাটি কেটে নেমে নেমে বিল ভরাট হয়ে গেছে। বিল এখন তিন ফসলি আবাদি জমি।
এভাবে রাত জেগে জেগে ছাপাতুল্লার ছেলেরা যখন এক এক করে বড় হল এবং একখানা একখানা করে বাড়ি হতে হতে পুরো একটা পাড়া গড়ে উঠলো ছাপাতুল্লার তখন চোরের ভয় আর ছিল না; রাত জাগার দরকার ছিল না। তবু কোন রাতে তার ঘুম হতো না। আগে অত্যধিক রাত জাগার ফলে তার চোখ থেকে রাতের ঘুম চলে গিয়েছিল। ফলে সে রাত বেড়ানো শুরু করেছিল।
তার রাত বেড়ানোর সঙ্গী ছিল একটা লাঠি। কোন টর্চ লাইট সে ব্যবহার করত না। অন্ধকারেই ভালো চলতে পারত এবং ভালো দেখতে পেত। তার চোখের এত জ্যোতি ছিল! লাঠিটা ব্যবহার করত রাস্তার কুকুর ঠেঙানোর জন্য।
সন্ধ্যাবেলায় বলদ দুটো গোহালে তুলে দিয়ে ছাপাতুল্লা বেরিয়ে পড়ত। কোন দিন রাতের খাবার খেয়ে বেরোত কোন দিন রাত বেড়িয়ে এসে শেষ রাতের দিকে খেতো। আঠারো পাড়া গাঁয়ের সব ক’টা পাড়া সে রাতে বেড়াতো। বেড়াতে বেড়াতে গভীর রাতের দিকে কবরে মৃত ব্যক্তির ঘুমানোর মতো সারা জনপদ যখন ঘুমিয়ে পড়ত ছাপাতুল্লা তখন আর পাড়ায় থাকত না। লাঠিটা বগলে ভরে নিয়ে সোজা গোরস্থানে চলে যেত। আসসালামু আলাইকুম—সালাম দিয়ে গোরস্থানে প্রবেশ করত। সালাম দিয়ে গোরস্থানে ঢোকা হুকুম আছে। তাহলে ভয় লাগে না; গা দবকায় না; ঢুকে গোরস্থানে গাব গাছটার ডালে উঠে বসে থাকত। যতক্ষণ না ফজরের আযান হয় ততক্ষণ বসে থাকত। বসে আকাশের তারা দেখত; জোনাকি জ্বলা দেখত; শিয়ালের ডাক শুনত; নিস্তব্ধ গোরস্থানের ভয়ংকর রূপ নিজ চোখে দেখত। তাকেও যে একদিন এই গোরস্থানে শুয়ে থাকতে হবে সেটা ভাবত। গোরস্থানে যারা শুয়ে থাকে বাইরের জগতের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক বা যোগাযোগ থাকেনা। একদিন তারও বাইরের কোন মানুষের সাথে সম্পর্ক বা যোগাযোগ থাকবেনা… সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে…ঝড়ে কারেন্টের খুঁটি উপড়ে তার ছিঁড়ে যাওয়ার মতো… এসব ভাবতে ভাবতে ফজরের আযান হলে ছাপাতুল্লা ঘরে ফিরে ঘুমাতো। এভাবেই সে রাত বেড়াতো…
পুনশ্চঃ আমরা এখন যারা জোয়ান আছি কালের নিয়মে আর বয়সের ভারে আমরাও একদিন বৃদ্ধ হব; ছাপাতুল্লার মতো জোয়ান কালের কথা আমাদেরও সেদিন মনে পড়বে। চোখের জলে আমাদেরও সেদিন বালিশ ভিজবে। যেমন ভিজছে ছাপাতুল্লা ও আরও অনেক লোকের বালিশ। সুতরাং ছাপাতুল্লা ও আরও অনেক লোকের বার্ধক্য দশা দেখে আমরা কেউ হাসবো না। পারলে তার পাশ খানে বসে জোয়ান কালের গল্প শুনব। জোয়ান কালের গল্প বলতে পারলে তার মনটা অনেক হালকা হবে। বেশি সময়ের জন্য না হলেও কিছু সময়ের জন্যও হবে।#
জোয়ান কালের গল্প
এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
১৯৭৭ সালের ১৫ই আগস্ট ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলার ডোমকল থানার সারাংপুর খাাসপাড়া জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন কবি, গল্পকার এবং ঔপন্যাসিক। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বহু পত্র পত্রিকায় তিনি লেখালিখি করেন। তার মধ্যে আনন্দবাজার পত্রিকা, তথ্যকেন্দ্র পত্রিকা, সৃজন সাহিত্য পত্র 'প্রয়াস', আলো সাহিত্য পত্রিকা, বোধন সাহিত্য পত্রিকা, দুর্বার নিউজ, জিরোবাউন্ডারি কবিতা পত্রিকা ও আরও অনেক পত্র পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। প্রিয় নেশা গাছ লাগানো ও বই পড়া।
একটি মন্তব্য করুন
একটি মন্তব্য করুন